ইনফ্লুয়েঞ্জা শব্দটি যেভাবে পেলাম

নতুন কিছু আলাদাভাবে চিহ্নিত করাসহ নানা কারণেই নাম দিতে হয়। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও কথাটি সত্য। এসব নামের পেছনেও লুকিয়ে থাকে মজার ইতিহাস।

ইনফ্লুয়েঞ্জা সাধারণভাবে ফ্লু নামে পরিচিত। একধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের কারণে এ সংক্রামক রোগ দেখা যায়। করোনাভাইরাসের মতো এই রোগেও শ্বাসযন্ত্রে সংক্রমণ হয় এবং এর উপসর্গও সর্দি-জ্বরের মতো। অর্থাৎ জ্বর, সর্দি, গলাব্যথা, পেশি ও হাড়ের সন্ধিতে ব্যথা, মাথাব্যথা ও কাশি। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের তথ্য অনুযায়ী, বছরে বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ৯ শতাংশ মানুষ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়। অর্থাৎ বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ১০০ কোটি মানুষ সংক্রমণের শিকার হয়, যাদের মধ্যে ৩০ থেকে ৫০ লাখ মানুষের সংক্রমণের মাত্রা তীব্র হয়ে থাকে। আর ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছর সারা বিশ্বে তিন থেকে পাঁচ লাখ মানুষ মারা যায়।

অর্থোমাইক্সোভাইরাস পরিবারের কারণে ফ্লুর মহামারি ও বৈশ্বিক মহামারি দেখা দেয়। এ রোগের নাম ইনফ্লুয়েঞ্জা (influenza) রাখা হয়েছিল পনেরো শতকে। ইতালিয়ান এই শব্দের অর্থ ইনফ্লুয়েন্স বা প্রভাব। তখন বিশ্বাস করা হতো, একটি অমঙ্গলকর অতিপ্রাকৃতিক প্রভাবের কারণে এ রোগ হয়। মধ্যযুগের চিকিৎসকেরা মনে করতেন, নক্ষত্রদের মতো ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর কাছে আসা ও দূরে সরে যাওয়ার সঙ্গে ফ্লু মহামারির যাওয়া-আসার চক্র নির্ভরশীল। তাই লাতিন Influentia থেকে ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগের নামকরণ।

আরও পড়ুন
ফ্লু A ভাইরাসের প্রাকৃতিক পোষক জলজ পাখি। বিশেষ করে হাঁস। কিন্তু ভাইরাসটি অন্য প্রাণীদেরও সংক্রমিত করতে পারে।

চার ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস আছে (যথা টাইপ A, B, C ও D)। এদের মধ্যে তিন ধরনের ভাইরাস (A, B ও C) মানবদেহে রোগ সৃষ্টি করতে পারে। এর সব কটিই আরএনএ ভাইরাস। A টাইপ ভাইরাসগুলোর মধ্যে রয়েছে কুখ্যাত স্প্যানিশ ফ্লু, রাশিয়ান ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু (H1N1), এশিয়ান ফ্লু (H2N2), হংকং ফ্লু (H3N2), বার্ড ফ্লু (H5N1)।

ফ্লু A ভাইরাসের প্রাকৃতিক পোষক জলজ পাখি। বিশেষ করে হাঁস। কিন্তু ভাইরাসটি অন্য প্রাণীদেরও সংক্রমিত করতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে গৃহপালিত হাঁস-মুরগি, শূকর, ঘোড়া, বিড়াল ও সিল। A টাইপ ভাইরাসে পাখির মধ্যে কোনো লক্ষণ দেখা না গেলেও অন্যদের মধ্যে দক্ষতার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ফ্লু ভাইরাসের আটটি জিন থাকে, যেগুলো বিভক্ত। এর মানে হলো, তার জিনোম আরএনএর অবিচ্ছিন্ন সূত্রক না হয়ে প্রতিটি জিন আলাদা আলাদা সূত্রক গঠন করে। H (হেমাগ্লুটিনিন) এবং N (নিউরামিনিডেস) জিনগুলো প্রতিরক্ষামূলক পোষকের প্রতিরোধব্যবস্থায় উদ্দীপনা তৈরি করতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ পর্যন্ত ১৬টি ভিন্ন ভিন্ন H এবং ৯টি ভিন্ন ভিন্ন N জিন পাওয়া গেছে। বার্ড ফ্লু ভাইরাসে এদের সব কটির সম্মিলন দেখা যায়। ভাইরাসে এসব জিন আলাদা আলাদা আরএনএ সূত্রক হিসেবে থাকার কারণে মাঝেমধ্যে তারা মিশে যায় বা নতুন করে সম্মিলন হয়। কাজেই দুটি ফ্লু A ভাইরাসের আলাদা আলাদা H বা N জিন যদি একটা কোষকে সংক্রমিত করে, তাহলে তাদের বংশধর ভাইরাস পিতামাতার কাছ থেকে পাওয়া বিভিন্ন ধরনের জিনের সম্মিলন বহন করবে। এসব বংশধর বেশির ভাগ মানুষকে সংক্রমিত করতে পারবে না। তবে মাঝেমধ্যে ভাইরাসের নতুন কোনো স্ট্রেইন গঠিত হবে, যা সরাসরি মানুষের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে এবং বৈশ্বিক মহামারির জন্ম দিতে পারবে। ঠিক এমন ঘটনাই আমরা সোয়াইন ফ্লুর ক্ষেত্রে দেখেছি।

আরও পড়ুন
১৯৬৮ সালে দেখা দেয় H3N2 হংকং ফ্লু। এতে দুটি নতুন জিন এসেছিল বুনো হাঁস থেকে।

গত শতাব্দী ধরে পাঁচটি বৈশ্বিক মহামারি দেখা গেছে। এর মধ্যে আছে ১৯১৮ সালের H1N1 স্প্যানিশ ফ্লু। এতে আটটি জিনের সব কটিই এসেছিল পাখি থেকে। ১৯৫৭ সালে দেখা দিয়েছিল H2N2 এশিয়ান ফ্লু। এর মধ্যে H ও N পাখি থেকেও এসেছিল। ১৯৬৮ সালে দেখা দেয় H3N2 হংকং ফ্লু। এতে দুটি নতুন জিন এসেছিল বুনো হাঁস থেকে। ১৯৭৭ সালে রাশিয়ান ফ্লু, যেটি সম্ভবত রাশিয়ার কোনো ল্যাব থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল। রাশিয়ান ফ্লু ১৯৫০-এর দশকের H1N1-এর একটি সংস্করণ। এদিকে ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু দেখা গিয়েছিল মেক্সিকোতে। এতে ছয়টি জিন এসেছিল উত্তর আমেরিকা থেকে এবং দুটি জিন এসেছিল ইউরেশিয়ান শূকরের ফ্লু ভাইরাস থেকে।