রোগ প্রতিরোধতন্ত্র নিয়ন্ত্রণের রহস্য আবিষ্কার

দেহের রোগ দমন করে রোগ প্রতিরোধতন্ত্র। কিন্তু তাকে নিয়ন্ত্রণ করে কে? এ প্রশ্নের উত্তর আবিষ্কার করেছেন মেরি ব্রাঙ্কো, ফ্রেড রামসডেল ও শিমন সাকাগুচি। সেই গবেষণার আদ্যোপান্ত এবং এর প্রয়োগ...

প্রতিদিন আমাদের শরীর অসংখ্য জীবাণুর আক্রমণের শিকার হয়। আমাদের দেহ যেন এক দুর্গ; আর জীবাণুদের আক্রমণ থেকে তাকে রক্ষা করে শরীরের অতন্দ্রপ্রহরী রোগ প্রতিরোধতন্ত্র। সহজভাবে বলা যায়, দেহের নিরাপত্তাব্যবস্থা। নানা ধরনের হাজারো জীবাণু আক্রমণ করে আমাদের। এর কোনো কোনোটি আবার আমাদের দেহের কোষের রূপও নিতে পারে। অর্থাৎ ছদ্মবেশ ধারণ করতে পারে। সেগুলো সঠিকভাবে চিনে, নিজ শরীরের কোষকে আক্রমণ না করে শুধু জীবাণুদেরই আক্রমণ করে আমাদের দেহের নিরাপত্তাব্যবস্থা।

কিন্তু যদি এই সতর্ক প্রহরীরা ভুল করে নিজের দেহকোষকেই আক্রমণ করতে শুরু করে, তাহলে কী ঘটে? তখন জন্ম নেয় অটোইমিউন রোগ। কথাটার অর্থ ওটাই—দেহের নিরাপত্তাব্যবস্থার প্রতিরক্ষীরা নিজেরাই নিজ দেহের কোষকে আক্রমণ করার ফলে যেসব রোগ হয়। যেমন রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা টাইপ-১ ডায়াবেটিস।

অর্থাৎ এখানে একধরনের ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়। নিরাপত্তাব্যবস্থাকে চিনতে হয় কে বন্ধু, কে শত্রু। প্রশ্ন হলো, সেটি কীভাবে?

এ প্রশ্নের উত্তর মিলেছে এবারের চিকিৎসাবিজ্ঞান ও শারীরতত্ত্বে নোবেলজয়ীদের গবেষণায়। মেরি ব্রাঙ্কো, ফ্রেড রামসডেল ও শিমন সাকাগুচিকে দেহের নিরাপত্তাব্যবস্থার ‘প্রান্তিক সহনশীলতা’–বিষয়ক মৌলিক গবেষণার জন্য এ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। কথাটা শুনতে জটিল মনে হতে পারে। মূল বিষয় হলো শরীরের নিরাপত্তাব্যবস্থার কোষগুলো নিজের টিস্যু বা অঙ্গকে আক্রমণ না করে কীভাবে জীবাণুদের সফলভাবে আক্রমণ করে, সে রহস্যই ভেদ করেছেন এই বিজ্ঞানীরা।

আমাদের দেহের নিরাপত্তাব্যবস্থা যেকোনো দেশের সেনাবাহিনীর মতোই সদা নির্ভীক, লড়াই করছে জীবাণুদের সঙ্গে; কিন্তু এরা আমাদের দেহকোষ ও প্যাথোজেন বা জীবাণুদের মধ্যে পার্থক্য করে কীভাবে? বিজ্ঞানীরা ভাবতেন, এ প্রশ্নের উত্তর তাঁরা জানেন। সেন্ট্রাল ইমিউন টলারেন্স বা ‘কেন্দ্রীয় সহনশীলতা’ নামের একটি পদ্ধতির ভেতর দিয়ে যায় আমাদের কোষ। দেখা গেল, বিষয়টি এত সহজ নয়।

প্রতিটি টি কোষেই ‘টি সেল রিসেপ্টর’ বা ‘টি কোষ গ্রাহক’ নামে বিশেষ ধরনের প্রোটিন থাকে। এরা একধরনের সেন্সরের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এই সেন্সরই জীবাণু শনাক্ত করার মূল কারিগর। ‘টি কোষ গ্রাহক’ আবার নানা আকার-আকৃতির হতে পারে। জিগস পাজলের বিভিন্ন অংশের মতো। তাত্ত্বিকভাবে আমাদের দেহে নানা ধরনের বৈচিত্র্যময় টি কোষ তৈরি হতে পারে, তাদের থাকে আবার নানা আকারের গ্রাহক প্রোটিন। এই গ্রাহক প্রোটিনের সংখ্যা ১০১৫–এর বেশি হতে পারে। এই বিপুল বৈচিত্র্য ও নানা ধরনের আকার-আকৃতি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এরা বিভিন্ন ধরনের ভাইরাসের আকৃতি শনাক্ত করতে পারে। সমস্যা হলো শরীরে এমন কিছু গ্রাহক টি কোষ তৈরি হয়, যেগুলো দেহের নিজস্ব টিস্যুর সঙ্গেও যুক্ত হতে পারে। ঘুরেফিরে তাই সেই প্রশ্ন—এরা তাহলে কেন শুধু জীবাণুদেরই আক্রমণ করে?

এর কারণটি বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন—অন্তত তাঁরা বোঝেন বলে ভাবতে শুরু করেন ১৯৮০-এর দশকে। তাঁরা দেখেন, টি কোষ একধরনের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যায়। পরীক্ষাটি ঘটে থাইমাস নামে নিরাপত্তাব্যবস্থার একটি বিশেষ অঙ্গের ভেতরে। এই অঙ্গের ভেতরেই রোগ প্রতিরোধক কোষগুলো পরিপক্বতা লাভ করে। সেখানে থাইমাস এসব টি কোষকে দেহের নিজস্ব প্রোটিনের কিছু অংশ দেখায়। যেসব টি কোষ এসব প্রোটিনের অংশকে চিনতে পারে এবং সেগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়, সেগুলোকে ওখানেই ধ্বংস করে ফেলা হয়।

আর যেগুলো আমাদের প্রোটিনকে চেনে না, ওগুলো বেঁচে যায়। তার মানে এগুলো ভবিষ্যতে ভুলভাবে আমাদের নিজস্ব টিস্যু বা অঙ্গকে আক্রমণ করবে না। শুধু জীবাণুদেরই আক্রমণ করবে। এটাই সেই সেন্ট্রাল ইমিউন টলারেন্স বা কেন্দ্রীয় সহনশীলতা। বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন, ঘটনা এটুকুই।

কিন্তু ১৯৯৫ সালে শিমন সাকাগুচির হাত ধরে প্রথম বোঝা গেল, ঘটনা এত সহজ নয়।

আরও পড়ুন
প্রতিটি টি কোষেই ‘টি সেল রিসেপ্টর’ বা ‘টি কোষ গ্রাহক’ নামে বিশেষ ধরনের প্রোটিন থাকে। এরা একধরনের সেন্সরের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এই সেন্সরই জীবাণু শনাক্ত করার মূল কারিগর।

ঘটনার শুরু ১৯৮০-এর দশকে, জাপানে। শিমন সাকাগুচি তখন জাপানের নাগাউ শহরের আইচি ক্যানসার সেন্টার রিসার্চ ইনস্টিটিউটে গবেষণারত। তাঁর সহকর্মীরা ইঁদুরের জন্মের তিন দিনের মধ্যে থাইমাস সরিয়ে ফেলেছিলেন। ভেবেছিলেন, এতে ইঁদুরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল হবে; কিন্তু ফল হলো উল্টো। দেহের নিরাপত্তাব্যবস্থা যেন খেপে গেল। ফলে ওই নবজাত ইঁদুরগুলোর দেহে দেখা দিল ভয়াবহ অটোইমিউন প্রতিক্রিয়া। থাইরয়েড ও পাকস্থলীর মতো অঙ্গগুলো নিজস্ব নিরাপত্তাব্যবস্থার আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত হতে লাগল। ভয়ংকর এই অসুখ! সাকাগুচি নিজেকেই জিজ্ঞাসা করলেন, কেন এমন হলো?

উত্তরের খোঁজে শিমন সাকাগুচি একই রকম সুস্থ ইঁদুর থেকে টি কোষগুলো আলাদা করে আক্রান্ত ইঁদুরের দেহে প্রবেশ করান। আশ্চর্য হয়ে তিনি দেখলেন, কিছু নির্দিষ্ট কোষ সেই অটোইমিউন রোগ দমন করছে, ইঁদুরদের রক্ষা করছে ভয়ংকর এসব রোগ থেকে। অর্থাৎ শরীরের খ্যাপা নিরাপত্তাব্যবস্থা যেন আবার শান্ত হয়ে এসেছে।

এ থেকে শিমন সাকাগুচি সিদ্ধান্তে আসেন, টি কোষেরই এমন কোনো বিশেষ দল আছে, যারা সুবিবেচক নিরাপত্তারক্ষীর মতো কাজ করে এবং অন্য টি কোষগুলোকে শান্ত রাখে। এর প্রায় এক দশক আগে ১৯৭০-এর দশকে এমনই আরেকটি তত্ত্ব এসেছিল। ‘সাপ্রেসর টি সেল’ বা ‘দমনকারী টি কোষ’ নামের এই তত্ত্ব বিজ্ঞানীরা মানতে পারেননি। সাকাগুচির গবেষণায় সেই তত্ত্বের প্রতিধ্বনি দেখে আবার ভ্রু কোঁচকালেন বিজ্ঞানীরা। ভাবলেন, তিনি সেই পুরোনো ভুল পথেই হাঁটছেন।

কিন্তু সাকাগুচি দমার পাত্র নন। তিনি ভাবলেন, প্রকৃতি ভারসাম্য রক্ষার কারিগর। কাজেই দেহের নিরাপত্তাব্যবস্থারও নিশ্চয়ই ‘ব্রেক’ আছে। এই ব্রেক কষে নিয়ন্ত্রণে রাখার কাজটি কোনো না কোনো কোষ তো করেই। এই ভেবে বছরের পর বছর স্রোতের বিপরীতে নিজের গবেষণায় একমনে লেগে রইলেন সাকাগুচি।

তখনকার যুগে বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম এত উন্নত ছিল না। ছিল না আধুনিক জিনোম সিকোয়েন্সিং যন্ত্রের মতো কিছু। টি কোষের পৃষ্ঠে থাকা প্রোটিন, যেমন CD4 বা CD8 দেখে একে একে আলাদা করা, তারপর ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা চালানো—এসব সূক্ষ্ম কাজও ধৈর্য নিয়ে করতেন তিনি। বারবার ব্যর্থ হতে হতে এগোতে লাগলেন।

অবশেষে প্রায় এক দশক গবেষণার পর ১৯৯৫ সালে ধরা দিল সফলতা। দ্য জার্নাল অব ইমিউনোলজিতে প্রকাশিত হলো তাঁর আবিষ্কার: এক নতুন ধরনের টি কোষ, CD4+ CD25+ Regulatory T Cell, সংক্ষেপে ট্রেগ (Treg)। বাংলায় এই ‘রেগুলেটরি টি সেল’কে বলা হয় নিয়ন্ত্রক টি কোষ। দেখা গেল, এই কোষগুলোর পৃষ্ঠে CD4 ও CD25 নামে দুটি বিশেষ প্রোটিন থাকে (সেটিই বোঝানো হয়েছে CD4+ CD25+ দিয়ে)।

এই সেই সুবিবেচক টি কোষ, যারা নিরাপত্তাব্যবস্থার অতি প্রতিক্রিয়াশীল কোষগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। সে জন্যই অমন নাম—নিয়ন্ত্রক টি কোষ। পরীক্ষা করে বোঝা গেল, যেসব ইঁদুরের শরীরে এই কোষ অনুপস্থিত, সেগুলো তীব্র অটোইমিউন রোগে আক্রান্ত হয়। এভাবে পৃথিবীর সামনে উন্মোচিত হলো দেহের নিরাপত্তাব্যবস্থার এক নতুন দিক।

তবু প্রশ্ন রয়ে গেল। নিরাপত্তাব্যবস্থার এই নিজস্ব নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে? অনেকে বললেন, ‘এ তো সেই পুরোনো ‘সাপ্রেসর টি সেল’ গল্পের নতুন সংস্করণ।’ সাকাগুচির আবিষ্কার তাই রয়ে গেল এক অসমাপ্ত অধ্যায়ের মতো, আরও গভীর ব্যাখ্যার অপেক্ষায়।

ঠিক তখনই প্রশান্ত মহাসাগরের ওপারে দুই গবেষক সাহসী এক উদ্যোগ নিলেন। পরে এসে সাকাগুচির কাজের সঙ্গে জুড়ে যাবে তাঁদের গবেষণা, মিলবে রহস্য–কাহিনির শেষাংশের খোঁজ—অসমাপ্ত অধ্যায়ের শেষটুকু।

আরও পড়ুন
শিমন সাকাগুচি সিদ্ধান্তে আসেন, টি কোষেরই এমন কোনো বিশেষ দল আছে, যারা সুবিবেচক নিরাপত্তারক্ষীর মতো কাজ করে এবং অন্য টি কোষগুলোকে শান্ত রাখে।

এবার একটু ব্রেক নিয়ে ঘুরে আসা যাক ১৯৪০-এর দশকে।

টেনেসি, ওক রিজ ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি। ম্যানহাটান প্রকল্পের রেডিয়েশন গবেষণার মধ্যে আকস্মিকভাবে জন্ম নেয় এক অদ্ভুত মিউট্যান্ট জাতের ইঁদুর—স্কার্ফি। খসখসে ত্বক, ফুলে যাওয়া প্লীহা, লিম্ফ নোডসহ জন্ম নেওয়া এই জাতের পুরুষ ইঁদুরগুলো প্রাণ হারায় খুব অল্প বয়সে। স্ত্রী ইঁদুরগুলো নিজে আক্রান্ত না হয়ে বহন করে এক্স (X) ক্রোমোজোমবাহিত একধরনের মিউটেশন এবং সেটি পৌঁছে দেয় পরের প্রজন্মে।

প্রাথমিক জেনেটিক পর্যবেক্ষণগুলোর ইঙ্গিত ছিল, টি কোষগুলো হয়তো নিজেরাই ইঁদুরগুলোর নিজ দেহের অঙ্গগুলোকে আক্রমণ করছে। কিন্তু কেন?

এ প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে আমাদের যেতে হবে ১৯৯০-এর দশকে, যুক্তরাষ্ট্রে। সেলটেক কাইরোসায়েন্সে মেরি ব্রাঙ্কো ও ফ্রেড রামসডেল স্কার্ফি ইঁদুর নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। এই বায়োটেক কোম্পানিতে নানা রকম রোগের ওষুধ উদ্ভাবন করাই তাঁদের কাজ। বিশেষ করে আইপেক্স (IPEX) নামে মানুষের একটি দুর্লভ রোগ হয়, এটাও এক্স ক্রোমোজোমবাহিত রোগ। এক্স ক্রোমোজোমবাহিত রোগ আসলে একধরনের জিনগত ত্রুটি। এই ত্রুটির জন্য দায়ী জিনটি এক্স ক্রোমোজোমে থাকে। যেহেতু পুরুষদের (XY) একটি মাত্র এক্স ক্রোমোজোম থাকে, তাই তারা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হন, আর নারীরা (XX) সাধারণত এর বাহক হন; কিন্তু নিজে আক্রান্ত হন না। আইপেক্স রোগেও দেখা যায়, ছেলেশিশুরা এতে প্রাণঘাতী অটোইমিউন সমস্যার শিকার হয়। এর ফলে অন্ত্র এবং এর গঠনের সঙ্গে সম্পর্কিত হরমোনাল গ্রন্থিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ব্রাঙ্কো-রামসডেল ভাবলেন, স্কার্ফি মিউটেশনের জন্য দায়ী জিনটি শনাক্ত করতে পারলে আইপেক্সের মতো রোগগুলোর কারণ বোঝা যাবে। সেই সঙ্গে এগুলোর চিকিৎসার উপায়ও হয়তো মিলবে।

ব্রাঙ্কো-রামসডেল এক্স ক্রোমোজোম সিকোয়েন্স করার মতো প্রায় অসম্ভব এক কাজের সিদ্ধান্ত নিলেন। ১৭ কোটি বেস পেয়ারের এক্স ক্রোমোজোম—বর্তমানের আধুনিক প্রযুক্তিতে কয়েক দিনে সিকোয়েন্স করে ফেলা যায়; কিন্তু সেই সময়ে এটি ছিল এক ক্লান্তিকর ও অনিশ্চিত অভিযান। বিজ্ঞানীরা ধীরে ধীরে অনুসন্ধানের সীমানা ছোট করতে করতে এসে পৌঁছালেন এক সংক্ষিপ্ত অংশে, প্রায় পাঁচ লাখ নিউক্লিওটাইডের ভেতরে। সেখানে শুরু হলো ধৈর্যের আসল পরীক্ষা।

টুকরা টুকরা ডিএনএ ক্লোন করে এক এক করে জিন সিকোয়েন্স করা। বিশ্লেষণ চলল ২০টি জিনের ওপর। মাসের পর মাস কেটে যাচ্ছে; কিন্তু ফলাফল শূন্য। এই দীর্ঘ গবেষণায় তাঁদের একমাত্র অবলম্বন ছিল ধৈর্য। কারণ, একটিমাত্র ভুল মুছে দিতে পারে গোটা মাসের পরিশ্রম।

২০০১ সালে ২০ নম্বর জিনটায় অবশেষে মিলল উত্তর। এতে আছে দুটি বাড়তি জোড়া ক্ষার বা বেজ পেয়ার। এ জন্য জিনের কাজ বাধাগ্রস্ত হয়, আগেভাগেই থেমে যায় এ জিন থেকে সৃষ্ট প্রোটিন তৈরির প্রক্রিয়া। এই নতুন জিনের গঠন অনেকটা ফর্কহেড বক্স পরিবারের জিনের মতো। এই জিনগুলো কোষের বিকাশ ও পরিণতি নিয়ন্ত্রণ করে। এর সঙ্গে মিল রেখে তাঁরা নতুন আবিষ্কৃত জিনের নাম দিলেন ফক্সপি৩ (Foxp3)।

প্রমাণের জন্য তাঁরা এমন ট্রান্সজেনিক ইঁদুর তৈরি করলেন, যেখানে স্বাভাবিক ফক্সপি৩ জিন অতিরিক্তভাবে প্রকাশ পায়। ফলাফল পাওয়া গেল দারুণ। আগের সেই মৃত্যুপথযাত্রী পুরুষ স্কার্ফি ইঁদুরগুলো সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠল।

কিন্তু মানুষের রোগের সঙ্গে এর যোগসূত্র কোথায়? ডেটাবেজ ঘেঁটে দেখা গেল, আইপেক্সে আক্রান্ত শিশুদের নমুনায়ও ফক্সপি৩ (FOXP3) জিনেই মিউটেশন রয়েছে। নেচার জেনেটিকস-এ প্রকাশিত সেই গবেষণায় উন্মোচিত হলো স্কার্ফি ইঁদুরের রহস্য আর মানবরোগের সংযোগ।

কিন্তু এখানেই শেষ নয়; এই আবিষ্কার থেকেও পুরোপুরি জানা গেল না কীভাবে দেহের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। চক্র পূর্ণ হবে, এ উত্তর দেবেন সাকাগুচি নিজেই।

আরও পড়ুন
নতুন জিনের গঠন অনেকটা ফর্কহেড বক্স পরিবারের জিনের মতো। এই জিনগুলো কোষের বিকাশ ও পরিণতি নিয়ন্ত্রণ করে। এর সঙ্গে মিল রেখে তাঁরা নতুন আবিষ্কৃত জিনের নাম দিলেন ফক্সপি৩।

২০০৩ সাল। জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিমন সাকাগুচি তখন নিয়ন্ত্রক টি কোষে ফক্সপি৩ নিয়ে পরীক্ষারত। অবাক হয়ে তিনি দেখলেন, CD4+ CD25+ কোষগুলোতেই ফক্সপি৩ জিনটি বিশেষভাবে সক্রিয় থাকে। আরও পরীক্ষায় দেখা গেল, CD4+ টি কোষে ফক্সপি৩ বিশেষভাবে প্রবেশ করালে সেগুলো নিয়ন্ত্রক টি কোষের মতো নিয়ন্ত্রক কোষে পরিণত হয়। অন্যদিকে ফ্রেড রামসডেলের দলও স্কার্ফি ইঁদুরের দেহে ফক্সপি৩-এর কারিকুরি নিশ্চিত করলেন স্বাধীনভাবে।

১৯৭০-এর দশকের বিতর্কিত ‘দমনক্ষম টি কোষ’ তত্ত্বের মতো এবার আর কোনো অস্পষ্টতা রইল না। নিশ্চিতভাবে বোঝা গেল ফক্সপি৩ টি কোষকে নিয়ন্ত্রণ করে। এভাবে সাকাগুচির ১৯৯৫ সালের রহস্যময় কোষগুলোর ব্যাখ্যা মেলে; ব্রাঙ্কো ও রামসডেল আবিষ্কৃত জিনের কার্যকারিতা প্রকাশ পায়। আলাদা পথ, দশকের ব্যবধান এসে মিলে গেল এক সুতায়।

অর্থাৎ এই ফক্সপি৩ জিনই ১৯৯৫ সালে সাকাগুচির চিহ্নিত নিয়ন্ত্রক টি কোষগুলোর বিকাশ নিয়ন্ত্রণ করে। অন্য রোগ প্রতিরোধক কোষকে পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করে এই কোষগুলো নিশ্চিত করে, আমাদের দেহের নিরাপত্তাব্যবস্থা যেন আমাদের নিজের টিস্যুগুলোর প্রতি সহনশীল থাকে। অর্থাৎ নিজেই নিজেকে আক্রমণ না করে। এরই নাম দেওয়া হয়েছে পেরিফেরাল অটোইমিউন টলারেন্স বা প্রান্তিক সহনশীলতা। অর্থাৎ এরা আমাদের সেকেন্ড লাইন অব ডিফেন্স। কেন্দ্রীয় সহনশীলতার পরের ধাপে এরা নিশ্চিত করে ওই ছাঁকনি পেরিয়ে এসেও কোনো টি কোষ যেন ভুলক্রমে আমাদের দেহের কোনো টিস্যু বা অঙ্গকে আক্রমণ না করে।

নোবেল বিজয়ীদের এই গবেষণাগুলোর মধ্য দিয়ে রোগ প্রতিরোধতন্ত্রের প্রান্তিক সহনশীলতা গবেষণাক্ষেত্রের সূচনা হয়। ক্যানসারসহ বেশ কিছু অটোইমিউন রোগ, যেমন টাইপ–১ ডায়াবেটিসের চিকিৎসা উন্নয়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে তাঁদের গবেষণা। এটি ভবিষ্যতে সফল অঙ্গ প্রতিস্থাপনেও সহায়ক হতে পারে। এ–সংক্রান্ত বেশ কিছু গবেষণা বর্তমানে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পর্যায়ে রয়েছে। সংখ্যাটি ২০০-এর বেশি!

লেখক: মাস্টার্স গ্র্যাজুয়েট, ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার্স ইন সাসটেইনেবল ড্রাগ ডিসকভারি, ঘেন্ট ইউনিভার্সিটি, মেডিকেল ইউনিভার্সিটি অব গাদানস্ক, ইউনিভার্সিটি অব গ্রোনিংগেন, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সান ফ্রান্সিসকো

সূত্র: নোবেল প্রাইজ ডটঅর্গ

আরও পড়ুন