ছোট মাছ কীভাবে বড় মাছকে টেক্কা দিয়ে সমুদ্রে বেঁচে থাকে
ঘুটঘুটে অন্ধকার সমুদ্র। সূর্যের আলো সেখানে প্রায় পৌঁছায় না বললেই চলে। ঠিক সেই সময়েই শুরু হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এক মাইগ্রেশন। প্রতি রাতে যখন আমরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, সমুদ্রের গভীরে তখন চলে এই মাইগ্রেশন বা পরিযায়ন। গভীর পানির অদ্ভুত সব প্রাণী খাবারের খোঁজে ওপরের দিকে উঠে আসে।
আর ঠিক এই সময়টাতেই রিচ কলিন্সের মতো সাহসী ব্ল্যাকওয়াটার ডাইভারেরা ক্যামেরা হাতে নেমে পড়েন সাগরের অতল গহ্বরে। তাঁদের কাজ হলো স্রোতের সঙ্গে ভেসে ভেসে এই জাদুকরি জগতের ছবি তোলা। কিন্তু সম্প্রতি তাদের তোলা কিছু ছবি বিজ্ঞানীদের ভালোই অবাক করেছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, পুঁচকে সব মাছের পোনা এক অদ্ভুত কাণ্ড করছে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি।
আমরা জানি, সমুদ্রের এই খোলা পানিতে ছোট মাছের জীবন খুব কঠিন। যেকোনো সময় বড় মাছ এসে গিলে খেতে পারে। লুকানোর মতো কোনো প্রবাল বা পাথরও সেখানে নেই। তাহলে এই ছোট মাছগুলো বাঁচে কীভাবে?
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত ফটোগ্রাফারদের ছবিতে দেখা গেল, কিছু কিছু মাছের পোনা তাদের মুখের সামনে কিছু একটা ধরে রেখেছে। ভালো করে জুম করে দেখা গেল, ওটা আসলে সি অ্যানিমোনের লার্ভা!
সি অ্যানিমোন হলো জেলিফিশের আত্মীয়। দেখতে সুন্দর ফুলের মতো হলেও এদের আছে বিষাক্ত হুল বা স্টিংগিং সেল। বড় অ্যানিমোনরা সাধারণত সাগরের তলদেশে পাথরের সঙ্গে আটকে থাকে, কিন্তু এদের বাচ্চারা বা লার্ভারা পানিতে ভেসে বেড়ায়। আর এই ভেসে বেড়ানো বিষাক্ত অস্ত্রকেই কাজে লাগাচ্ছে বুদ্ধিমান মাছের পোনারা।
যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সের গবেষক গ্যাব্রিয়েল আফনসো এই অদ্ভুত আচরণের নাম দিয়েছেন ‘পয়জন পিল ডিফেন্স’। ব্যাপারটা হলো, ছোট মাছটি তার শিকারিকে বলছে, ‘চাও তো আমাকে খেয়ে ফেলো, কিন্তু আমাকে গিললে এই বিষাক্ত জিনিসটাও তোমাকে গিলতে হবে!’
‘আমি ভাবতেই পারিনি মাছ আর অ্যানিমোনের মধ্যে এমন অদ্ভুত সম্পর্ক থাকতে পারে।’সাইমন থোরোল্ড, মেরিন বায়োলজিস্ট, উডস হোল ওশানোগ্রাফিক ইনস্টিটিউশন, যুক্তরাষ্ট্র
ভাবুন তো, একটা বড় শিকারি মাছ এসে ওই ছোট মাছটাকে গিলতে গেল। অমনি মাছের মুখে থাকা অ্যানিমোনটি শিকারির গলার ভেতর বিষাক্ত হুল ফুটিয়ে দিল। ব্যস! শিকারি মাছের আর খাওয়া হলো না। সে হয়তো যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে পালাবে। এই সুযোগে পুঁচকে মাছটি প্রাণে বেঁচে যাবে। অর্থাৎ, মাছটি অ্যানিমোনকে ব্যবহার করছে ঢাল বা বডিগার্ড হিসেবে। কখনো তারা অ্যানিমোনের আড়ালে লুকায়, আবার কখনো সেটাকে মুখে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
যুক্তরাষ্ট্রের উডস হোল ওশানোগ্রাফিক ইনস্টিটিউশনের মেরিন বায়োলজিস্ট সাইমন থোরোল্ড এই ছবিগুলো দেখে রীতিমতো অবাক। তিনি বলেন, ‘আমি ভাবতেই পারিনি মাছ আর অ্যানিমোনের মধ্যে এমন অদ্ভুত সম্পর্ক থাকতে পারে।’
এতদিন বিজ্ঞানীরা মাছের পোনা নিয়ে গবেষণা করতেন জাল দিয়ে মাছ ধরে। কিন্তু জালের টানে এই নরম পোনাগুলো আর তাদের সঙ্গী অ্যানিমোনরা আলাদা হয়ে যেত, অনেক সময় মারাও যেত। ফলে তাদের এই গোপন বন্ধুত্বের কথা কেউ জানতেই পারত না।
কিন্তু রাতের অন্ধকারে তোলা এই ছবিগুলো এখন গেম চেঞ্জার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞানীরা এখন বুঝতে পারছেন, জারে বন্দি মরা মাছ আর সাগরের জীবন্ত মাছের আচরণের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রির কিউরেটর ক্যারোল বাল্ডউইন একটা দারুণ উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সমুদ্রের মাছের লার্ভা বা পোনা ওদের বড় অবস্থার চেয়ে এতটাই আলাদা যে, এটাকে শুঁয়োপোকা আর প্রজাপতির পার্থক্যের সঙ্গে তুলনা করা যায়।’
শুঁয়োপোকা যেমন প্রজাপতি হওয়ার আগে একরকম থাকে, এই মাছগুলোও বড় হওয়ার আগে একদম অন্যরকম আচরণ করে। আর এই সময়ে টিকে থাকাটাই তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তারা যে অ্যানিমোনের মতো বিষাক্ত প্রাণীকে নিজেদের পকেটে (পড়ুন মুখে) নিয়ে ঘুরে বেড়াবে, তা কে জানত!
রিচ কলিন্সের মতো ফটোগ্রাফাররা এখন আর শখের বশে ছবি তোলেন না, তারা হয়ে উঠেছেন বিজ্ঞানের অংশীদার। তাদের লেন্সে ধরা পড়া এই দৃশ্যগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সমুদ্রের নীল জলরাশির নিচে এখনো কত রহস্য লুকিয়ে আছে! সেখানে প্রতি রাতে চলে অস্তিত্ব রক্ষার এক নীরব লড়াই। আর সেই লড়াইয়ে টিকে থাকার জন্য প্রকৃতির এই ক্ষুদ্র প্রাণীগুলো যে বুদ্ধির পরিচয় দিচ্ছে, তা সত্যিই অবিশ্বাস্য!