গবেষণা
ক্যানসার গবেষণায় বাংলাদেশি গবেষকের নতুন গাণিতিক মডেল, ক্যানসার প্রতিরোধে দেখাচ্ছে আশার আলো
শুরুর গল্প
সৌমিত্র চক্রবর্তী তখন তৎকালীন বিএসএমএমইউতে (বর্তমানে বিএমইউ) সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। মেডিকেল স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেওয়ার জন্য পাঠ্যবইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছিলেন। উদ্দেশ্য, ক্যানসার সৃষ্টিতে মিউটেশনের ভূমিকা একটু ঝালিয়ে নেওয়া। সেখানে ক্নুডসনের একটি বিখ্যাত হাইপোথিসিস রয়েছে। তিনি রেটিনোব্লাস্টোমা নামে চোখের একটি ক্যানসারে আক্রান্ত শিশুদের কোন বয়সে কতজনের ক্ষেত্রে রোগটি ধরা পড়েছে, স্রেফ সেই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে গাণিতিকভাবে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, ওই ক্যানসার হতে গেলে দুটি মিউটেশন ঘটা আবশ্যক। পাঠ্যবইয়ে এর বেশি লেখা নেই। সৌমিত্র চক্রবর্তী ছাত্রাবস্থায় নিজেও কথাটা পড়েছেন, কিন্তু মাথায় কোনো প্রশ্ন জাগেনি। সেদিন হঠাৎ প্রশ্ন জাগল, ক্নুডসন কীভাবে ওই সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন। তাঁর এ গাণিতিক পূর্বাভাসের বেশ কিছু বছর পর, অন্য এক গবেষণায় সেই দুটি মিউটেশন খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে দেখা যায়, আসলেই সেই দুটি মিউটেশন ছাড়া রেটিনোব্লাস্টোমা হতে পারে না। কিন্তু ক্নুডসন তো এই গবেষণার আগেই পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। তিনি এটা বুঝলেন কীভাবে?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ক্নুডসনের মূল গবেষণাপত্রটি পড়েন সৌমিত্র চক্রবর্তী। সেখানেও সব প্রশ্নের উত্তর নেই। এ বিষয়ক অনেকগুলো গবেষণা পড়লেন তিনি। কিন্তু কেন যেন একটা সময়ের পর বিজ্ঞানীরা আর এই পদ্ধতি নিয়ে বিশেষ কোনো গবেষণা করেননি। ক্যানসার গবেষণার নিত্যনতুন কায়দার আড়ালে এই ধ্রুপদী ধারণাটি হারিয়ে গেছে। কিন্তু এর উপযোগিতা যে শেষ হয়ে যায়নি, তা ঠিকই বোঝা যায়।
পাঁচটি মহাদেশের ১২৪টি জনসমষ্টিতে পরিচালিত ১০৮টি ক্যানসার রেজিস্ট্রিতে নথিভুক্ত প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ (১,৪০,৬৭,৮৯৪) রোগীর উপাত্ত নিয়মানুযায়ী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসার মারফত গ্লোবাল ক্যানসার অবজার্ভেটরি (সংক্ষেপে GLOBOCAN) থেকে সংগ্রহ করা হলো। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজ অনুসারে, প্রায় হাজার প্রকারের ক্যানসার রয়েছে। সংগৃহীত তথ্য মোতাবেক, সেগুলোকে মোট ২১টি প্রধান ক্যাটাগরিতে ভাগ করা গেল
বয়সভিত্তিক নতুন ক্যানসার রোগীর সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে রেট-লিমিটিং ইভেন্টের (ক্যানসারের জন্য আবশ্যক মিউটেশন, এপিজেনেটিক পরিবর্তন এবং টিউমার যেখানে বেড়ে উঠতে পারে, সেই টিস্যুর পরিবেশ বা মাইক্রোএনভায়রনমেন্ট সংক্রান্ত গোলযোগ) সংখ্যার পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য এমন একটা গাণিতিক মডেল সম্ভবত নির্মাণ করা সম্ভব, যেটা আধুনিক মলিকুলার বায়োলজির আলোকে সব ধরনের ক্যানসারের ক্ষেত্রেই কাজ করতে পারে।
কিন্তু একার পক্ষে এ কাজ করা খুব কঠিন। তারপরও দমে না গিয়ে তিনি তাত্ত্বিক পূর্বাভাসমূলক একটি গাণিতিক মডেল দাঁড় করালেন। সেই মডেল কাজ করে কি না বা সেটায় কী সংশোধন বা পরিমার্জন প্রয়োজন, তা জানতে হলে ক্যানসার রোগীর উপাত্ত দরকার। ১০০-২০০ বা হাজার নয়, দরকার লাখো-কোটি মানুষের উপাত্ত। এ কাজে পাশে দাঁড়ালেন বুয়েটে অধ্যয়নরত খন্দকার আফতারুল ইসলাম এবং তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের পার্ডু বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর অধ্যয়নরত) শাহ ইশমাম মোহতাসিম। তাঁরা বাংলাদেশ জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের প্রথম দিককার অংশগ্রহণকারী হিসেবে আগে থেকে সৌমিত্র চক্রবর্তীর সঙ্গে পরিচিত। তাঁদের সহযোগিতায় পাঁচটি মহাদেশের ১২৪টি জনসমষ্টিতে পরিচালিত ১০৮টি ক্যানসার রেজিস্ট্রিতে নথিভুক্ত প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ (১,৪০,৬৭,৮৯৪) রোগীর উপাত্ত নিয়মানুযায়ী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসার মারফত গ্লোবাল ক্যানসার অবজার্ভেটরি (সংক্ষেপে GLOBOCAN) থেকে সংগ্রহ করা হলো। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজ অনুসারে, প্রায় হাজার প্রকারের ক্যানসার রয়েছে। সংগৃহীত তথ্য মোতাবেক, সেগুলোকে মোট ২১টি প্রধান ক্যাটাগরিতে ভাগ করা গেল।
তারপর পাঁচ বছরের বেশি সময়ের প্রচেষ্টায় বিশ্বের অন্যতম সেরা বৈজ্ঞানিক জার্নালের একটিতে প্রকাশিত হয় সৌমিত্র চক্রবর্তীর এই গবেষণা। চলতি বছর ২৮ জুলাই প্লস ওয়ান (PLoS One) জার্নালে এটি প্রকাশিত হয়। জার্নালটি যুক্তরাষ্ট্রের পাবলিক লাইব্রেরি অব সায়েন্স থেকে প্রকাশিত হয়।
এই জার্নালে প্রকাশের জন্য গবেষণাটি প্রায় তিন মাস ধরে পিয়ার রিভিউয়ের মধ্য দিয়ে গেছে। একই বিষয়ে অভিজ্ঞ বিজ্ঞানীদের আতশকাচের নিচে পাণ্ডুলিপিটি কাটাছেঁড়া হয়েছে, তাঁরা গবেষক দলকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করেছেন এবং সন্তোষজনক জবাব পেয়েছেন। তারপর ওই জার্নালের সম্পাদক গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করার অনুমতি দিয়েছেন।১
গবেষণার মূল ভাবনা ও উদ্দেশ্য
ক্যানসার একটি জটিল রোগ, যা গঠিত হয় বহু ধাপে—জিনগত পরিবর্তন, পরিবেশগত প্রভাব এবং বয়সজনিত কারণে। দীর্ঘদিন ধরেই বিজ্ঞানীরা ক্যানসার সংক্রান্ত দুটি ভিন্ন ধরনের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে গবেষণা চালিয়ে আসছেন।
১. জনসংখ্যাগত বা মহামারিবিদ্যাগত (Epidemiological) তথ্য: বয়স অনুযায়ী (এইজ-স্পেসিফিক) নতুন করে ধরা পড়া ক্যানসার রোগীর হার (ইনসিডেন্স)।
২. অণু-জৈবিক (Molecular) তথ্য: ক্যানসার সৃষ্টিকারী নির্দিষ্ট পরিবর্তন (মিউটেশন, এপিমিউটেশন, এবং ক্যানসার মাইক্রোএনভায়রনমেন্ট মডিফিকেশন)।
এই দুটি ডেটাসেট আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করা হলেও এখন পর্যন্ত এমন কোনো একক ও পূর্ণাঙ্গ গাণিতিক মডেল ছিল না, যা একসঙ্গে এই দুই স্তরের তথ্য, অর্থাৎ জনসংখ্যা ও কোষীয় স্তর, সমন্বিতভাবে বিশ্লেষণ করতে পারে। এই গবেষণার মূল লক্ষ্যই ছিল সেই ফাঁকটি পূরণ করা।
গবেষণার পদ্ধতি ও ফলাফল
নারী ও পুরুষদের মধ্যে বয়স অনুযায়ী নতুনভাবে নির্ণীত ক্যানসারের হার প্রতি ১ লাখ ব্যক্তিতে কত, তা চিত্র ১-এ উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। এ গবেষণায় সব প্রকারের ক্যানসারকে ২১টি মূল ক্যাটাগরিতে ফেলে, প্রতিটির ক্ষেত্রে বৈশ্বিকভাবে নারী ও পুরুষদের মধ্যে একত্রে ও পৃথকভাবে বয়স অনুসারে ‘ইনসিডেন্স রেট’ ব্যবহার করা হয়েছে।
ক্যানসার সৃষ্টির জন্য সাধারণত নির্দিষ্ট সংখ্যক ধাপে কোষে জিনগত ও অন্যান্য পরিবর্তন হয় (চিত্র ২)। এ গবেষণায় দেখা গেছে, সেই পরিবর্তনগুলোর সংখ্যা দুই-চারটি ব্যতিক্রম ছাড়া ৩–৪ টিতে সীমাবদ্ধ এবং তাদের সময়নির্ভর গতিশীলতা নির্ধারণ করে কোন বয়সে কোন ধরনের ক্যানসার দেখা দেবে। সেই ব্যতিক্রমগুলোর কারণও এতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ:
মূত্রথলির ক্যানসারের জন্য ৩ থেকে ৪ টি প্রধান জিন পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় (যেমন: FGFR3, RAS, TP53 ইত্যাদি)।
কলোরেক্টাল বা বৃহদান্ত্রের ক্যানসারের মতো কিছু রোগে ১০টি পরিবর্তনের সম্ভাবনা থাকলেও কেবল ৩টি প্রধান পরিবর্তনেই অনেক সময় ক্যানসার শুরু হয়।
কিছু ক্যানসার (যেমন: হজকিন লিম্ফোমা, লিউকেমিয়া) বয়সের সঙ্গে দ্রুত বাড়ে—এই বয়সভিত্তিক পরিবর্তন গবেষকেরা তাদের কনকেভ মডেলে বুঝিয়েছেন।
গবেষকরা এমন একটি গাণিতিক কাঠামো তৈরি করেছেন, যা—
ক্যানসার সৃষ্টির ধাপে ধাপে পরিবর্তনগুলো (যেমন: জিন মিউটেশন) হিসাবে নেয়।
কেবল পরিসংখ্যানগত ফিটিং না করে, এর প্রতিটি ধাপের জৈবিক ব্যাখ্যা দেয়।
বয়স অনুযায়ী ক্যানসার হারের সঙ্গে সেই ধাপগুলোর সম্পর্ক নির্ধারণ করে।
এই কাঠামো তিন ধরনের মডেল তৈরি করেছে। এক, লিনিয়ার বা রৈখিক লগ-লগ মডেল, দুই, কনভেক্স আপওয়ার্ডস বা ঊর্ধ্বমুখী বক্রতা মডেল এবং তিন, কনকেভ আপওয়ার্ডস বা নিম্নমুখী বক্রতা মডেল। বিষয়গুলো ছোট করে ব্যাখ্যা করা যাক।
১. লিনিয়ার বা রৈখিক লগ-লগ মডেল: এই মডেলে ক্যানসারের হার বয়সের লগারিদম অনুযায়ী সরলরেখায় বৃদ্ধি পায়। এটি মূলত প্রস্তাব করে যে গড়পড়তা ৩–৪ টি রেট-লিমিটিং ইভেন্ট (যেমন: মিউটেশন) হলেই ক্যানসার শুরু হতে পারে (চিত্র ৩, বাঁয়ে)।
২. কনভেক্স আপওয়ার্ডস বা ঊর্ধ্বমুখী বক্রতা মডেল: এতে বয়স বাড়ার সঙ্গে ক্যানসারের হার ধীরগতিতে বাড়ে (চিত্র ৩, মাঝে)।
৩. কনকেভ আপওয়ার্ডস বা নিম্নমুখী বক্রতা মডেল: এতে বয়স বাড়ার সঙ্গে হার দ্রুত বাড়ে (চিত্র ৩, ডানে)।
কেন এটা গুরুত্বপূর্ণ?
এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। আসলে, এই গবেষণা আমাদের তিনটি মূল দিক থেকে সাহায্য করে। এক, এটা আমাদের সতর্কতার পাশাপাশি পূর্বাভাসও দেয়। যদি কোনো নির্দিষ্ট বয়সে কোনো নির্দিষ্ট ক্যানসার বেশি হয়, তাহলে এর জন্য কত ধাপে জিনগত পরিবর্তন লাগে, তা জানা গেলে সময়মতো পরীক্ষা ও চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব হয়। দুই, এটা বেশ নির্ভরযোগ্য। গবেষণার R² মান > ০.৯৮, যা নির্দেশ করে মডেলগুলো বাস্তব ডেটার সঙ্গে চমৎকারভাবে মিলে যায়। আর তিন, শুধু ক্যানসার নয়, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস তথা বাতের মতো রোগের ক্ষেত্রেও একই ধরণের ধাপে ধাপে পরিবর্তনের মডেল প্রয়োগ করা সম্ভব, যা এই গবেষণাকে আরও বিস্তৃত পরিসরে কার্যকর করে তোলে।
অর্থাৎ, এই গবেষণার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো একটা শক্তিশালী গাণিতিক কাঠামো পাওয়া গেল। এই কাঠামো প্রথমবারের মতো ক্যানসার গবেষণার দুই প্রধান স্তর— জনসংখ্যাগত এবং অণু-জৈবিক তথ্য—দুটিকে একত্র করেছে। এর ফলে ভবিষ্যতের গবেষণায় আরও বাস্তবভিত্তিক ও কার্যকর ক্যানসার প্রতিরোধ কৌশল তৈরি করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। একজন বাংলাদেশি বিজ্ঞানীর এমন গবেষণা নিঃসন্দেহে অনুপ্রেরণাদায়ক।