হাঙ্গরের আক্রমণ থেকে বিজ্ঞানীকে বাঁচাল যে তিমি

তিমি অনেককেই রক্ষা করে, কিন্তু রক্ষা করার কৌশল সবসময় আনন্দদায়ক হয় নাছবি: আন্দ্রেয়া ইজ্‌জোত্তি/শাটারস্টক

ন্যান হাউজার। পেশায় একজন তিমি বিজ্ঞানী। তাঁর জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কেটেছে সাগরের নোনা পানিতে, বিশাল সব তিমির সঙ্গে সাঁতার কেটে আর তাদের নিয়ে গবেষণা করে। তিনি ভাবতেন, এই বিশাল প্রাণীগুলোকে তিনি খুব ভালো করেই চেনেন। কিন্তু কুক আইল্যান্ডসের অদূরে সাগরের গভীরে সেদিন যা ঘটেছিল, তা ন্যান হাউজারের সারা জীবনের অভিজ্ঞতাকে এক নিমিষেই ওলটপালট করে দিয়েছিল।

দিনটা ছিল রৌদ্রোজ্জ্বল। ন্যান তাঁর টিম নিয়ে সাগরে নেমেছিলেন হাম্পব্যাক তিমির ভিডিও ধারণ করতে। নীল পানির গভীরে তিনি দুটি হাম্পব্যাক তিমির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল, কিন্তু হঠাৎ করেই দৃশ্যপট বদলে গেল।

দুটি তিমির মধ্যে একটি হঠাৎ ন্যান হাউজারের দিকে তেড়ে এল। তিমিটা শুধু কাছেই এল না, তাঁকে রীতিমতো ধাক্কা দিতে শুরু করল। বিজ্ঞানী ন্যান অবাক হয়ে গেলেন। সাধারণত তিমিরা মানুষের সঙ্গে এমন আচরণ করে না।

পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠল। কয়েক টন ওজনের বিশাল এই প্রাণীটি ন্যানকে নিজের বিশাল পাখনার নিচে চেপে ধরার চেষ্টা করতে লাগল। আপনি হয়তো ভাবছেন, তিমির আলিঙ্গন নিশ্চয়ই খুব আরামদায়ক? মোটেও না! তিমির গায়ে এবং পাখনায় থাকে ধারালো বার্নাকল, মানে শামুক জাতীয় একধরনের শক্ত খোলস। ওগুলো রেজারের মতো ধারালো।

ন্যান হাউজার প্রাণভয়ে কুঁকড়ে গেলেন। তিমিটি তাকে পানি থেকে প্রায় শূন্যে তুলে ফেলছে, আবার পিঠের ওপর নিয়ে সাঁতার কাটছে। ন্যান বারবার চেষ্টা করলেন তিমিটির থেকে সরে যেতে, কিন্তু তিমিটা নাছোড়বান্দা। ওটা তাকে ছাড়ছেই না। প্রায় ১০ মিনিট ধরে চলল এই ধস্তাধস্তি। ন্যান ভাবলেন, আজই হয়তো তার জীবনের শেষ দিন। তার হাড়গোড় হয়তো গুঁড়ো হয়ে যাবে এই বিশাল প্রাণীর চাপে।

আরও পড়ুন
ওই বিশাল হাঙ্গরটি যাতে ন্যানকে খেয়ে ফেলতে না পারে, সেজন্যই তিমিটি তাকে নিজের পাখনার নিচে লুকিয়ে রেখেছিল এবং পিঠে করে নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে দিচ্ছিল

কোনোমতে তিমিটির কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ন্যান যখন একটু দূরে সরে এলেন এবং নিজের বোটের দিকে সাঁতার কাটলেন, ঠিক তখনই তিনি বুঝতে পারলেন তিমিটি আসলে কী করছিল।

একটু দূরে তিনি পানির ওপর ঝাপটা মারতে দেখলেন। প্রথমে ভাবলেন, ওটা হয়তো অন্য কোনো তিমি। কিন্তু ভালো করে তাকাতেই তার রক্ত হিম হয়ে গেল। ওটা কোনো তিমি ছিল না। প্রাণীটি তার লেজ ওপর-নিচ করার বদলে ডানে-বামে নাড়াচ্ছিল।

আসলে ওটা ছিল এক বিশাল টাইগার শার্ক! ন্যান হাউজার পরে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি সারা জীবন পানির নিচে কাটিয়েছি, অনেক টাইগার শার্ক দেখেছি। কিন্তু ওটা ছিল একটা আস্ত ট্রাকের মতো বিশাল! আর ওটা সোজা আমার দিকেই আসছিল।’

তখনই ন্যান বুঝতে পারলেন, তিমিটি তাকে আক্রমণ করছিল না। আসলে তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করছিল! ওই বিশাল হাঙ্গরটি যাতে ন্যানকে খেয়ে ফেলতে না পারে, সেজন্যই তিমিটি তাকে নিজের পাখনার নিচে লুকিয়ে রেখেছিল এবং পিঠে করে নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে দিচ্ছিল। তিমিটি জানত, আশেপাশে বিপদ ওত পেতে আছে, যা জানতেন না ন্যান।

বিজ্ঞানের ভাষায় হাম্পব্যাক তিমিদের এই আচরণকে বলা হয় অলট্রুইজম। মানে, নিজের কোনো লাভ ছাড়াই বা নিজেকে বিপদে ফেলে অন্যকে সাহায্য করা। হাম্পব্যাক তিমিরা প্রায়ই সিল মাছ বা অন্য তিমির বাচ্চাদের হাঙ্গরের হাত থেকে বাঁচায়। কিন্তু একটা ভিন্ন প্রজাতিকে, মানে একজন মানুষকে এভাবে বাঁচাতে এগিয়ে আসার ঘটনা বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিরল। তিমিটি নিজের জীবন বাজি রেখেছিল ন্যানকে বাঁচানোর জন্য।

তবে এখানেই যদি গল্পের শেষ ভাবেন, তাহলে একটু ভুল হবে। আসলে সবটা জানা হবে না। গল্পটা কিন্তু এখানেই শেষ নয়। মুভির মতো এক অবিশ্বাস্য ক্লাইম্যাক্স এখনো বাকি আছে।

আরও পড়ুন
‘আমি ওকে মিস করি। মানে, কেউ কি কখনো কোনো তিমিকে মিস করে? কিন্তু আমি করি।’
ন্যান হাউজার, হাঙরের আক্রমণ থেকে তিমির সাহায্যে বেঁচে ফেরা বিজ্ঞানী

সেই ঘটনার ঠিক এক বছর ১৫ দিন পর, ন্যান হাউজার আবার সেই একই এলাকায় কাজ করছিলেন। হঠাৎ তার রেডিওতে খবর এল, আশেপাশে একটি তিমি দেখা গেছে। ন্যান বোট নিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেলেন।

তিমিটিকে দেখেই ন্যান চমকে উঠলেন। তিমিটির লেজের দিকে দুটি বিশেষ খাঁজ কাটা দাগ ছিল, আর মাথায় ছিল একটা পুরনো ক্ষতচিহ্ন। এটা সেই তিমি! তাঁর জীবনরক্ষাকারী সেই বন্ধুটি!

ন্যান হাউজার উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠলেন, ‘সে ফিরে এসেছে! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, সে ফিরে এসেছে!’

ন্যান কালবিলম্ব না করে ওয়েটস্যুট পরে পানিতে ঝাঁপ দিলেন। তিমিটির পাশে গিয়ে সাঁতার কাটতে শুরু করলেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, আশপাশে আরও অনেক মানুষ এবং বোট থাকলেও তিমিটি কাউকে পাত্তা দিল না। সে সোজা ন্যানের কাছে এল।

ন্যান বললেন, ‘সে তার বড় বড় চোখ মেলে আমার দিকে তাকাল। আমাকে চিনতে পারল। সে আলতো করে আমাকে ধাক্কা দিল বা নাড়াচড়া করল। মনে হচ্ছিল যেন বহুদিন পর হারিয়ে যাওয়া পোষা কুকুর তার মনিবকে খুঁজে পেয়েছে। ছয় মাস পর প্রিয় কুকুরকে দেখলে যেমন অনুভূতি হয়, ঠিক তেমনটাই লাগছিল।’

২৭ থেকে ৩৩ টন ওজনের এক বিশাল জলজ প্রাণী, আর তার সামনে ক্ষুদ্র এক মানুষ। কিন্তু তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল এক অদ্ভুত মায়ার বাঁধন। সাগরের সেই বিশাল বডিগার্ড শুধু ন্যানকে বাঁচিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, এক বছর পর এসে যেন তাকে হ্যালো বলে গেল।

ন্যান হাউজার আবেগাপ্লুত হয়ে বলেছিলেন, ‘আমি ওকে মিস করি। মানে, কেউ কি কখনো কোনো তিমিকে মিস করে? কিন্তু আমি করি।’

প্রকৃতি মাঝে মাঝে আমাদের এমন সব বিস্ময়ের মুখোমুখি করে, যা বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা দিয়েও বোঝানো যায় না। এক হিংস্র হাঙ্গর, এক অসহায় মানুষ, আর তাদের মাঝখানে ঢাল হয়ে দাঁড়ানো এক বিশাল তিমি। ন্যান ও তিমিটির এই গল্পই আমাদের বলে দেয়, ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা শুধু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সমুদ্রের গভীররেও এর অস্তিত্ব আছে!

সূত্র: আইএফএল সায়েন্স