গর্ভধারণ করবে রোবট, আদৌ কি সম্ভব

গর্ভধারণক্ষম রোবট কল্পবিজ্ঞানের বিষয় হলেও 'কৃত্রিম গর্ভাশয়' কিন্তু বাস্তব গবেষণার বিষয়

এই সপ্তাহের শুরুর কথা। সোশ্যাল মিডিয়ার নিউজফিড স্ক্রল করতে গিয়ে আপনি হয়তো ছবিগুলো দেখেছেন। দেখে থাকলে চমকে উঠেছেন, বলা বাহুল্য। অদ্ভুত কিছু ছবি। মানব শিশুর মতো দেখতে কুণ্ডলী পাকানো কিছু একটা শুয়ে আছে ধাতব রোবটের পেটের ভেতরে। রোবটের শরীরে তারের জট, কিন্তু সে দিব্যি একটি শিশুকে গর্ভে ধারণ করে আছে! খবরের শিরোনাম বলছে, চীনে তৈরি হচ্ছে এমনই এক 'গর্ভধারণক্ষম রোবট'। নিউজউইক থেকে শুরু করে দ্য ইকোনমিক টাইমস-এর মতো বড় বড় পত্রিকাও ছেপেছে এই খবর। এসব সূত্রে দাবি করা হয়েছে, এর পেছনে আছেন ঝ্যাং কিফেং নামের এক গবেষক। তিনি ২০২৬ সালের মধ্যেই এই রোবট বাজারে আনতে চান। দাম বেশি বটে, তবে অবিশ্বাস্যরকম বেশি নয়।  ১৪ হাজার ডলারের কাছাকাছি।

ঝ্যাং কিফেং-এর উদ্ধৃতি দিয়ে নিউজউইক জানিয়েছে, ‘অনেকে গর্ভধারণ করতে চান না, কিন্তু সন্তান চান।’ তাঁদের জন্য এই রোবটকে আশীর্বাদ বলেই দাবি করা হয়েছে ওই সূত্রে। আবার বন্ধ্যাত্বের মতো সমস্যাও সমাধান করবে এই রোবট, এমন দাবিও করা হয়েছে। সূত্র মতে, ঝ্যাং বলেছেন, কৃত্রিম গর্ভাশয়ের প্রযুক্তিকে রোবটের পেটে বসিয়ে দিলেই হবে, কেল্লাফতে!

বিভিন্ন প্রতিবেদনে ঝ্যাংকে কখনো বলা হচ্ছে ‘কাইওয়া টেকনোলজি’ নামের এক কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা, আবার কখনো বলা হচ্ছে সিঙ্গাপুরের বিখ্যাত নানিয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি বা এনটিইউ থেকে তিনি পিএইচডি করেছেন।

গর্ভধারণক্ষম রোবট কল্পবিজ্ঞানের বিষয় হলেও 'কৃত্রিম গর্ভাশয়' কিন্তু বাস্তব গবেষণার বিষয়। আর এ নিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার চিলড্রেন'স হসপিটালে (CHOP)।

এই কথাগুলো কল্পবিজ্ঞানের মতো শোনায়, বলা বাহুল্য। সত্যি বলতে, এমনই এক ভয়ংকর সময়ের কথা আছে বিখ্যাত ডিস্টোপিয়ান সায়েন্স ফিকশন ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড-এ। কিন্তু বর্তমান সময়ে কল্পবিজ্ঞানের অনেক কিছু আমাদের চোখের সামনেই রূপ নিচ্ছে বাস্তবে। তার ওপর আলোচ্য গবেষক খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় থেলে পিএইচডি করেছেন। কাজেই এই লেখার লেখকও নিশ্চিত ছিলেন না, হকচকিয়ে গিয়েছিলেন, হয়েছেন শঙ্কিত। এরকম কিছু খতিয়ে দেখাও কঠিন।

আরও পড়ুন

অবশেষে কাজটি করেছে লাইভ সায়েন্স। তারা প্রথমে অনলাইনে খতিয়ে দেখেছে, কিন্তু ‘কাইওয়া টেকনোলজি’ নামে কোনো কোম্পানির অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি। এরপর তারা সরাসরি যোগাযোগ করে এনটিইউ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। সেখান থেকে উত্তর আসে, ঝ্যাং কিফেং নামে কেউ তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে পিএইচডি করেনি এবং এ ধরনের গর্ভধারণক্ষম কোনো রোবট নিয়ে সেখানে কোনো গবেষণাও হচ্ছে না।

তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়াল? ঠিক ধরেছেন, খবরটি ভুয়া। কিন্তু এই ভুয়া গল্পই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে। এই খবর ভুয়া হলেই কি এর পেছনের প্রযুক্তিটিকে অসম্ভব বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে? নাকি যন্ত্রের গর্ভে সত্যিই বেড়ে উঠতে পারে মানবশিশু? শঙ্কিত হওয়ার আগে চলুন, বিষয়টি খতিয়ে দেখা যাক। আর সে জন্য এখানে তুলে ধরব লাইভ সায়েন্স-এ প্রকাশিত নিকোলেটা লানেসের সেই লেখাটি, সহজ বাংলায়।

গর্ভধারণক্ষম রোবট কল্পবিজ্ঞানের বিষয় হলেও 'কৃত্রিম গর্ভাশয়' কিন্তু বাস্তব গবেষণার বিষয়। আর এ নিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার চিলড্রেন'স হসপিটালে (CHOP)। সেখানকার বিজ্ঞানীরা এক্সটেন্ড (EXTEND) নামে একটি যন্ত্র তৈরি করছেন। তাঁদের উদ্দেশ্য কিন্তু সায়েন্স ফিকশনের মতো মানুষ তৈরি করা নয়, বরং অত্যন্ত অপরিণত বা প্রিম্যাচিউর অবস্থায় ভূমিষ্ট শিশুদের বাঁচানো।

একটি অসুস্থ, অপরিণত শিশুকে কয়েক সপ্তাহের জন্য বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা আর নিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে পুরো নয় মাস ধরে একটি শিশুকে যন্ত্রের ভেতর বড় করে তোলার মধ্যে রয়েছে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।

যেসব শিশু গর্ভধারণের মাত্র ২৩ থেকে ২৮ সপ্তাহের মধ্যে জন্মায়, তাদের ফুসফুসসহ বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঠিকভাবে গঠিত হয় না। ফলে তাদের বাঁচানো এবং সুস্থ রাখাটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। ফিলাডেলফিয়ার চিলড্রেন'স হসপিটালের গবেষকেরা এই সমস্যারই একটি সমাধান খুঁজছেন। তাঁরা কৃত্রিম গর্ভাশয়ে মায়ের গর্ভাবস্থার মতো একটি পরিবেশ তৈরি করতে চান, যেখানে অপরিণত শিশুর বয়স ২৮ সপ্তাহ হওয়া পর্যন্ত তাকে যত্নে ও নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা যাবে।

তাঁদের তৈরি ‘এক্সটেন্ড’ যন্ত্রটি মূলত একটি ব্যাগ। এটি ল্যাবে তৈরি অ্যামনিওটিক তরলে পূর্ণ। এতে শিশুর নাভিকে জুড়ে দেওয়া হয় একটি বহিরাগত অক্সিজেনারেটরের সঙ্গে। এটিই মায়ের দেহের প্লাসেন্টা বা অমরার মতো কাজ করে। অর্থাৎ শিশুকে অক্সিজেন দেয়, আর কার্বন ডাই-অক্সাইড বের করে নেয়। এই ব্যবস্থায় শিশুটি বাইরের তাপমাত্রা, চাপ, আলো, এমনকি জীবাণুর সংক্রমণ থেকেও পুরোপুরি সুরক্ষিত থাকে।

আরও পড়ুন

এখন পর্যন্ত বেশ কটি ভেড়ার বাচ্চাকে এর ভেতরে রেখে পরীক্ষা করা হয়েছে। বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে, অ্যানিমেল ট্রায়াল। ফলাফল বেশ আশাব্যঞ্জক। দেখা গেছে, অপরিণত ভেড়ার বাচ্চাকে এই যন্ত্রে প্রায় এক মাস পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবে বড় করা সম্ভব হয়েছে, ঠিক যেমনটা মায়ের গর্ভে হতো। কিন্তু এর হিউম্যান ট্রায়াল, অর্থাৎ অপরিণত কোনো মানবশিশুকে এর ভেতরে রেখে এখনো পরীক্ষা করা হয়নি। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্টিলিটি বিশেষজ্ঞ ড. লুসিন আঘাজানোভার মতে, ‘গবেষণাটি দেখিয়েছে, এটি একটি সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা আমাদের ভাবনার চেয়েও অনেক জটিল।’

অর্থাৎ, একটি অসুস্থ, অপরিণত শিশুকে কয়েক সপ্তাহের জন্য বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা আর নিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে পুরো নয় মাস ধরে একটি শিশুকে যন্ত্রের ভেতর বড় করে তোলার মধ্যে রয়েছে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। তার ওপর, আদৌ অপরিণত মানবশিশুকে এর ভেতরে বাঁচিয়ে রাখা যাবে কি না, সেটাও এখনো পরীক্ষার বিষয়।

রোবটের গর্ভে মানবশিশুকে বড় করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কোনটা? বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই চ্যালেঞ্জের তালিকা বেশ লম্বা।

প্রথমেই আসে ‘ইমপ্লান্টেশন’ বা জরায়ুতে ভ্রূণ স্থাপনের বিষয়টি। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নিষিক্ত ডিম্বাণু জরায়ুর প্রাচীরে নিজেকে গেঁথে নেয়, সেখান থেকে পুষ্টি সংগ্রহ শুরু করে। একটি যন্ত্র কীভাবে এর অনুকরণ করবে?

যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটির ড. হার্ভে ক্লিম্যান এ ক্ষেত্রে একটি ভিন্ন সম্ভাবনার কথা বলছেন। যুক্তিবিদ্যায় ‘প্রুভিং আ নেগেটিভ’ বলে একটা বিষয় আছে, অর্থাৎ কোনো কিছু ‘নেই’, তা প্রমাণ করা। এটা প্রায় অসম্ভব। যেমন ধরুন, কেউ দাবি করল, পৃথিবীতে গোলাপি হাতি আছে। আপনি পুরো পৃথিবী খুঁজে না পেলেও ১০০ ভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারবেন না যে আসলে এ রঙের হাতি নেই। হতে পারে, কোনো গহিন জঙ্গলে, যেখানে স্যাটেলাইটের কৃত্রিম চোখও পৌঁছাতে পারেন, সেখানেই লুকিয়ে আছে এ রঙের কয়েকটি হাতি। এ জন্য আদালতেও দাবিটা বাদীকে প্রমাণ করতে হয়, বিবাদীকে ‘অপরাধ না করা'র বিষয়টি প্রমাণ করতে হয় না। ঠিক তেমনি, আমরা হয়তো ভাবছি ইমপ্লান্টেশন অপরিহার্য, কিন্তু তা না-ও হতে পারে। ড. ক্লিম্যানের মতে, ‘ব্যাপারটা অনেকটা হাইড্রোপনিক্স বা মাটি ছাড়া পানিতে গাছ চাষ করার মতো। বিষয়টা এভাবে ভাবুন: একটা টমেটো গাছকে যেমন কায়দা করে পানিতে ভাসিয়ে রেখে পুষ্টি দেওয়া হয়, মানব ভ্রূণকেও হয়তো সেভাবে তরলের মধ্যে ভাসমান রেখে বড় করা সম্ভব।’’

আসলে, পুরো নয় মাস ধরে একটি শিশুকে যন্ত্রের গর্ভে বড় করে তোলার ধারণাটি এখনো কল্পবিজ্ঞানের পর্যায়েই রয়ে গেছে। এর প্রযুক্তিগত ও নৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো এত বিশাল যে অদূর ভবিষ্যতে এর সমাধান প্রায় অসম্ভব।

কিন্তু ড. আঘাজানোভা এর সঙ্গে একমত নন। তাঁর মতে, ‘ইমপ্লান্টেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি বীজ এবং মাটির মতো।’ জরায়ুর প্রাচীর শুধু ভ্রূণকে ধরেই রাখে না, তার বৃদ্ধি এবং অমরার বিকাশেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

আরও পড়ুন

দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হলো পুষ্টি সরবরাহ। গর্ভাবস্থার শুরুতে মায়ের দেহ থেকে কম অক্সিজেনযুক্ত পরিবেশে পুষ্টি সরবরাহ হয়, যা ভ্রূণের ডিএনএ-কে রক্ষা করে। পরে ধীরে ধীরে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়ে। একটি যন্ত্র কীভাবে এই সূক্ষ্ম পরিবর্তন নিখুঁতভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে?

এরপর আসে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার প্রশ্ন। মায়ের শরীর থেকে অ্যান্টিবডি শিশুর শরীরে গিয়ে তাকে বাইরের পৃথিবীর জন্য প্রস্তুত করে। রোবটের তো নিজের কোনো ইমিউন সিস্টেম নেই। তাহলে শিশুকে অ্যান্টিবডি দেওয়া হবে কীভাবে? হয়তো ল্যাবে তৈরি অ্যান্টিবডি বা দান করা রক্ত দিয়ে এর সমাধান করা যেতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, এমন অনেক বিষয় থাকতে পারে, যা আমরা এখনো জানিই না। মায়ের গর্ভে শিশু শুধু পুষ্টি আর অক্সিজেনই পায় না, এর বাইরেও হয়তো এমন কিছু আদান-প্রদান হয়, যা তার মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য জরুরি। একটি যন্ত্রের শীতল পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিশু কি এসব থেকে বঞ্চিত হবে না?

তাহলে শেষ কথা কী? শেষ কথা হলো, কৃত্রিম গর্ভাশয় নিয়ে ভাইরাল হওয়া গর্ভধারণক্ষম রোবটের গল্পটি হয়তো ভুয়া, কিন্তু এর পেছনের প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা চলছে। তবে এর উদ্দেশ্য মানুষকে প্রতিস্থাপন করা নয়, বরং অপরিণত শিশুদের জীবন বাঁচানো।

আসলে, পুরো নয় মাস ধরে একটি শিশুকে যন্ত্রের গর্ভে বড় করে তোলার ধারণাটি এখনো কল্পবিজ্ঞানের পর্যায়েই রয়ে গেছে। এর প্রযুক্তিগত ও নৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো এত বিশাল যে অদূর ভবিষ্যতে এর সমাধান প্রায় অসম্ভব। খুব স্বাভাবিক বুদ্ধিতেই বোঝা যায়, বিষয়টা অত্যন্ত অমানবিক। পাশাপাশি প্রাকৃতিক গর্ভধারণের বিষয়টা সত্যিকারের এক বিস্ময়। আমরা হয়তো এ নিয়ে আলাদা করে ভাবি না, কিন্তু মায়ের গর্ভে মানবশিশুর বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি এত সূক্ষ্ম, এত বিস্ময়কর যে ভাবলে চমকে যেতে হয়। বোঝা যায়, নতুন প্রাণের বেড়ে ওঠার মতো সুন্দর, সূক্ষ্ম, অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য আসলে এই মহাবিশ্বেই খুব বেশি নেই।

সূত্র : লাইভ সায়েন্স

আরও পড়ুন