যে যন্ত্র বাঁচাবে অপরিণত শিশুর জীবন
নবাগত শিশুর জন্য মা-বাবা আকুল হয়ে অপেক্ষা করেন। অনেক ক্ষেত্রেই সে অপেক্ষা মধুর হয় না। সময়ের আগে জন্ম নেওয়া শিশুর ক্ষেত্রে সেই অপেক্ষা প্রায়ই দুঃসংবাদ হয়ে আসে। মাতৃগর্ভে ৩৭ সপ্তাহ পুরো হওয়ার আগেই শিশুর জন্ম হলে তাকে বলা হয় অপরিণত নবজাতক। এদের শ্বাসকষ্ট, জন্ডিস, রক্তস্বল্পতা, কম তাপমাত্রা, দুর্বল রোগ-প্রতিরোধসহ নানা রোগ দেখা যায়। মস্তিষ্ক, চোখ বা শরীর পূর্ণ বিকাশের সময় পায় না। তাই মৃত্যুর হারও বেশি।
চিকিৎসাবিষয়ক প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক জার্নাল ল্যানসেট জানিয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে আগাম জন্ম নেওয়া শিশুর মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব বলছে, দেশে প্রতি ১০০ শিশুর মধ্যে ১৬ জন সময়ের আগে জন্মায়। বছরে এমন শিশু জন্মায় প্রায় পাঁচ লাখ, আর প্রতি ঘণ্টায় মারা যায় ৩ জন।
সময়ের আগে জন্ম থামানো যায় না। কিন্তু জীবনটাকে একটু বাড়িয়ে দেওয়া কি সম্ভব? বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন। শিশুটি যেন পৃথিবীতে এসেও কিছুদিন মায়ের গর্ভের মতো নিরাপদ পরিবেশ পায়, এই ভাবনা থেকেই এসেছে অ্যাকুয়া উম্বের মতো একটি যন্ত্র।
২০১৭ সালে ফিলাডেলফিয়ার গবেষকেরা পরীক্ষামূলকভাবে এমন কৃত্রিম গর্ভের কথা বলেন। মায়ের শরীরের বাইরে ভ্রূণের মতো প্লাস্টিকের স্বচ্ছ ব্যাগে শিশু ভেসে বেড়াচ্ছে, এমন দৃশ্যই তখন আলোচনায় আসে। চোখ বন্ধ, হৃদস্পন্দন চলছে; দেখলে মনে হয় ঠিক মায়ের গর্ভেই আছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব বলছে, দেশে প্রতি ১০০ শিশুর মধ্যে ১৬ জন সময়ের আগে জন্মায়। বছরে এমন শিশু জন্মায় প্রায় পাঁচ লাখ, আর প্রতি ঘণ্টায় মারা যায় ৩ জন।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এফডিএ এ প্রযুক্তির মানবপরীক্ষা নিয়ে কমিটি করে। দেশটিতে প্রতিবছর দশ হাজারের বেশি শিশু মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে জন্মায়। অনুমোদন মিললে ২২-২৪ সপ্তাহ বয়সী অত্যন্ত অপরিণত শিশুদেরও বাঁচানো সম্ভব হবে। তবে এখনো এই পরীক্ষার চূড়ান্ত অনুমতি আসেনি।
নতুন প্রযুক্তি সফল হলেও মাতৃত্ব বা গর্ভধারণের চিরন্তন মানবিক ধারণা বদলে যাবে, এমনটা ভাবার কারণ নেই। অ্যাকুয়া উম্বকে দেখে গর্ভের কথা মনে আসে না, বরং অ্যাকুয়ারিয়ামের মতো লাগে। জার্মানির আখেন শহরের একটি উন্নত ল্যাবরেটরিতে কাচের সেই পাত্র রাখা আছে।
তাতে আলো জ্বলে, শিশুর নড়াচড়াও বোঝা যায়। ভবিষ্যতে তা ঢেকে রাখা হবে, যেন গর্ভের মতো অন্ধকার আর নিরাপদ পরিবেশ তৈরি হয়। বাইরে বের হওয়া নলগুলো অ্যামনিওটিক তরল ছেঁকে আবার ফিরিয়ে দেয়। শিশু তরলে ভেসে থাকে, পান করে, বেড়ে ওঠে ঠিক গর্ভের মতোই।
তরলের তাপমাত্রা ৯৯.৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট, মায়ের শরীরের তুলনায় সামান্য বেশি। ভেতরে দ্বিস্তরের ব্যাগ ঝুলে থাকে। শিশুটি বড় হলে ভেতরের স্তর প্রসারিত হয়। বাইরের অংশ মজবুত, কিন্তু নরম। শিশুর লাথি খেলে সেটি প্রতিরোধ করে, আবার পেশিরও বিকাশ ঘটায়।
অ্যাকুয়া উম্বকে দেখে গর্ভের কথা মনে আসে না, বরং অ্যাকুয়ারিয়ামের মতো লাগে। জার্মানির আখেন শহরের একটি উন্নত ল্যাবরেটরিতে কাচের সেই পাত্র রাখা আছে।
সবচেয়ে বড় সংকট হলো ফুসফুস। সাধারণ জন্মে শিশুর প্রথম কান্না জানান দেয়, ফুসফুস কাজ শুরু করেছে। কিন্তু অত্যন্ত অপরিণত শিশুর ক্ষেত্রে সেই মুহূর্তটা খুব তাড়াতাড়ি চলে আসে। ফুসফুস ঠিকমতো প্রস্তুত থাকে না। এ কারণে নিওনেটাল ইনটেনসিভ কেয়ারে ডাক্তাররা ভেন্টিলেটর ও ইনকিউবেটর দিয়ে শ্বাস চালু রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু ঝুঁকি থেকে যায়। স্থায়ী ক্ষতির ঝুঁকি।
অ্যাকুয়া উম্ব ঠিক এই জায়গায় এসে বদলে দিতে পারে হিসাবটা। মায়ের গর্ভ থেকে সিজারিয়ান করে যে শিশুটি বের করা হয়, তাকে সরাসরি তরলে ভরা থলিতে রাখা হয়। নাভিরজ্জুতে যুক্ত করা হয় কৃত্রিম নাড়ি। নরম ক্যাথেটার রক্ত থেকে কার্বন ডাই–অক্সাইড বের করে। মজবুত ক্যানুলা দিয়ে অক্সিজেন ও প্রয়োজনীয় পুষ্টি পৌঁছে দেয়।
যন্ত্রের ভেতরের পরিবেশ শিশুর শরীরকে ঠিক সেই বাড়তি সময়টা দেয়, যে সময়টুকু সে মায়ের গর্ভে পেত। আর সেই সময়ই হয়তো জীবন বাঁচানোর চাবিকাঠি।
এই প্রযুক্তি একদিকে অপরিণত শিশুর জীবনে নতুন আলো জ্বালায়, অন্যদিকে খোলাসা করে দেয় অনেক নৈতিক প্রশ্নও। ভবিষ্যৎ কেমন হবে, ঠিক বলা যায় না। তবে এতটুকু স্পষ্ট, ছোট্ট প্রাণটিকে বাঁচাতে বিজ্ঞানের পথচলা আরও এক ধাপ এগিয়ে গেছে।