ব্রাজিলের বেলেমে শুরু হয়েছে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন, কী হচ্ছে এবার

২০২৫ সালে অনুষ্ঠিত বেলেম জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মিলনমেলা।ছবি: রয়টার্স

আমাজন বনের মধ্যে অবস্থিত ব্রাজিলের বেলেম শহর। এই শহরে এবার বসেছে জাতিসংঘের বার্ষিক জলবায়ু সম্মেলন। শহরের চারপাশে ঘন সবুজ রেইন ফরেস্ট। এখানেই শুরু হয়েছে জাতিসংঘের এবারের জলবায়ু সম্মেলন কপ-৩০। প্রতি বছরই সারা বিশ্বে কপ নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়। এ বছরও সম্মেলনের শুরুর দিন থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে কপ। জলবায়ু সচেতন মানুষেরা সম্মেলনের দিকে নজর রাখছেন।

এবারের সম্মেলন দুটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। রয়টার্সের মতে, এই সম্মেলনে দেখা হবে অতীতের প্রতিশ্রুতি কতটা পূরণ হলো। দ্বিতীয় কারণ হলো, ভবিষ্যতে দেশগুলোর দায় কী হবে, তা নিয়েও আলোচনা চলবে।

কপ শব্দটির পূর্ণরূপ কনফারেন্স অব দ্য পার্টিস। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঐতিহাসিক রিও আর্থ সামিট। সেখানে যে জলবায়ু চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল, তার ধারাবাহিকতা হচ্ছে এই কপ। দেশগুলো তখন মেনে নিয়েছিল, জলবায়ু পরিবর্তন এমন এক বিপদ, যা সবাইকে একসঙ্গে মোকাবেলা করতে হবে। সেই চুক্তিতে ছিল গুরুত্বপূর্ণ নীতি ‘কমন বাট ডিফারেনশিয়েটেড রেসপন্সিবিলিটিস’। মানে ধনী দেশগুলো, যাদের কারণে বেশি কার্বন নিঃসরণ হয়, পৃথিবীকে বাঁচাতে তাদেরকে বড় দায়িত্ব নিতে হবে।

২০২৫ সালে আবারও কপ আয়োজনের সভাপতিত্ব করছে ব্রাজিল। ১০ নভেম্বর শুরু হয়েছে কপ-৩০। এ বছর শুরু থেকেই অংশীদারদের মধ্যে আলোচনা চলেছে। কূটনীতিবিদেরা আলোচনা করেছেন। আগের প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করার চেষ্টা করেছে দেশগুলো। সবকিছু এ বছরের মতো শেষ করতে শুরু হয়েছে এবারের আয়োজন।

আরও পড়ুন
কপ শব্দটির পূর্ণরূপ কনফারেন্স অব দ্য পার্টিস। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঐতিহাসিক রিও আর্থ সামিট। সেখানে যে জলবায়ু চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল, তার ধারাবাহিকতা হচ্ছে এই কপ।

এই সম্মেলনটি বিশেষ হওয়ার কারণ, প্রথমবারের মতো ব্রাজিল জোর দিয়ে বলছে, নতুন প্রতিশ্রুতির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পুরোনো প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করা। কপ-২৮-এ করা প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবে কীভাবে কার্যকর হবে, সেই উত্তর এবার জানতে চাওয়ায় গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে এবারের সম্মেলনে। এর মধ্যে আছে, ধীরে ধীরে জীবাশ্ম জ্বালানি বাদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। এ বিষয়ে অগ্রগতি জানার চেষ্টা করা হবে এবারের সম্মেলনে।

বেলেমে কপ৩০ জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনে হ্যাঙ্গার কনভেনশন সেন্টারের বাইরে মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ছবি: ফার্নান্দো ল্লানো

এই সম্মেলনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হলো, কপ-৩০ প্রথমবার স্বীকার করল, বিশ্ব তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার লক্ষ্য আমরা পূরণ করতে পারিনি। এই স্বীকারোক্তি দেওয়াটা কঠিন। কিন্তু ভবিষ্যতের লক্ষ্যে এগোনোর জন্য প্রয়োজনীয়।

ব্রাজিল কপ আয়োজনের জন্য বেছে নিয়েছে আমাজনের বেলেম শহরকে। এটি বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং হুমকিতে থাকা বনভূমির এক প্রতীকী শহর। যেখানে প্রতিদিন গাছ কাটা হচ্ছে, খনির কাজ চলছে। নিয়মিত কৃষিকাজ আর তেল-গ্যাস উত্তোলনের কারণে চাপের মুখে পড়েছে আমাজন বন। এই বনের মধ্যে কপ আয়োজন করে ব্রাজিল বলতে চাইছে ‘বন রক্ষা না করলে কোনো জলবায়ু লক্ষ্যই পূরণ হবে না।’ এ কারণে এবার আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরাও যুক্ত হচ্ছেন মূল আলোচনায়।

আরও পড়ুন
নিয়মিত কৃষিকাজ আর তেল-গ্যাস উত্তোলনের কারণে চাপের মুখে পড়েছে আমাজন বন। এই বনের মধ্যে কপ আয়োজন করে ব্রাজিল বলতে চাইছে ‘বন রক্ষা না করলে কোনো জলবায়ু লক্ষ্যই পূরণ হবে না।’

কপ সম্মেলনে প্রায় সব দেশই প্রতিনিধি দল পাঠায়। দেশগুলো সাধারণত নিজেদের স্বার্থ মিললে গ্রুপ তৈরি করে। ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর জোট এওএসআইএস (AOSIS)। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে দেশগুলো অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। এখানে আরেক গ্রুপ অব ৭৭ + চীন ব্লক (G77+China)। আরেকটি হলো বেসিক (BASIC) গ্রুপ (ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, চীন মিলে)। উন্নয়নশীল বিশ্বের দাবিগুলোকে শক্তিশালি করে এই দল। অন্যদিকে আছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি পারিস চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আগে তারা কপে নেতৃত্ব দিত। এখন জায়গাটা অনেকটাই ফাঁকা হয়ে আছে। সেই জায়গা পূরণ করছে চীন, ব্রাজিল এবং অন্য দেশগুলো।

বেলেমে কপ৩০ পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের উদ্বোধনে অ্যারায়েল ডো পাভুলাগেম গ্রুপের শিল্পীরা পারফর্ম করছেন।
ছবি: রয়টার্স

কপ সাধারণত দুই সপ্তাহ ধরে চলে। প্রথম সপ্তাহে সবাই নিজেদের অবস্থান জানায়। কে কী চায় তা স্পষ্ট করে। কোম্পানি থেকে শুরু করে সামাজিক সংগঠন, সবাই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আর বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়। কিন্তু দ্বিতীয় সপ্তাহে আলোচনায় দরকষাকষি বাড়ে। দেশগুলোর মন্ত্রীপর্যায়ের প্রতিনিধিরা চুক্তির ভাষা ঠিক করেন। প্রতিটি শব্দ নিয়ে চলে দরকষাকষি, আলোচনা। দর কষাকষি শেষ হয় না বলে অনেক সময় কপ শেষ করতেই দেরি হয়। 

আরও পড়ুন
কপ সম্মেলনে প্রায় সব দেশই প্রতিনিধি দল পাঠায়।ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর জোট এওএসআইএস।এখানে আরেক গ্রুপ অব ৭৭ + চীন ব্লক। আরেকটি হলো বেসিক গ্রুপ।

এসবের তুলনায় ২০২৫ সাল একটু আলাদা। সাধারণত কপে মূল আয়োজনের বাইরে অনেক বেশি পার্শ্ব আয়োজন থাকে। এবার সংখ্যাটা অনেকটা কম। কারণ জলবায়ুতে বিনিয়োগকারীরা গিয়েছেন সাও পাওলোতে। স্থানীয় নেতাদের আলাদা বৈঠক হয়েছে রিওতে। বিশ্বনেতারা এক বিশেষ আগাম বৈঠক করেছেন বেলেমে। এসব কিছু মিলে জমেছে কপ-৩০।

প্রতিবছরই পরিবেশ রক্ষার দাবিতে কপে মিছিল হয়। কোম্পানিগুলোর লবিং, বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা, কূটনীতিবিদদের ছোটাছুটি চলে। এর মধ্যেই জলবায়ু সচেতন কর্মী ও ব্যক্তিরা উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করেন, সত্যিই কি এখনও পৃথিবীকে বাঁচানোর আশা থাকছে?

এবার ব্রাজিল, জাতিসংঘ, বিজ্ঞানী, আদিবাসী প্রতিনিধি, ছোট দ্বীপ রাষ্ট্র, উন্নয়নশীল দেশের ব্লক, সবার স্বার্থ বেলেমের এই কপে একসঙ্গে যুক্ত হয়েছে। কপ-৩০ কে তাই শুধু আরেকটি সম্মেলন হিসেবে ধরা যাচ্ছে না, এটিকে দেখা হচ্ছে জলবায়ু সুরক্ষার আরেকটি সুযোগ হিসেবে।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, কিশোর আলো

সূত্র: রয়টার্স

আরও পড়ুন