প্রযুক্তি
যুক্তরাষ্ট্রের গোপন সভায় এআইয়ের কাছে হারল গণিতবিদেরা
একটি গোপন সভা। বিশ্বের নামকরা গণিতবিদেরা সেখানে উপস্থিত। তাঁদের সামনে একটাই চ্যালেঞ্জ—প্রশ্ন করে হারাতে হবে একটা চ্যাটবটকে। সেই চেষ্টায় কি সফল হতে পারলেন গণিতবিদেরা?
ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে শহরে বসেছে একটা গোপন বৈঠক। বিশ্বের নামকরা ৩০ জন গণিতবিদ আছেন সেখানে। কেউ কেউ এসেছেন যুক্তরাজ্যর মতো দূর দেশ থেকেও। তাঁদের উদ্দেশ্য একটাই—একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই চ্যাটবটকে হারানো। এই চ্যাটবটটির নাম ‘o4-mini’। গণিতবিদেরা একে এমন কঠিন সব প্রশ্ন করবেন, যা সমাধান করতে মানুষেরও ঘাম ছুটে যায়।
চলতি বছর মে মাসের মাঝামাঝি বসেছিল এই গোপন সভা। গণিতবিদেরা একের পর এক কঠিন প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন বটটির দিকে। কিন্তু হার মানে না ওটা। এভাবে প্রশ্নোত্তর ছোড়াছুড়ি চলল টানা দুই দিন। ফলাফল দেখে অবাক হলেন গণিতবিদেরাই। বট এমনভাবে উত্তর দিচ্ছে যেন গণিতের একজন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক। একের পর এক কঠিন প্রশ্নের সমাধান করে দিল চ্যাটবট। কিন্তু গণিতবিদেরা হঠাৎ কেন একটা চ্যাটবটের পেছনে লাগল? এর পেছনেও আছে একটা গল্প। শুরুতে সেই পেছনের গল্প শুনি, তারপর জানব দুই দিনের সেই রোমাঞ্চকর কাহিনি।
এরপর তাঁরা আরও কঠিন প্রশ্ন তৈরি করলেন। চ্যাটবট যাতে সেগুলো আগে থেকে পেতে না পারে, তাই ওসব প্রশ্ন একে অপরের সঙ্গে শেয়ার করেননি। অর্থাৎ ইমেলে প্রশ্নগুলো কেউ কারো সঙ্গে শেয়ার করেননি।
চ্যাটবট যে এখন নানা ধরনের গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে পারে, তা মোটামুটি সবার জানা। তাই একদল গবেষক চ্যাটবটকে একটু বাজিয়ে দেখতে চাইল। ঘটনার সূত্রপাত সেখান থেকেই। শুরুতে পরিচিত কিছু গাণিতিক সমস্যা দিয়ে চ্যাটবটকে পরীক্ষা করল। সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোর উত্তর করে দিল বট। এতে গণিতবিদেরা হয়তো কিছুটা বিরক্তই হলেন! বিশেষজ্ঞ গণিতবিদদের মতো একটা এআই সমস্যার সমাধান করলে বিরক্ত হওয়ারই কথা। তাঁরাও ছেড়ে কথা বলার পাত্র নন। বটকে নাস্তানাবুদ করতে তাই ৩০০টি প্রশ্নের ব্যবস্থা করা হলো। এসব প্রশ্ন অবশ্য আগেই তৈরি করা ছিল। প্রশ্নগুলোর একটা বিশেষত্ব আছে—এগুলো আগে কোথাও প্রকাশিত হয়নি। ফলে চ্যাটবটের পক্ষে সেসব প্রশ্নের উত্তর আগে থেকে জানা সম্ভব ছিল না।
এই প্রশ্নগুলো প্রথমে সাধারণ এআই মডেলগুলোকে সমাধান করতে দেওয়া হলো। মাত্র ২ শতাংশের কম প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরেছে সেগুলো। এরপর দেওয়া হলো ‘ও-ফোর-মিনি’-কে। ওটা প্রায় ২০ শতাংশ প্রশ্নের সমাধান করতে পেরেছে। তবে এখানেই বিষয়টা শেষ করতে চাননি গণিতবিদেরা।
এরপর তাঁরা আরও কঠিন প্রশ্ন তৈরি করলেন। চ্যাটবট যাতে সেগুলো আগে থেকে পেতে না পারে, তাই ওসব প্রশ্ন একে অপরের সঙ্গে শেয়ার করেননি। অর্থাৎ ইমেলে প্রশ্নগুলো কেউ কারো সঙ্গে শেয়ার করেননি। কারণ, ইমেলে যদি এআই আড়ি পাতে! এরপর গণিতবিদদের উৎসাহিত করতে ঘোষণা করা হলো, যার প্রশ্ন এআই সমাধান করতে পারবে না, তাঁকে পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হবে সাড়ে ৭ হাজার ডলার। বাংলাদেশি মূদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৯ লাখ টাকা। তবে এভাবে কাজ দ্রুত এগোচ্ছিল না। তাই কাজটা আরও দ্রুত শেষ করতে ৩০ গণিতবিদকে ডাকা হলো এই গোপন বৈঠকে। শুরুতে এই বৈঠকের কথাই বলেছি।
ভবিষ্যতের জন্য এসব প্রশ্ন তোলা থাক। তবে শেষ করার আগে জানিয়ে রাখি, গোপন বৈঠকের এই প্রতিযোগিতা আয়োজন করে ইপক এআই নামে একটি সংস্থা। আর ওপেনএআইয়ের ও-ফোর-মিনির মতো এসব গাণিতিক সমস্যা সমাধান করতে পারে জেমিনি ২.৫ ফ্ল্যাশও।
গণিতবিদেরা যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে শহরে এলেন। তাঁদেরকে মোট ৬টি দলে ভাগ করা হলো। দুই দিন ধরে এমন সব প্রশ্ন তৈরি করার চেষ্টা করলেন, যেগুলোর সমাধান তাঁরা পারেন, কিন্তু এআই পারবে না। এক্ষেত্রেও শেষ হাসি হাসতে পারলেন না তাঁরা। বটের বুদ্ধিমত্তার কাছে সবাই যেন অসহায় হয়ে পড়লেন।
এই গণিতবিদদের মধ্যে একজন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতবিদ কেন ওনো। তিনি নিজের কথা শেয়ার করেছেন। সেই রোমাঞ্চকর কাহিনি এবার শোনা যাক।
‘আমি এমন একটি প্রশ্ন তৈরি করেছিলাম, যা দেখলে আমার ডিপার্টমেন্টের বিশেষজ্ঞরা বলতেন, এটি নম্বর থিওরির একটি অমীমাংসিত প্রশ্ন। একজন ভালো পিএইচডি ছাত্রের জন্য এটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। এমন একটা প্রশ্ন আমি বটকে দিলাম সমাধান করতে। পরের দশ মিনিট আমি শুধু অবাক হয়ে দেখলাম, কীভাবে বটটি ধাপে ধাপে এর সমাধান বের করে। প্রথম দুই মিনিট এআই বটটি এই বিষয়ে লেখা সব গবেষণা খুঁজে বের করে পড়তে শুরু করল। তারপর স্ক্রিনে লিখল, মূল সমস্যা সমাধানের আগে একটি সহজ সমস্যা সমাধান করে নিজেকে প্রস্তুত করতে চায়। কয়েক মিনিট পর ওটা জানাল, এবার সে মূল সমস্যাটি সমাধানের জন্য প্রস্তুত। আরও পাঁচ মিনিট পর ওটা একটি নির্ভুল সমাধান হাজির করল।’
এখানেই চমকের শেষ নয়। শুধু সমাধান করেই থেমে থাকেনি বট। ওটা রসিকতা করে লিখেছে, ‘এই সমাধানের জন্য কোনো সূত্রের উল্লেখ করতে হবে না। কারণ, রহস্যময় সংখ্যাটি আমিই বের করেছি!’
নিজের এই পরাজয়ে হতবাক হয়ে যান কেন গণিতবিদ ওনো। পরের দিন ভোরে তিনি বাকিদের মেসেজ করে জানান তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। এরকম একটি উন্নত এআইয়ের মুখোমুখি হওয়ার জন্য ওনো নিজেও প্রস্তুত ছিলেন না। একজন বিজ্ঞানী ঠিক যেভাবে কাজ করেন, বটটাও সেভাবে ধাপে ধাপে অল্প সময়ের মধ্যে সেই কাজটা করল। এটা সত্যিই ভয়ংকর!
তবে গণিতবিদদের জন্য আশার কথা হলো, তাঁদের করা প্রশ্নগুলো থেকে ১০টি উত্তর দিতে পারেনি চ্যাটবট। এক্ষেত্রে গণিতবিদদের কিছুটা সফল বলাই যায়। কিন্তু আসলে এতটা খাটনি করে ঠিক কতটা সফল হলেন তাঁরা?
গণিতবিদেরা যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে শহরে এলেন। তাঁদেরকে মোট ৬টি দলে ভাগ করা হলো। দুই দিন ধরে এমন সব প্রশ্ন তৈরি করার চেষ্টা করলেন, যেগুলোর সমাধান তাঁরা পারেন, কিন্তু এআই পারবে না।
এবার একটু আশঙ্কার কথা বলি। এই প্রতিযোগিতা যতটা রোমাঞ্চকর ছিল, ততটাই উদ্বেগজনকও। এক বছরের মধ্যে এআইয়ের যে অগ্রগতি হয়েছে, তা সত্যিই বিস্ময়কর। ভাবতে পারেন, তাহলে গণিতের ভবিষ্যৎ কী? এআই যদি এমন সব জটিল সমস্যার সমাধান করতে শুরু করে, তাহলে মানুষের ভূমিকা কী হবে? ভবিষ্যতে কি গণিতবিদেরা শুধু নতুন নতুন প্রশ্নই তৈরি করবেন? নাকি এআইয়ের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবেন?
এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় হয়তো এখনো আসেনি। ভবিষ্যতের জন্য এসব প্রশ্ন তোলা থাক। তবে শেষ করার আগে জানিয়ে রাখি, গোপন বৈঠকের এই প্রতিযোগিতা আয়োজন করে ইপক এআই নামে একটি সংস্থা। আর ওপেনএআইয়ের ও-ফোর-মিনির মতো এসব গাণিতিক সমস্যা সমাধান করতে পারে জেমিনি ২.৫ ফ্ল্যাশও। এই মডেলগুলো শুরুর দিকের এআই বট থেকে অনেক আলাদা। একে বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে অত্যন্ত জটিল বিশ্লেষণের জন্য। আগের এআই মডেলগুলো শুধু পরের শব্দটি কী হবে, তা অনুমান করতে পারত। কিন্তু নতুন এই মডেলগুলো অনেক ডেটার সাহায্যে প্রশিক্ষিত হওয়ায় ডুব দিতে পারে গণিতের গভীরে। সমস্যার সমাধান করতে পারে নিজেই!
