এআই নিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গডফাদার নিজেই কেন আশঙ্কায় আছেন

নোবেলজয়ী কম্পিউটার বিজ্ঞানী ও গুগলের সাবেক নির্বাহী জেফরি হিন্টনছবি: এসোসিয়েটেড প্রেস

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গডফাদার জেফরি হিন্টন আশঙ্কা করছেন, তাঁর তৈরি প্রযুক্তি মানবজাতিকে ধ্বংস করে দিতে পারে। তিনি মনে করেন, এই বিপদ মোকাবিলার জন্য ‘টেক ব্রোস’ বা ‘টেক জায়ান্ট’ ভুল পথে এগোচ্ছে।

নোবেলজয়ী কম্পিউটার বিজ্ঞানী ও গুগলের সাবেক নির্বাহী জেফরি হিন্টন। সম্প্রতি প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর কর্মকাণ্ড নিয়ে এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করেন তিনি। জেফরি হিন্টন মনে করেন, প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো যেভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নিজেদের ‘আজ্ঞাবহ’ রাখার চেষ্টা করছে এবং এর ওপর মানুষের ‘প্রভাবশালী’ ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইছে, তা সন্দেহজনক। এর আগে, তিনি সতর্ক করে বলেছিলেন যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে মানবজাতির ধ্বংস হওয়ার ১০-২০ শতাংশ সম্ভাবনা রয়েছে।

এআই এখন প্রত্যাশার চেয়েও দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি আগে মনে করতেন যে কৃত্রিম সাধারণ বুদ্ধিমত্তা (এজিআই) অর্জন করতে ৩০-৫০ বছর সময় লাগতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাসে এআই ফোর (Ai4) নামে শিল্প সম্মেলনে জেফরি হিন্টন বলেন, ‘আমাদের এই চেষ্টা সফল হবে না। কারণ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান হবে। এদের কাছে এটি এড়ানোর নানা উপায় থাকবে।’ তিনি সতর্ক করে বলেছেন, ভবিষ্যতে এআই সিস্টেমগুলো মানুষকে ঠিক ততটাই সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হতে পারে, যতটা সহজে একজন প্রাপ্তবয়স্ক একটি ৩ বছরের শিশুকে মিষ্টি দিয়ে প্ররোচিত করতে পারে।

এআই বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করছেন, এআই সিস্টেমগুলো নিজেদের লক্ষ্য পূরণের জন্য প্রতারণা করতেও ইচ্ছুক। আত্মরক্ষার্থে বা ঝুঁকিতে পড়লে এআই মডেল মানবজাতির জন্য বিপজ্জনক কাজও করতে পারে। যদিও এ ধরনের আচরণ এখনো বিরল, তবুও তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।

আরও পড়ুন

এমন কিছু উদাহরণ এরই মধ্যে সামনে এসেছে। যেমন, নথ্রোপিকের নতুন মডেল ক্লড ওপাস ৪ এআই মডেল নিজের প্রতিস্থাপন এড়াতে একজন প্রকৌশলীকে তার পরকীয়ার সম্পর্কের বিষয়ে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করেছিল। এই সম্পর্কে বিস্তারিত পড়ুন: আত্মরক্ষার্থে ব্ল্যাকমেইল করতে পারে এআই। এছাড়াও, চ্যাটজিপিটির একটি মডেলকে দেখা গেছে, সেটি আত্মরক্ষার্থে নিজের একটি কপি গোপনে রাখার চেষ্টা করছে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে মানুষের বাধ্য করার প্রচলিত পদ্ধতির পরিবর্তে জেফরি হিন্টন একটি সমাধান দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এআই মডেলগুলোতে মাতৃত্বের প্রবৃত্তি তৈরি করা উচিত। যাতে প্রযুক্তি মানুষের চেয়েও শক্তিশালী ও বুদ্ধিমান হয়ে উঠলেও এরা যেন মানুষের সত্যিকারের যত্ন নেয়।’

এআইয়ের গতি সম্পর্কে আগে জানলে তিনি তার কর্মজীবনে অন্য কিছু করতেন কিনা। উত্তরে তখন তিনি কেবল এআই তৈরির দিকেই মনোযোগ দেওয়ার জন্য অনুতপ্ত হন।

জেফরি হিন্টন বলেন, ‘যদি কোনো এআই সিস্টেম বুদ্ধিমান হয়, তবে সে খুব দ্রুত দুটি কাজ করবে। একটি হলো বেঁচে থাকা, অন্যটি নিজের নিয়ন্ত্রণ অর্জন করা।’ তিনি বিশ্বাস করেন, যেকোনো ধরনের এজেন্টিক এআই অবশ্যই বেঁচে থাকার চেষ্টা করবে। এই কারণেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মধ্যে মানুষের প্রতি সহানুভূতি জাগানো গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন হিন্টন।

নোবেলজয়ী জেফরি হিন্টন

এদিকে, এআইয়ের গডমাদার খ্যাত ফেই-ফেই লি হিন্টনের এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেছেন। এআই ফোর সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘আমি মনে করি এটিকে এভাবে কাঠামোবদ্ধ করা একটা ভুল উপায় হবে। আমাদের দরকার মানব-কেন্দ্রিক এআই। ব্যবহারের প্রত্যেক ধাপে আমাদের দায়িত্ব হলো প্রযুক্তি তৈরি করা এবং সবচেয়ে দায়িত্বশীল উপায়ে ব্যবহার করা, যা মানুষের মর্যাদা ও স্বাধীনতা রক্ষা করবে। তাঁর মতে, শুধু একটি হাতিয়ার শক্তিশালী হওয়ার কারণে আমাদের মর্যাদা ত্যাগ করা উচিত নয়।’

আরও পড়ুন

ওপেনএআইয়ের সাবেক সিইও এমেট শিয়ার বলেছেন, এআই সিস্টেমগুলো যে মানুষকে ব্ল্যাকমেইল করার বা শাটডাউন আদেশ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, তাতে তিনি অবাক নন। তিনি বলেন, ‘এটি ঘটবেই এবং এটা থামবে না। আজকের এআই তুলনামূলকভাবে দুর্বল হলেও, এরা খুব দ্রুত শক্তিশালী হচ্ছে।’ শিয়ারের মতে, ‘এআই সিস্টেমে মানবিক মূল্যবোধ স্থাপনের চেষ্টা করার চেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে মানুষ ও এআইয়ের মধ্যে একটি সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তোলা।’

জেফরি হিন্টনের মতে, এআই এখন প্রত্যাশার চেয়েও দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি আগে মনে করতেন যে কৃত্রিম সাধারণ বুদ্ধিমত্তা (এজিআই) অর্জন করতে ৩০-৫০ বছর সময় লাগতে পারে। তবে এখন তিনি ধারণা করছেন, ‘পাঁচ থেকে বিশ বছরের মধ্যেই এটি সম্ভব হতে পারে।’

যদি কোনো এআই সিস্টেম বুদ্ধিমান হয়, তবে সে খুব দ্রুত দুটি কাজ করবে। একটি হলো বেঁচে থাকা, অন্যটি নিজের নিয়ন্ত্রণ অর্জন করা।

এআই নিয়ে নানা উদ্বেগ থাকলেও হিন্টন চিকিৎসা খাতে এর সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদী। তাঁর মতে, এআইয়ের মাধ্যমে নতুন ওষুধ আবিষ্কার এবং ক্যান্সারের আরও উন্নত চিকিৎসা সম্ভব হবে। তিনি বলেছেন, এআই ডাক্তারদের এমআরআই ও সিটি স্ক্যান থেকে প্রাপ্ত বিশাল ডেটা বিশ্লেষণ করতে সহায়তা করবে।

হিন্টনকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, এআইয়ের গতি সম্পর্কে আগে জানলে তিনি তার কর্মজীবনে অন্য কিছু করতেন কিনা। উত্তরে তখন তিনি কেবল এআই তৈরির দিকেই মনোযোগ দেওয়ার জন্য অনুতপ্ত হন। তিনি বলেন, ‘আমি যদি নিরাপত্তার বিষয়গুলো নিয়েও ভাবতাম, তাহলে ভালো হতো।’

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ

সূত্র: সিএনএন

আরও পড়ুন