একটি সামুদ্রিক কচ্ছপের মৃত্যুর জন্য কতটা প্লাস্টিক দায়ী; গবেষণায় মিলল ভয়ংকর তথ্য
একটা সামুদ্রিক কচ্ছপের মৃত্যুর জন্য কতটুকু প্লাস্টিক যথেষ্ট?
উত্তর হলো মাত্র দুটি ক্রিকেট বলের সমান প্লাস্টিক! আর একটা পাফিন পাখির মৃত্যুর জন্য মাত্র তিন টুকরো চিনির কিউবের সমান প্লাস্টিকই যথেষ্ট। ছোট ডলফিনজাতীয় প্রাণী একটা ফুটবল সাইজের প্লাস্টিকের কারণে মারা যেতে পারে!
এই সংখ্যাগুলো প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেসে প্রকাশিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ঠিক এতটুকু প্লাস্টিক পেটে গেলেই এই প্রাণীগুলোর মৃত্যুর সম্ভাবনা ৯০ শতাংশ!
এগুলো কিন্তু গবেষকদের মনগড়া কথা নয়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ৫৩টি গবেষণা থেকে ১০ হাজারের বেশি মৃত সামুদ্রিক পাখি, কচ্ছপ এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীর ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বিশ্লেষণ করেছেন তাঁরা।
তবে একটা বিষয় খেয়াল রাখবেন, এই গবেষণায় শুধু সেসব প্রাণীর হিসাব করা হয়েছে, যেগুলো প্লাস্টিক গিলে বা খেয়ে মারা গেছে। যেসব প্রাণী জালে আটকে মরেছে কিংবা মাইক্রোপ্লাস্টিক খেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলোকে এই তালিকায় রাখা হয়নি।
ওশান কনজারভেন্সির বিজ্ঞানী এবং এই গবেষণার প্রধান এরিন মারফি বলছেন, ‘প্লাস্টিকের এই প্রাণঘাতী পরিমাণটা আমাদের ধারণার চেয়েও অনেক কম। আমরা জানতাম, প্লাস্টিক ক্ষতিকর, কিন্তু তা কতটা মারণাস্ত্র হয়ে উঠেছে, তা এতদিন নির্দিষ্ট করে জানা ছিল না।’
এখন প্রশ্ন হলো প্লাস্টিকের জন্য ভুক্তভোগী কারা? গবেষণায় দেখা গেছে, ৫৭ প্রজাতির সামুদ্রিক পাখি, ৩১ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং ৭ প্রজাতির কচ্ছপ এর শিকার। সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হলো, এই তালিকায় থাকা প্রায় অর্ধেক প্রাণীই বিপন্ন বা মহাবিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত।
ওশান কনজারভেন্সির বিজ্ঞানী এবং এই গবেষণার প্রধান এরিন মারফি বলছেন, ‘প্লাস্টিকের এই প্রাণঘাতী পরিমাণটা আমাদের ধারণার চেয়েও অনেক কম।'
সমুদ্রবিজ্ঞানী কারা ল্যাভেন্ডার ল-এর মতে, ‘আমরা ইদানীং মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়ে এত বেশি কথা বলছি যে বড় প্লাস্টিকগুলোও যে সামুদ্রিক প্রাণীদের মেরে ফেলছে, সেটা ভুলতে বসেছি। এই গবেষণা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে বড় প্লাস্টিকগুলোও সমানভাবে ভয়ংকর।’
বিশ্বজুড়ে প্লাস্টিক কমানোর চুক্তিগুলো বারবার আটকে যাচ্ছে। কানাডায় প্লাস্টিককে বিষাক্ত ঘোষণা করে নিষিদ্ধ করার চেষ্টার পর বড় কোম্পানিগুলো মামলা ঠুকে দিয়েছে। সমস্যাটা কোথায় জানেন? টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোলজিস্ট এবং এই স্টাডির লেখক চেলসি এম. রচম্যান বলছেন, ‘সমস্যা হলো তথ্যের অভাব। আর্সেনিক বা সিসার মতো বিষের ক্ষেত্রে আমরা জানি, ঠিক কতটুকু শরীরের জন্য ক্ষতিকর; কিন্তু প্লাস্টিকের ক্ষেত্রে সেই হিসাবটা এতদিন নীতিনির্ধারকদের জানা ছিল না।’
কোন প্রাণীর জন্য কোন প্লাস্টিক ক্ষতিকর, তা উঠে এসেছে ওই গবেষণায়। যেমন, সামুদ্রিক পাখির পেটে পাওয়া গেছে শক্ত প্লাস্টিক বা বোতলের টুকরো। সিনথেটিক রবার তো আরও মারাত্মক। মটরশুঁটির চেয়েও ছোট এই রবারের মাত্র ছয়টি টুকরো পেটে গেলেই পাখির বাঁচার আশা মাত্র ১০ শতাংশে নেমে আসে।
কচ্ছপ ধোঁকা খায় নরম প্লাস্টিক বা পলিথিন দেখে। সাগরে ভাসমান পলিথিনকে এরা জেলিফিশ মনে করে খেয়ে ফেলে। অর্ধেকের বেশি কচ্ছপের পেটে এমন নরম প্লাস্টিকই পাওয়া গেছে।
আর তিমির পেটে পাওয়া গেছে মাছ ধরার জালের অংশ বা দড়ি। সবচেয়ে দুঃখজনক তথ্য হলো, প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে বাচ্চা প্রাণীগুলোই বেশি প্লাস্টিক খাচ্ছে। কারণ এরা শিকার চিনতে ভুল করে।
মটরশুঁটির চেয়েও ছোট এই সিনথেটিক রবারের মাত্র ছয়টি টুকরো পেটে গেলেই পাখির বাঁচার আশা মাত্র ১০ শতাংশে নেমে আসে।
প্লাস্টিকের কারণে প্রাণীর মৃত্যু হয় কীভাবে? শক্ত প্লাস্টিক তাদের নাড়িভুঁড়ি ফুটো করে দেয় বা ছিঁড়ে ফেলে। আবার অনেক সময় প্লাস্টিক জমে খাদ্যনালি বন্ধ করে দেয়। আর যদি এসব নাও হয়, পেটভর্তি প্লাস্টিক থাকায় তারা আর আসল খাবার খেতে পারে না। ফলে পুষ্টির অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মারা যায়। বিজ্ঞানীরা একে বলেন ফুড ডিলিউশন ইফেক্ট।
প্রতিবছর সাগরে ১ কোটি ১০ লাখ টন প্লাস্টিক যাচ্ছে। রচম্যান এখন বের করতে চান, সৈকতে পড়ে থাকা প্লাস্টিকের পরিমাণের সঙ্গে প্রাণীদের প্লাস্টিক খাওয়ার হারের সম্পর্কটা ঠিক কতটা। তবে আশার আলোও আছে। চলতি বছর জুন মাসে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব এলাকায় প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেখানকার সৈকতে আবর্জনা বা প্লাস্টিক অনেক কম পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, সচেতনতা এবং সঠিক আইনই পারে এই অবলা প্রাণীগুলোকে বাঁচাতে!