ফ্লু ভাইরাস কীভাবে মানুষের কোষে ঢোকে
শীত এলেই অনেকের জ্বর আসে, শরীর ব্যথা করে, নাক দিয়ে পানি পড়ে। আমরা সাধারণত বলি ফ্লু হয়েছে। এই রোগের কারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস। খুব ছোট ছোট বিন্দুর মাধ্যমে এই ভাইরাস আমাদের শরীরে ঢুকে পড়ে এবং কোষে আক্রমণ চালায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই আক্রমণটা আসলে কীভাবে ঘটে?
সুইজারল্যান্ড ও জাপানের বিজ্ঞানীরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে এক চমকপ্রদ তথ্য পেয়েছেন। গবেষকেরা নিজেরাই তৈরি করেছিলেন একটি বিশেষ ধরনের মাইক্রোস্কোপি পদ্ধতি। সেই পদ্ধতি ব্যবহার করে তারা পেট্রি ডিশে রাখা মানুষের কোষের পৃষ্ঠ অনেক কাছ থেকে দেখতে পেরেছেন। এই প্রথমবার জীবন্ত অবস্থায় এবং খুব উচ্চ রেজ্যুলেশনে তাঁরা সরাসরি দেখেছেন, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস কীভাবে একটি জীবন্ত কোষের ভেতরে ঢুকে পড়ে।
ইটিএইচ জুরিখের মলিকুলার মেডিসিনের অধ্যাপক ইয়োহেই ইয়ামাউচির নেতৃত্বে এই গবেষণা করা হয়। গবেষকেরা একটি বিষয়ে বিশেষভাবে বিস্মিত হয়েছেন। তাঁরা দেখেছেন, কোষগুলো একেবারে নিস্ক্রিয় হয়ে ভাইরাসের সামনে নিজেকে ছেড়ে দেয় না। বরং কোষগুলো নিজেরাই সক্রিয়ভাবে ভাইরাসকে ধরার চেষ্টা করে।
অবশ্য এর মানে এই নয় যে কোষ ভাইরাস ঢুকতে দিয়ে কোনো লাভ পায়। কোষ ইচ্ছা করেও ভাইরাসকে সাহায্য করে না। এই আদান-প্রদান ঘটে কারণ ভাইরাস কোষের একটি স্বাভাবিক ও জরুরি গ্রহণ প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোষ প্রতিদিন হরমোন, কোলেস্টেরল কিংবা আয়রনের মতো দরকারি জিনিস নিজের ভেতরে নেয়।
গবেষকেরা দেখেছেন, কোষগুলো একেবারে নিস্ক্রিয় হয়ে ভাইরাসের সামনে নিজেকে ছেড়ে দেয় না। বরং কোষগুলো নিজেরাই সক্রিয়ভাবে ভাইরাসকে ধরার চেষ্টা করে।
ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসও ঠিক এই দরকারি বস্তুগুলোর মতোই কোষের পৃষ্ঠের কিছু অণুর সঙ্গে লেগে থাকে। এই চলাফেরা অনেকটা কোষের পৃষ্ঠে সার্ফিং করার মতো। ভাইরাস কোষের গায়ে এদিক–ওদিক ঘুরে বেড়ায় এবং বিভিন্ন অণুর সঙ্গে লেগে থাকে; যতক্ষণ না সে কোষে ঢোকার জন্য সবচেয়ে ভালো একটি জায়গা খুঁজে পায়।
কোষের রিসেপ্টর যখন বুঝতে পারে যে একটি ভাইরাস ঝিল্লির সঙ্গে আটকে আছে, তখন সেই জায়গায় একটি ছোট গর্ত তৈরি হয়। এই গর্তটিকে ধরে রাখে ক্ল্যাথরিন নামে একটি বিশেষ প্রোটিন কাঠামো। ধীরে ধীরে সেই জায়গাটি বড় হতে থাকে এবং একসময় ভাইরাসটিকে পুরোপুরি ঘিরে ফেলে। তখন একটি থলির মতো গঠন তৈরি হয়, যাকে বলা হয় ভেসিকল। কোষ এই ভেসিকলটিকে নিজের ভেতরে টেনে নেয়। ভেতরে ঢোকার পর ভেসিকলের আবরণ গলে যায় এবং ভাইরাস মুক্ত হয়ে পড়ে।
আগের গবেষণাগুলোতেও এই প্রক্রিয়ার মূল কাঠামো জানা ছিল। সেসব গবেষণায় ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এই পদ্ধতিতে কোষ নষ্ট করতে হয়, ফলে শুধু স্থির ছবি পাওয়া যায়। আর ফ্লুরোসেন্স মাইক্রোস্কোপি ব্যবহার করলে জীবন্ত কোষ দেখা গেলেও রেজ্যুলেশন খুব কম ছিল।
নতুন যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি তৈরি হয়েছে অ্যাটমিক ফোর্স মাইক্রোস্কোপি ও ফ্লুরোসেন্স মাইক্রোস্কোপিকে একসঙ্গে মিলিয়ে। এই পদ্ধতির নাম দেওয়া হয়েছে ভাইরাস-ভিউ ডুয়াল কনফোকাল অ্যান্ড এএফএম, সংক্ষেপে ভিভিডি-এএফএম। এই প্রযুক্তির কারণেই এখন কোষে ভাইরাস ঢোকার পুরো প্রক্রিয়াটা ধাপে ধাপে, বিস্তারিতভাবে অনুসরণ করা সম্ভব হয়েছে।
কোষের রিসেপ্টর যখন বুঝতে পারে যে একটি ভাইরাস ঝিল্লির সঙ্গে আটকে আছে, তখন সেই জায়গায় একটি ছোট গর্ত তৈরি হয়। এই গর্তটিকে ধরে রাখে ক্ল্যাথরিন নামে একটি বিশেষ প্রোটিন কাঠামো।
এই পদ্ধতি ব্যবহার করে গবেষকেরা দেখিয়েছেন, কোষ বিভিন্ন স্তরে সক্রিয়ভাবে ভাইরাস গ্রহণের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। কোষ প্রয়োজনীয় ক্ল্যাথরিন প্রোটিনগুলোকে ঠিক সেই জায়গায় ডেকে আনে, যেখানে ভাইরাস আটকে থাকে। কোষের পৃষ্ঠও সেই স্থানে ফুলে ওঠে এবং ভাইরাসটিকে শক্তভাবে ধরে রাখে। যদি ভাইরাস আবার সরে যেতে চায়, তাহলে এই ঢেউয়ের মতো ঝিল্লির নড়াচড়া আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
এই নতুন পদ্ধতি অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দেয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোষ কালচারে সম্ভাব্য ওষুধ কতটা কার্যকর হচ্ছে, তা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে সরাসরি এবং তাৎক্ষণিকভাবে পরীক্ষা করা সম্ভব। গবেষকেরা জোর দিয়ে বলেছেন, এই পদ্ধতি অন্য ভাইরাসের আচরণ বোঝার জন্য, এমনকি ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যেতে পারে।
এই গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে পিএনএএস জার্নালে। এই আবিষ্কারের সাহায্যে বোঝা গেল, ভাইরাস সংক্রমণ কোনো একতরফা আক্রমণ নয়। এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া, যেখানে কোষ নিজেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকে। যদিও সেটি অনিচ্ছাকৃতভাবে। ভাইরাস কোষের নিজের দরকারি প্রক্রিয়াকেই ব্যবহার করে ভেতরে ঢুকে পড়ে। এই জ্ঞান ভবিষ্যতে আরও উন্নত চিকিৎসা তৈরিতে সাহায্য করবে, যা হয়তো ফ্লুর মতো রোগ থেকে মানুষকে আরও ভালোভাবে রক্ষা করতে পারবে।