জীবনের তিন ভাগের এক ভাগ সময় আমরা ঘুমিয়ে কাটাই। এর মধ্যে অনেকটা সময় চলে যায় স্বপ্ন দেখতে দেখতে। তবুও বেশিরভাগ মানুষ স্বপ্ন মনে রাখতে পারেন না। এমনকি ঘুম থেকে ওঠার পর যদি কোনো স্বপ্নের কথা মনেও আসে, তা পুরো স্বপ্নের অতি সামান্যই। একে কি স্বাভাবিক বলা যায়?
বিজ্ঞান বলছে, স্বপ্ন ভুলে যাওয়া একদম স্বাভাবিক ঘটনা। এর পেছনে রয়েছে জটিল স্নায়ুবিজ্ঞান ও রসায়নের কারসাজী। স্বপ্ন আমাদের অবচেতন মনের এক রহস্যময় প্রকাশ। আমরা যখন ঘুমাই, তখন আমাদের মস্তিষ্কের সব অংশ একসঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ে না। বিশেষ করে মস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিপোক্যাম্পাস ঘুমাতে এবং জাগতে সময় নেয়। এই হিপোক্যাম্পাস আমাদের স্মৃতি গঠনের কেন্দ্র। গবেষণায় দেখা গেছে, মস্তিষ্কের এই অংশ ঘুমের সময় সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় না হয়ে সারা দিনের অভিজ্ঞতাগুলো প্রক্রিয়াজাত করে দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতিতে রূপান্তর করে। এই প্রক্রিয়া চলার সময় নতুন অভিজ্ঞতা গ্রহণ করার সক্ষমতা থাকে না। ফলে আমরা যখন স্বপ্ন দেখি, তখন সেই স্বপ্নগুলোর তথ্য নতুন স্মৃতি হিসেবে হিপোক্যাম্পাসে আর সংরক্ষিত থাকতে পারে না।
তবে সব স্বপ্নই কি মনে রাখার উপযুক্ত? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের তাকাতে হবে স্বপ্নের প্রকৃতির দিকে। অনেকে মনে করেন, স্বপ্ন হলো মনের দৃষ্টিভঙ্গির এক এলোমেলো মিছিল। বিজ্ঞানীরা বলেন, বেশিরভাগ স্বপ্নই হয় খুব সাধারণ, অসংলগ্ন এবং আবেগহীন।
২০১১ সালে নিউরন জার্নালে এ সম্পর্কিত একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে বিজ্ঞানীরা দেখান, ঘুমের সময় মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চল ধাপে ধাপে বিশ্রামে যায় এবং পুনরায় সক্রিয় হয়। ঘুমের সময় হিপোক্যাম্পাসের কার্যক্রম কমে যায়। তবে জেগে ওঠার মুহূর্তে সেই অংশটি সম্পূর্ণ সক্রিয় না থাকায় স্বপ্নের স্মৃতি ধরে রাখতে পারে না। তাই আমাদের মনে হয়, আমরা কিছু দেখিনি বা মনে রাখতে পারছি না। যদিও ঘুমিয়ে আমরা সত্যিই স্বপ্ন দেখেছিলাম।
ঘুমের সময় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে নিউরোট্রান্সমিটারে। ঘুমের প্রথম দিকে অ্যাসিটাইলকোলিন ও নোরঅ্যাড্রেনালিন নামে রাসায়নিকগুলোর মাত্রা কমে যায়। এই দুটি রাসায়নিক স্মৃতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমরা যখন রেম (বা র্যাপিড আই মুভমেন্ট) ঘুমে প্রবেশ করি, তখন অ্যাসিটাইলকোলিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। কিন্তু নোরঅ্যাড্রেনালিন থেকে যায় আগের মতো কম। এই অদ্ভুত ভারসাম্যের কারণেই হয়তো মানুষ স্বপ্ন ভুলে যায়। কারণ, একদিকে কর্টেক্স ঘুম থেকে জেগে উঠার জন্য উত্তেজিত থাকে, অন্যদিকে স্মৃতি গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় রাসায়নিক সাড়া কম থাকে। ফলে স্বপ্নের দৃশ্যগুলো আমাদের কর্টেক্সে পৌঁছালেও তা হিপোক্যাম্পাসে স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত হয় না।
এ ছাড়াও, ঘুমের মধ্যে বার বার জেগে গেলে স্বপ্ন মনে রাখা সহজ হয়। ২০১৭ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত স্বপ্ন মনে রাখতে পারেন, তাঁরা রাতে বারবার জেগে ওঠেন। গড়ে তাঁরা ২ মিনিট জেগে থাকেন। কিন্তু যারা স্বপ্ন মনে রাখতে পারেন না, তাঁদের জেগে থাকার গড় সময় মাত্র ১ মিনিট। এই সময়ের ব্যবধান অনেক বড় ফারাক তৈরি করে। হিপোক্যাম্পাসকে পুনরায় সক্রিয় হতে কিছু সময় লাগে। তাই একটু বেশি সময় জেগে থাকলে স্বপ্ন মনে রাখার সম্ভাবনা বাড়ে। কারণ, হিপোক্যাম্পাসকে আবার সক্রিয় হয়ে উঠতে প্রায় দুই মিনিট সময় লাগে।
স্বপ্ন মনে না রাখা কোনো স্মৃতিভ্রষ্টতা নয়। এটি আমাদের মস্তিষ্কের একটি স্বাভাবিক সুরক্ষা ব্যবস্থা। প্রতিদিন মস্তিষ্কে বিপুল পরিমাণ তথ্য আসছে, আর তার মধ্যে অপ্রয়োজনীয় বা গুরুত্বহীন অভিজ্ঞতাগুলো ছেঁটে ফেলাই স্বাভাবিক।
তবে সব স্বপ্নই কি মনে রাখার উপযুক্ত? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের তাকাতে হবে স্বপ্নের প্রকৃতির দিকে। অনেকে মনে করেন, স্বপ্ন হলো মনের দৃষ্টিভঙ্গির এক এলোমেলো মিছিল। বিজ্ঞানীরা বলেন, বেশিরভাগ স্বপ্নই হয় খুব সাধারণ, অসংলগ্ন এবং আবেগহীন। অনেকে যেমন দিনে দাঁত ব্রাশ করতে করতে বা রিকশায় বসে থাকতে যেসব অপ্রয়োজনীয় চিন্তা করেন, তেমন স্বপ্নগুলোকেও মস্তিষ্ক অপ্রয়োজনীয় বিবেচনা করে এবং সেগুলো সংরক্ষণ করে না। তবে যদি কোনো স্বপ্ন খুব বেশি প্রাণবন্ত, আবেগপ্রবণ এবং সুসংগত হয় বা যদি ঘুমের মধ্যে হঠাৎ জেগে ওঠে, তবে সেই স্বপ্নগুলো মনে রাখার সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি। কারণ, সেগুলো মস্তিষ্কে একটি সংবেদনশীল ছাপ ফেলে।
স্বপ্ন মনে রাখতে চাইলে কিছু কৌশল কাজে লাগাতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের অধ্যাপক রবার্ট স্টিকগোল্ড পরামর্শ দেন, ঘুমানোর আগে বেশি পানি খেলে রাতে বাথরুমে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এতে স্বপ্ন মনে রাখার সম্ভাবনাও বাড়ে। আবার ঘুমাতে যাওয়ার আগে নিজেকে মনে করিয়ে দিন যে আপনি স্বপ্ন মনে রাখতে চান। এ ধরণের মানসিক প্রস্তুতি মস্তিষ্ককে আরও সচেতন রাখে। পাশাপাশি ঘুম থেকে উঠেই চোখ বন্ধ রেখে নড়াচড়া না করে ধীরে ধীরে স্বপ্নের ঘটনাগুলো মনে করার চেষ্টা করতে পারেন।
সবশেষে বলা যায়, স্বপ্ন মনে না রাখা কোনো স্মৃতিভ্রষ্টতা নয়। এটি আমাদের মস্তিষ্কের একটি স্বাভাবিক সুরক্ষা ব্যবস্থা। প্রতিদিন মস্তিষ্কে বিপুল পরিমাণ তথ্য আসছে, আর তার মধ্যে অপ্রয়োজনীয় বা গুরুত্বহীন অভিজ্ঞতাগুলো ছেঁটে ফেলাই স্বাভাবিক। কিন্তু কেউ চাইলে মস্তিষ্ককে একটু ট্রেনিং দিয়ে স্বপ্নের জগতে একটু বেশি প্রবেশ করতে পারেন। অবচেতন মনের এই রহস্যময় দরজাটা খোলা রাখা যায় শুধু ব্যক্তির নিজস্ব ইচ্ছা, মনোযোগ আর অভ্যাসের ওপর নির্ভর করে।