মানুষ কি রঙিন স্বপ্ন দেখে, নাকি সাদাকালো
ঘুম এক বিস্ময়কর জগৎ। চোখ বুজলেই মস্তিষ্ক এমন সব কাহিনি গেঁথে ফেলে, যেন কল্পকথার বই খুলে বসেছি। এই কাহিনির মধ্যে আছে বিস্ময়, ভয়ের ছায়া, আবার আনন্দের ঝলকও। কখনো স্বপ্ন এতটাই বিরক্তিকর হয় যে মনে হয় সময়টা নষ্ট হলো। আবার কখনো এমন দৃশ্য ভেসে ওঠে যে ঘুম ভাঙার পর আফসোস হয়; ইশ, স্বপ্নটা যদি আরেকটু দেখা যেত!
আমাদের মস্তিষ্কই এসব স্বপ্ন বানায়। মস্তিষ্কের ভেতরে আছে একেকটা ছোট ছোট কারখানা। যেমন, অ্যামিগডালা নামের অংশটা আবেগ আর ইমোশন সামলায়। ঘুমের ভেতরে এটি হয়ে ওঠে খুব চঞ্চল। কিন্তু মস্তিষ্কের সামনের দিকের ফ্রন্টাল কর্টেক্স থাকে বেশ শান্ত। এই অংশ আসলে পরিকল্পনা করার জায়গা। এ কারণেই স্বপ্নে হঠাৎ করে দৃশ্য পাল্টে যায়। এই আপনি জঙ্গলে হাঁটছেন, আবার দেখা গেলো উড়ছেন উড়োজাহাজে!
আমি নিজেও অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখি। মাঝেমধ্যেই দেখি কুমির দুই পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। কোনোটা সানগ্লাস পরে আছে, কোনোটার গায়ে আবার হলুদ রঙের টিশার্ট! ওরা বেশ বন্ধুসুলভ। আমার সঙ্গে ঘুরতে বেরোয়। কখনো আচমকা ক্ষেপেও যায়। মস্তিষ্কের তৈরি করা এসব দৃশ্য অদ্ভুত হলেও বেশ চমৎকার।
কিন্তু আসল প্রশ্ন হলো, স্বপ্ন কি সব সময় রঙিন হয়, নাকি মাঝেমধ্যে সাদাকালোও দেখা যায়? ধরুন, আপনি স্বপ্নে ক্যান্ডি ক্রাশ খেলছেন। উজ্জ্বল লাল, বেগুনি আর হলুদ ক্যান্ডিগুলো নিশ্চয়ই মনে গেঁথে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ মানুষ রঙিন স্বপ্ন দেখে। বাকিরা দেখে সাদাকালো। তবে এ হিসাব একেবারে নির্ভুল নয়। কারণ বিজ্ঞানীরা সরাসরি দেখতে পান না, আমরা ঠিক কী স্বপ্নে দেখি। পুরো ব্যাপারটা নির্ভর করে ঘুম ভাঙার পর মানুষ যা মনে করতে পারে, তার ওপর।
স্বপ্ন নিয়ে গবেষণা করতে বিজ্ঞানীরা মানুষকে ল্যাবে ঘুম পাড়ান। ঠিক যখন তারা স্বপ্ন দেখতে শুরু করে, তখনই ঘুম ভেঙে জিজ্ঞেস করেন, এইমাত্র কী দেখছিলেন? কৌশলটা সাধারণ শোনালেও বেশ কার্যকর।
কিন্তু কীভাবে বোঝা যায় মানুষ স্বপ্ন দেখছে? এ প্রশ্নের উত্তর আছে ঘুমের একটি বিশেষ স্তরে। সেই স্তরের নাম র্যাপিড আই মুভমেন্ট বা আরইএম ঘুম। এ সময় চোখ ডানে-বাঁয়ে দুলতে থাকে। বিজ্ঞানীরা মাথায় ইলেকট্রোড লাগিয়ে মস্তিষ্কের কার্যকলাপ ও চোখের নড়াচড়া মাপেন। এই মুহূর্তেই সবচেয়ে বেশি স্বপ্ন দেখা হয়। তাই গবেষকেরা তখনই মানুষকে জাগিয়ে তোলেন।
স্বপ্নের রং বয়সভেদেও বদলায়। তরুণরা সাধারণত রঙিন স্বপ্ন দেখে, কিন্তু অনেক বয়স্ক মানুষ বেশি সাদাকালো স্বপ্ন দেখেন। ধারণা করা হয়, বয়স্করা তাদের শৈশবে সাদাকালো টিভি দেখত। তাই তাদের বেশিরভাগ স্বপ্ন হয় সাদাকালো।
অনেকেই বলেন, তারা নাকি স্বপ্ন দেখেন না। আসলে সবাই স্বপ্ন দেখে। শুধু মনে থাকে না। কারণ তখন হিপোক্যাম্পাস নামে মস্তিষ্কের যে অংশটা দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতি তৈরি করে
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়। সত্যিই কি তারা সাদাকালো স্বপ্ন দেখে, নাকি শুধু এভাবেই মনে রাখে? সাদাকালো সিনেমা আবিষ্কারের আগে মানুষ কী ধরনের স্বপ্ন দেখত? সত্যি বলতে, এর সঠিক উত্তর হয়তো আমরা কোনোদিনই জানব না। অনেকে ভাবেন, স্বপ্ন মানেই শুধু ছবি। কিন্তু তা নয়। স্বপ্নে শব্দ শোনা যায়, গন্ধ পাওয়া যায় এমনকি অনুভব করা যায় স্বাদও। যেমন, আপনি যদি স্বপ্নে ডিজনিল্যান্ডে যান, হয়তো প্যারেডের গান শুনবেন, ফুড স্টল থেকে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের গন্ধ পাবেন। অন্ধ মানুষের স্বপ্নও আলাদা হয়। যারা জন্ম থেকেই অন্ধ, তারা ছবি দেখতে পারে না। কিন্তু শব্দ, গন্ধ, স্পর্শ অনেক বেশি তীক্ষ্ণভাবে অনুভব করে। আবার কেউ যদি কয়েক বছর বয়স পর্যন্ত দেখতে পেরে অন্ধ হয়, তবে তার স্বপ্নে এখনো ছবি ভেসে ওঠার কথা।
অনেকেই বলেন, তারা নাকি স্বপ্ন দেখেন না। আসলে সবাই স্বপ্ন দেখে। শুধু মনে থাকে না। কারণ তখন হিপোক্যাম্পাস নামে মস্তিষ্কের যে অংশটা দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতি তৈরি করে, সেটা প্রায় বন্ধ থাকে। তাই ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই স্বপ্ন মিলিয়ে যায়। কেউ কেউ আবার কিছুটা মনে রাখলেও কয়েক মিনিট পর ভুলে যায়। কারণ তখনও হিপোক্যাম্পাস পুরোপুরি জাগেনি।
তাহলে স্বপ্নের মানে কী? প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ ভেবেছে স্বপ্নে কোনো লুকানো বার্তা আছে কিনা। মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড বলেছিলেন, স্বপ্ন নাকি অচেতন মনের গোপন দরজা। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানীরা বলেন, স্বপ্নের আসলে বিশেষ কোনো অর্থ নেই। দাঁত পড়ে যাওয়ার স্বপ্ন মানেই কিছু হারানোর ভয় নয়। এগুলো নিছকই কল্পনার খেলা।
তবে স্বপ্ন মনে রাখার কৌশল আছে। চাইলে ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই খাতায় লিখে রাখতে পারেন। তা না হলে মস্তিষ্কের বানানো সেই অদ্ভুত অথচ চমৎকার গল্পগুলো মুহূর্তের মধ্যেই হারিয়ে যাবে।