পরিত্যক্ত প্লাস্টিক বোতল থেকে প্যারাসিটামল তৈরি করবে ব্যাকটেরিয়া

পরিত্যক্ত প্লাস্টিক বোতল থেকে প্যারাসিটামল তৈরি করবে ব্যাকটেরিয়ামিডজার্নির সাহায্যে তৈরি

প্রতিদিন আমরা যেসব প্লাস্টিকের জিনিস একবার ব্যবহার করে ফেলে দিই, সেগুলো জমে জমে ভয়াবহ সমস্যা তৈরি হয়। এই প্লাস্টিকের বর্জ্য এখন সারা বিশ্বের পরিবেশবিদদের জন্য একটা বড় দুচিন্তার কারণ। তবে এ সমস্যা কমানোর নতুন পথ দেখিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা দারুণ এক গবেষণায় সফল হয়েছেন। এ গবেষণায় দেখা গেছে, প্লাস্টিকের গায়ে একটু সামান্য পরিবর্তন আনলেই, সেটা ব্যবহার করা যাবে ওষুধ বানাতে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এ কাজে সাহায্য করবে একধরনের ব্যাকটেরিয়া। এই গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়েছে নেচার কেমিস্ট্রি জার্নালে। ভবিষ্যতে এই পদ্ধতি সত্যিই ব্যবহার করা যায় কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, তাঁরা বিশেষভাবে তৈরি (জিনগতভাবে পরিবর্তিত) ই. কোলাই (Escherichia coli) নামে একধরনের ব্যাকটেরিয়ার সাহায্যে প্লাস্টিক ভাঙার চমকপ্রদ এক কৌশল বের করেছেন। পুরোনো প্লাস্টিক বোতলের ওপর এই প্রক্রিয়া ব্যবহার করেছেন বিজ্ঞানীরা। গবেষণায় দেখা গেছে, ই. কোলাই সেই প্লাস্টিককে ভেঙে এমন এক পদার্থে রূপান্তর করতে পেরেছে, যা দিয়ে বানানো যায় টাইলনল বা প্যানাডলের মতো ব্যথানাশক ওষুধ। এই নতুন পদ্ধতি দুদিক থেকে কাজে আসতে পারে। প্রথমত, এতে প্লাস্টিক দূষণ কমানো সম্ভব। দ্বিতীয়ত, ওষুধ তৈরির জন্য আমরা যে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভর করি, সেই নির্ভরতা অনেকটাই কমে যাবে। এই আবিষ্কার ভবিষ্যতে ওষুধ শিল্প ও পরিবেশ রক্ষায় বড় সম্ভাবনার দরজা খুলে দিতে পারে।

স্কটল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব এডিনবরার বিজ্ঞানী স্টিফেন ওয়ালেস বলেন, ‘আমি সত্যিই বিশ্বাস করি, এই গবেষণা প্লাস্টিক বর্জ্যকে কাজে লাগাতে পারবে।’

আরও পড়ুন
প্রথমেই বিজ্ঞানীরা ওষুধ বানানোর দিকে যাননি। তাঁরা চেয়েছেন আগে একটা পরীক্ষা করে দেখতে যে ই. কোলাই ব্যাকটেরিয়া প্লাস্টিক থেকে প্যারা-অ্যামিনোবেনজোয়িক অ্যাসিড নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ অণু তৈরি করতে পারে কিনা।

প্লাস্টিক মাটির নিচে শতশত বছরটিকে থাকে, কিন্তু পচে না। অনেক দিন ধরেই মানুষ জানে, প্লাস্টিক বর্জ্য শুধু জমে নয়, ধীরে ধীরে মাটিকেও নষ্ট করে। এই দূষণের ক্ষতিকর উপাদান একসময় মাটির ভেতর ঢুকে গাছপালায় চলে যায়। সেখান থেকে আবার পশু-পাখির খাবারেও মিশে যেতে পারে। ফলে পরিবেশের জন্য এটা ভয়ানক বিপদ। তাই এই নতুন গবেষণা যদি সত্যিই কাজে লাগে, তাহলে তা শুধু প্লাস্টিকের ব্যবহার নয়, তার পরিণতিও বদলে দিতে পারে।

তবে প্রথমেই বিজ্ঞানীরা ওষুধ বানানোর দিকে যাননি। তাঁরা চেয়েছেন আগে একটা পরীক্ষা করে দেখতে যে ই. কোলাই ব্যাকটেরিয়া প্লাস্টিক থেকে প্যারা-অ্যামিনোবেনজোয়িক অ্যাসিড বা সংক্ষেপে পাবা (PABA) নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ অণু তৈরি করতে পারে কিনা। পাবা হলো এক ধরনের জৈব অণু, যা সরাসরি না হলেও মানবদেহে ভিটামিন ফলিক অ্যাসিড তৈরিতে সাহায্য করে। তাই পাবাকে ফলিক অ্যাসিড তৈরির একটি কাঁচামাল বলা যায়।

প্রতিনিয়ত বাড়ছে প্লাস্টিকের সংখ্যা
মিডজার্নির সাহায্যে তৈরি

তবে এই রাসায়নিক তৈরির জন্য দরকার ছিল এক বিশেষ বিক্রিয়া। লসেন রিঅ্যারেঞ্জমেন্ট নামে একটি জটিল প্রক্রিয়া, যাতে নাইট্রোজেনযুক্ত কোনো অণুর গঠন বদলে পাবা তৈরি হয়। এই জটিল প্রক্রিয়াটি সহজ করতে বিজ্ঞানীরা ই. কোলাইয়ের জিন এমনভাবে পরিবর্তন করেন, যাতে ব্যাকটেরিয়াটি আগের মতো নিজের চেনা পথে পাবা বানাতে না পারে। ফলে বেঁচে থাকার জন্য ব্যাকটেরিয়া নতুন পথ খুঁজে নেয়। তখন বিজ্ঞানীরা তার মধ্যে এমন একটি রাসায়নিক যৌগ ঢুকিয়ে দেন, যা শুধু লসেন রিঅ্যারেঞ্জমেন্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই পাবাতে রূপান্তরিত হতে পারে।

সবচেয়ে দারুণ ব্যাপার হলো, এই প্রক্রিয়ার পরেও ব্যাকটেরিয়া দিব্যি বেঁচে থাকে! মানে, ব্যাকটেরিয়া নিজের ভেতরেই প্লাস্টিকের অংশ ভেঙে তৈরি করেছে ওষুধের মূল উপাদান।

আরও পড়ুন
পরিবর্তিত ই. কোলাই ব্যাকটেরিয়া একটি নির্দিষ্ট যৌগ থেকে মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় ৯২ শতাংশ রূপান্তর ঘটিয়ে অ্যাসিটামিনোফেন তৈরি করতে সক্ষম হয়।

পরের ধাপে গবেষকরা প্লাস্টিক থেকে একই ধরনের প্রাথমিক যৌগ বা স্টার্টিং কম্পাউন্ড তৈরি করেন। পলিইথিলিন টেরেফথ্যালেটকে (পিইটি) রাসায়নিকভাবে ভেঙে ছোট ছোট অংশে পরিণত করা হয়। একে বলা হয় কেমিক্যাল ব্রেকডাউন। এই ভাঙনে এক ধরনের বিশেষ যৌগ তৈরি হয়, যা ব্যাকটেরিয়ার জন্য খাবার হিসেবে নয় বরং কাঁচামাল হিসেবে কাজ করে। এরপর সেই যৌগ বিজ্ঞানীরা ই.কোলাই ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে দিয়ে দেন। এবারও ই.কোলাই ব্যাকটেরিয়া সেই প্লাস্টিকভিত্তিক যৌগকে পাবাতে রূপান্তর করে ফেলে! বলে রাখা ভালো, পিইটি মূলত বোতল ও প্যাকেজিংয়ে ব্যবহৃত হয়। পাবা থেকে অ্যাসিটামিনোফেন তৈরিতে বিজ্ঞানীরা ব্যাকটেরিয়ার জিনে আরও একটি পরিবর্তন আনেন। পরীক্ষাগারে তা সফল হয়। এমন প্যারাসিটামল মূলত টাইলনল, ক্যালপল এবং প্যানাডলের মতো ওষুধে ব্যবহৃত হয়। এই ওষুধ বহুল ব্যবহৃত হয় ব্যথা ও জ্বর উপশমে।

এ পর্যায়ে দেখা যায়, পরিবর্তিত ই. কোলাই ব্যাকটেরিয়া একটি নির্দিষ্ট যৌগ থেকে মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় ৯২ শতাংশ রূপান্তর ঘটিয়ে অ্যাসিটামিনোফেন তৈরি করতে সক্ষম হয়। বর্তমানে এই অ্যাসিটামিনোফেন তৈরি হয় জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে। তাই ভবিষ্যতে একটি টেকসই বিকল্প হতে পারে বলে বিজ্ঞানীদের আশা। তবে এখনই এটি বড় পরিসরের জন্য উপযুক্ত নয়। আরও অপেক্ষা করতে হবে।

সূত্র: নেচার কেমিস্ট্রি, গার্ডিয়ান, সায়েন্স নিউজ

লেখক: শিক্ষার্থী, রসায়ন বিভাগ, ঢাকা কলেজ

আরও পড়ুন