গাছ কীভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, কখন ফুল ফুটবে
আমরা যখন বাগানে গাছ লাগাই, তখন সবচেয়ে বেশি চিন্তা করি কী নিয়ে? হয়তো সার! কারণ, গাছের ঠিকঠাক বেড়ে ওঠার জন্য নাইট্রোজেন, পটাশিয়াম আর ফসফরাস খুব জরুরি। এর মধ্যে ফসফরাস হলো গাছের শক্তির উৎস।
কিন্তু সমস্যা হলো, পৃথিবীর মাটির তলায় জমানো ফসফরাসের ভাণ্ডার দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। কারণ, পৃথিবীতে ফসফরাসের খনি সীমিত এবং এটি নবায়নযোগ্য নয়। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, আগামী ৫০ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে উচ্চমানের ফসফরাসের রিজার্ভ শেষ হয়ে যেতে পারে। এটা বিশ্ব খাদ্যনিরাপত্তার জন্য এক বড় হুমকি।
ফসফরাস কমে গেলে ফসলের উৎপাদন কমে যায়। এতে আমাদের খাদ্যের সংকট দেখা দিতে পারে। মানুষ এখন হন্যে হয়ে খুঁজছে, কীভাবে অল্প ফসফরাস দিয়ে বেশি ফসল ফলানো যায়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, মানুষ এখন যা ভাবছে, গাছপালা সেটা কোটি বছর আগে থেকেই জানে!
মাটিতে যখন ফসফরাস কমে যায়, গাছ তখন চট করে ফুল ফোটায় না। সে অপেক্ষা করে। অনেকটা কঠিন সময়ে খরচ কমিয়ে টিকে থাকার মতো। গাছ কীভাবে বোঝে যে এখন ফুল ফোটানোর সময় নয়? এত দিন এটা বিজ্ঞানীদের কাছে রহস্য ছিল। অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকরা সেই রহস্যের জট খুলেছেন।
মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির প্ল্যান্ট রেজিলিয়েন্স ইনস্টিটিউটের গবেষকরা দেখেছেন, গাছের কোষের ভেতরে একধরনের আণবিক সুইচ আছে। মাটির অবস্থা বুঝে গাছ এই সুইচ অন বা অফ করে।
গবেষণার প্রধান লেখক হ্যাটেম রুয়াচেড বলছেন, ‘এই প্রথম আমরা দেখলাম, পুষ্টির অভাব কীভাবে সরাসরি কোষের ভেতরের প্রোটিনকে নড়াচড়া করায় এবং ফুল ফোটার সময় নিয়ন্ত্রণ করে।’
এই গবেষণাটি শুধু ল্যাবরেটরির চার দেয়ালে সীমাবদ্ধ নয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই একই প্রক্রিয়া ধান এবং অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রেও কাজ করে।
গল্পটা আসলে এক অলস প্রোটিনের। এর নাম bGLU25। গবেষক হুই-কিয়ং চো এবং তাঁর দল অ্যারাবিডোপসিস নামে এক ছোট আগাছা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এই প্রোটিনটিকে খুঁজে পান।
bGLU25 নামে বিশেষ প্রোটিনটি একটু অদ্ভুত। সে কোনো কাজ করে না, চুপচাপ বসে থাকে। কিন্তু তার আসল কাজ হলো গোয়েন্দাগিরি করা। মাটিতে যখন প্রচুর ফসফরাস থাকে, তখন এই bGLU25 প্রোটিনটি কোষের এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম নামে এক ঘরে চুপচাপ বসে থাকে। কিন্তু মাটিতে ফসফরাস কমে গেলেই শুরু হয় নাটক।
ফসফরাস কমলেই SCPL50 নামে আরেকটা প্রোটিন এসে bGLU25-কে কেটে মুক্ত করে দেয়। মুক্ত হয়ে bGLU25 ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে কোষের খোলা জায়গা বা সাইটোসলে। সেখানে সে AtJAC1 নামে এক বন্ধুর সঙ্গে জোট বাঁধে এবং GRP7 নামে আরেকটা প্রোটিনকে খপ করে ধরে ফেলে।
এই GRP7 প্রোটিনটি স্বাভাবিক অবস্থায় গাছের নিউক্লিয়াসে ঢুকে ফুল ফোটাতে সাহায্য করে। কিন্তু bGLU25 তাকে বাইরে আটকে রাখায় সে আর নিউক্লিয়াসে ঢুকতে পারে না।
ফলাফল? নিউক্লিয়াসের ভেতরে FLC নামের একটি জিন সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই জিনের কাজ হলো ফুল ফোটাতে বাধা দেওয়া। ব্যস! গাছ তখন ফুল ফোটানো বন্ধ করে দিয়ে নিজের শক্তি জমিয়ে রাখে বেঁচে থাকার জন্য।
ফসফরাস শুধু সার নয়, এটি ডিএনএ এবং আরএনএ তৈরির মূল উপাদান। এমনকি এটিপি (ATP) অণুর মধ্যেও ফসফরাস থাকে। তাই ফসফরাস ছাড়া গাছের পক্ষে বেঁচে থাকাই অসম্ভব।
এই গবেষণাটি শুধু ল্যাবরেটরির চার দেয়ালে সীমাবদ্ধ নয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই একই প্রক্রিয়া ধান এবং অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রেও কাজ করে।
হ্যাটেম রুয়াচেড আশাবাদী। তিনি মনে করেন, গাছের এই গোপন কৌশলটি কাজে লাগিয়ে আমরা এমন সব পুষ্টি-সচেতন ফসল উদ্ভাবন করতে পারব, যা কম সারেই ভালো ফলন দেবে।
ভাবুন তো, ভবিষ্যতে হয়তো এমন সব ধানের জাত আসবে, যা রুক্ষ মাটিতেও দিব্যি বেড়ে উঠবে। সারের অভাবে সেগুলো মরে যাবে না। মিশিগান স্টেটের এই আবিষ্কার আমাদের সেই টেকসই কৃষির পথই দেখাচ্ছে!