শিশুদের কোয়াশিওরকর রোগ কেন হয়, লক্ষণ কী

ছবি: দ্য স্টেটসম্যান

চাঁদমুখ শব্দটি সচরাচর প্রশংসা বোঝালেও শিশুদের জন্য এ যেন এক অশনি সংকেত। সাধারণত কোনো শিশু কোয়াশিওরকরে আক্রান্ত হলে মুখে পানি জমে চাঁদের মতো গোল হয়ে যায়। শুধু মুখই নয়, শরীরে, পা এমনকি লিভারেও জমতে পারে পানি। প্রশ্ন হলো, শিশুদের এই কোয়াশিওরকর রোগ কেন হয়?

শিশুদের প্রোটিনের ঘাটতিজনিত গুরুতর অপুষ্টিজনিত রোগ হলো কোয়াশিওরকর। সাধারণত মায়ের দুধ ছাড়ানোর পর ৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়।

মায়ের দুধ ছাড়ানোর পর শিশুরা যদি সুষম ও প্রোটিনসমৃদ্ধ খাদ্য না পায়, তাহলে এ রোগের ঝুঁকি বাড়ে। বিশেষ করে ১-৩ বছর বয়সী শিশুরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। কারণ, এই সময় তাদের দ্রুত শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য প্রোটিন ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান প্রয়োজন। এ বয়সের শিশুরা সংক্রমণের ঝুঁকিতেও বেশি থাকে, যা অপুষ্টি সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলে।

দরিদ্র দেশগুলোতে, সাধারণত যেখানে পুষ্টির অভাব বড় সমস্যা সেখানে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। বিশ্বের দরিদ্র ও জনবহুল এলাকায়, বিশেষ করে বাংলাদেশ, আফ্রিকা, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় কোয়াশিওরকরের প্রকোপ বেশি। এসব অঞ্চলে শিশুদের খাদ্য প্রধানত শর্করাসমৃদ্ধ খাদ্যশস্য ও শাকসবজির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, যা প্রোটিনের ঘাটতি পূরণে অসমর্থ। শর্করাপ্রধান খাদ্যাভাসের বাংলাদেশে অপুষ্টিজনিত রোগের কারণে শিশু মৃত্যুর হার এখনও উদ্বেগজনক।

ছবি: প্রডিয়া

কোয়াশিওরকর মূলত খাদ্যের প্রয়োজনীয় প্রোটিনের অভাবে হয়। প্রোটিন মানব শরীরের কোষ ও টিস্যুর গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যখন শিশুরা শর্করাসমৃদ্ধ কিন্তু প্রোটিনের ঘাটতিযুক্ত খাবার খায় খায়, তখন এ রোগ দেখা দেয়।  

বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী প্রধানত চাল, আলু, শাকসবজি ইত্যাদি শর্করাসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করে। এতে প্রোটিনের ঘাটতি পূরণ হয় না। যদিও মায়ের দুধ শিশুর জন্য প্রোটিনের একটি প্রধান উৎস। অনেক ক্ষেত্রে মায়ের দুধ পর্যাপ্ত পরিমাণে না হলে, অথবা শিশুকে সময়মতো পরিপূরক খাদ্য দেওয়া হয় না হলে এ রোগ হতে পারে।

আবার অনেকের সুষম খাদ্য কেনার সামর্থ্য থাকে না। এমন পরিবারের সন্তানদেরও প্রোটিনের ঘাটতি দেখা দেয়। এছাড়া ডায়রিয়া, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণসহ দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত শিশুরা অপুষ্টির ঝুঁকিতে থাকে। তাই বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কোয়াশিওরকর এখনও একটি বড় শিশু স্বাস্থ্য সমস্যা।

আরও পড়ুন

প্রোটিনের মূল বিল্ডিং ব্লক হলো অ্যামিনো অ্যাসিড। অর্থাৎ অ্যামিনো অ্যাসিড হলো প্রোটিনের মৌলিক উপাদান। ২০ ধরনের অ্যামিনো অ্যাসিডের মধ্যে ৯টি অত্যাবশ্যকীয়। এগুলো শরীরে নিজ থেকে তৈরি হয় না। ফলে খাবার থেকে ঘাটতি পূরণ করতে হয়।

শিশুদের বৃদ্ধি এবং বিকাশের সময় শরীরের প্রতিটি অংশ সঠিকভাবে কাজ করার জন্য কিছু প্রোটিন ও অ্যামিনো অ্যাসিডের  প্রয়োজন। বিশেষত শিশুদের জন্য ৯টি অত্যাবশ্যকীয় অ্যামিনো অ্যাসিড দরকার। এগুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে বলছি:

১. লিউসিন (Leucine): পেশি গঠনে সাহায্য করে এবং রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে। ডিম, মুরগি, বাদাম ও ডাল লিউসিনের ভালো উৎস।

২. আইসোলিউসিন (Isoleucine): পেশি তৈরিতে ও হিমোগ্লোবিন উৎপাদনে সাহায্য করে। আইসোলিউসিনের উৎস ডাল, বাদাম, মাছ।

৩. লাইসিন (Lysine): লাইসিন শিশুর দেহে ক্যালসিয়ামের শোষণ বাড়ায় এবং হাড়ের গঠনে সহায়ক। দুধ, পনির, মাছ ও মাংস লাইসিনের উৎস।

৪.মিথিওনিন (Methionine): এটি কোষের মেরামত এবং নতুন কোষ তৈরিতে সাহায্য করে। ডিম, মাছ, মাংস, ডাল মিথিওনিনের ভালো উৎস।

শিশু যখন দীর্ঘসময় এই প্রোটিন চাহিদা পূরণ করতে পারে না এবং চাহিদা প্রোটিনের বিপরীতে শর্করা জাতীয় খাবারের মাধ্যমে সুষম খাদ্যের ঘাটতি পূরণ করে, তখন শিশুর শরীরে কোয়াশিওরকরের লক্ষণ দেখা দেয়।

৫. থ্রিওনিন (Threonine): থ্রিওনিন ত্বক, হাড় ও লিগামেন্ট গঠনে সাহায্য করে। ডিম, মাংস ও দুধ থেকে ভালো মানের থ্রিওনিন পাওয়া যায়।

৬.ট্রিপটোফ্যান (Tryptophan): ট্রিপটোফ্যান শিশুর ওপর বিশেষ ভূমিকা রাখে। এটি মস্তিষ্কে সেরোটোনিন উৎপাদনে সাহায্য করে, যা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর জন্য কলা, ডিম ও দুধ ট্রিপটোফ্যানের উৎস হিসাবে কাজ করে ।

৭. ভ্যালিন (Valine): মস্তিষ্ক এবং নার্ভাস সিস্টেমের সঠিক কার্যক্রমে সহায়তা করে। ডাল, বাদাম, মাছ থেকে এটি পাওয়া যায়।

৮. হিস্টিডিন (Histidine): রক্তের হিমোগ্লোবিন উৎপাদনে সাহায্য করে এবং ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করে। এর উৎস মাংস, ডাল ও বীজ।  

৯. ফেনাইলঅ্যালানিন (Phenylalanine): এনজাইম এবং হরমোন উৎপাদনে সহায়ক। এর প্রধান উৎস দুধ, মাছ ও ডিম।

আরও পড়ুন

এই ৯টি অত্যাবশ্যকীয় অ্যামিনো অ্যাসিডের ঘাটতি হলে শিশুর শরীরে অপুষ্টির লক্ষণ দেখা দেয়, যা ধীরে ধীরে অপুষ্টিজনিত রোগে রূপ নেয় । এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে বুঝব যে শিশুর প্রোটিন চাহিদা কতটুকু?

বয়স, লিঙ্গ ও শারীরিক বৈশিষ্ট্য ভেদে শিশুদের প্রোটিন চাহিদা ভিন্ন হতে পারে। শিশুদের প্রোটিনের দৈনিক চাহিদার আনুপাতিক গড় হার হলো:

৬ মাস পর্যন্ত: শিশুর প্রতি কেজি ওজনের জন্য প্রতিদিন ১.৫২ গ্রাম

৬ মাস থেকে ১ বছর: শিশুর প্রতি কেজি ওজনের জন্য প্রতিদিন ১.২ গ্রাম

১ থেকে ৩ বছর: শিশুর প্রতি কেজি ওজনের জন্য প্রতিদিন ১.১ গ্রাম

৪ থেকে ১২ বছর: শিশুর প্রতি কেজি ওজনের জন্য প্রতিদিন ১ গ্রাম

শিশু যখন দীর্ঘসময় এই প্রোটিন চাহিদা পূরণ করতে পারে না এবং চাহিদা প্রোটিনের বিপরীতে শর্করা জাতীয় খাবারের মাধ্যমে সুষম খাদ্যের ঘাটতি পূরণ করে, তখন শিশুর শরীরে কোয়াশিওরকরের লক্ষণ দেখা দেয়। কোয়াশিওরকরের প্রধান ও প্রাথমিক লক্ষণ হিসাবে শরীরে পানি জমে। সাধারণত পা ও মুখে বেশি পানি জমতে দেখা যায়। আরও ভালোভাবে বললে, শরীরের নরম অংশ যেমন পা, মুখ, হাত ও পেট ফুলে যায়। ফুলে যাওয়া অংশে চাপ দিলে গর্তের মতো দাগ হয়, যাকে ‘পিটিং ইডিমা’ বলে।

আরও পড়ুন
সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করে এবং স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমে শিশুদের এই রোগের ঝুঁকি থেকে বাঁচানো সম্ভব। তারপরেও যদি কোনো শিশুর মধ্যে এ রোগের লক্ষণ দেখা যায়, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

হাইপোঅ্যালবুমিনেমিয়ার কারণে রক্তে অ্যালবুমিন নামে প্রোটিন কমে যায় এবং কোয়াশিওরকর ইডিমা শুরু হয়। অ্যালবুমিন রক্তে পানি ধরে রাখে এবং এর অভাব দেখা দিলে রক্তনালী থেকে তরল বের হয়ে ত্বকের নিচে জমা হয়। এছাড়া ত্বক শুষ্ক ও রুক্ষ হয়ে যায়। অনেক সময় ত্বক লালচে হয়ে ফেটে যেতে পারে।  চুল শুষ্ক ও ভঙ্গুর হতে পারে। চুলের রং বদলে যায় অনেকের। শিশু ক্ষুধামন্দায় ভোগে এবং শারীরিক কার্যক্রমে আগ্রহ হারায়।  

দীর্ঘদিন শিশুর এই রোগ থাকলে মস্তিষ্কের বিকাশে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। ইমিউন সিস্টেমও দুর্বল হয়ে যায়। ফলে শিশুরা সহজেই বিভিন্ন সংক্রমণের শিকার হয়। দীর্ঘস্থায়ী কোয়াশিওরকর শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে।

সময় মতো এ রোগের চিকিৎসা না করলে তা প্রাণঘাতী হতে পারে। তবে এটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। সঠিক পুষ্টি, স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করলে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বাংলাদেশের মতো দেশে দরিদ্র মানুষের জন্য সুষম খাদ্য নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ এবং কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। 

কোয়াশিওরকর প্রতিরোধে এবং শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করতে সরকার ও বিভিন্ন এনজিও বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সমন্বিত পুষ্টি প্রকল্প (BINP) শুরু হয়, যা কমিউনিটি পর্যায়ে পুষ্টি সেবা ও পরামর্শ প্রদান, শিশুর বিকাশ তত্ত্বাবধান এবং অপুষ্টির শিকার শিশু ও মায়েদের বাড়তি খাবার সরবরাহের মাধ্যমে লাখ লাখ পরিবারকে সহায়তা করেছে।

সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করে এবং স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমে শিশুদের এই রোগের ঝুঁকি থেকে বাঁচানো সম্ভব। তারপরেও যদি কোনো শিশুর মধ্যে এ রোগের লক্ষণ দেখা যায়, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

লেখক: শিক্ষার্থী, চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল রিলেশনশিপ ডিপার্টমেন্ট, গভমেন্ট কলেজ অফ অ্যাপ্লাইড হিউমান সায়েন্স।

সূত্র: ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন, যুক্তরাষ্ট্র ও অক্সফোর্ড একাডেমি