রসায়নে নোবেল ২০২৫
প্রতিশ্রুতিশীল পদার্থের নোবেল জয়
রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বিজ্ঞানী সুসুমু কিতাগাওয়া, রিচার্ড রবসন এবং ওমর এম ইয়াগি। ‘ধাতব-জৈব কাঠামো’ নামে নতুন একধরনের আণবিক কাঠামো আবিষ্কারের জন্য তাঁদের এ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ? গবেষণাটির আদ্যোপান্ত...
মেটাল অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্ক বা মফ (MOF) নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বললে মনে হয়, পৃথিবীর সব বড় সমস্যার সমাধানে কোনো একভাবে কাজে আসবে বিশাল আণবিক আকারের এই বিশেষ পদার্থ। রসায়নবিদদের বড় এক অংশের কাছে প্রিয় মফ গবেষণা। একই সঙ্গে তাত্ত্বিক গবেষণায় বিপুল আগ্রহ, এমনকি কম্পিউটারবিজ্ঞানী, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্সের লোকজনের কাছে তো অবশ্যই আদরণীয়—বিশেষ ম্যাটেরিয়াল বলে কথা! গত দুই দশকে রসায়নে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফিল্ডের নাম বলতে গেলে সবার ওপরেই থাকবে মেটাল অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্ক (মফ)।
শেষ কয়েক বছর ধরেই তাই মফের আবিষ্কারকদের ঘরে যে নোবেল পুরস্কার যাচ্ছে, তাতে তেমন কোনো সন্দেহ ছিল না। ব্যাপারটা ছিল সময়ের। অবশেষে সেই সময় এল। এবার রসায়নে নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন মেটাল অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্ক আবিষ্কার থেকে শুরু করে শক্ত ভিত্তি গড়ে দেওয়া তিন বিজ্ঞানী—ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ান রিচার্ড রবসন, জাপানের সুসুমু কিতাগাওয়া ও ফিলিস্তিন–জর্ডান বংশোদ্ভূত মার্কিন ওমর ইয়াগি।
মেটাল অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্কের গল্পে যাওয়ার আগে আমরা সংক্ষেপে একটু জেনে নেব এর বিল্ডিং ব্লক বা অণু–পরমাণুর কথা। আমরা পর্যায় সারণিতে ১১৮টি মৌলিক পদার্থের পরমাণু দেখতে পাই। এসব পরমাণুর বেশির ভাগই ধাতু বা মেটাল। মাত্র ১৭টি পদার্থকে সাধারণত ধরা হয় অধাতু। এর মধ্যে বিশেষ অধাতব পরমাণু কার্বন। এই কার্বন একই সঙ্গে চারটি বন্ধন তৈরি করতে পারে। এই বন্ধন যেমন অন্য পরমাণুর সঙ্গে হয়, একইভাবে কার্বনের সঙ্গে কার্বনের বন্ধনও হয়।
শুধু কার্বনের বন্ধনেই হয় ডায়মন্ড বা হীরা, গ্রাফাইট, গ্রাফিন ও কয়লা। অপর দিকে হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন ইত্যাদির সঙ্গে মিলে সরল থেকে জটিল বা জটিলতর, মিথেনের মতো ক্ষুদ্র থেকে শুরু করে পলিথিনের পলিমার চেইনের মতো বিশাল আকৃতির অণু তৈরি করতে পারে। এসব অণু প্রধানত অধাতব পরমাণুর তৈরি হলেও একটু–আধটু ধাতব পরমাণুও যুক্ত করতে পারে। এসব মিলিয়ে কার্বনের অণুর জগৎ এত বিশাল যে আলাদা একটা বিভাগই গড়ে উঠেছে রসায়নে—জৈব রসায়ন বা অর্গানিক কেমিস্ট্রি নামে। মেটাল অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্ক এই জৈব রসায়নেরই এক অসামান্য অর্জন।
মফের শুরু জৈব রসায়ন পাঠদান করতে গিয়েই, ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্নে। ১৯৭৪ সালে সেখানে রিচার্ড রবসনের দায়িত্ব পড়ে রসায়ন পড়ানোর। শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে বিভিন্ন অণুর গঠন বোঝাতে তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয় কাঠের মডেল বানাতে। এই মডেলকে সাধারণত বলা হয়—‘বল অ্যান্ড স্টিক মডেল’, যেখানে গোলক আকৃতি দিয়ে বিভিন্ন পরমাণু বোঝানো হয় এবং স্টিক দিয়ে দেখানো হয় পরমাণুর সঙ্গে পরমাণুর বন্ধন। এক পরমাণুর সঙ্গে কয়টা অন্য পরমাণু যুক্ত হবে এবং ঠিক কোন দিক দিয়ে যুক্ত হবে, তা নির্দিষ্ট। তত দিনে রসায়নবিদেরা জানেন, রসায়ন ক্লাসেও পড়ানো হয়। রিচার্ড রবসনের দায়িত্ব ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্কশপে এগুলো বানানোর সময় নিশ্চিত করা যে ঠিকমতো ছিদ্র বানানো হচ্ছে।
হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন ইত্যাদির সঙ্গে মিলে সরল থেকে জটিল বা জটিলতর, মিথেনের মতো ক্ষুদ্র থেকে শুরু করে পলিথিনের পলিমার চেইনের মতো বিশাল আকৃতির অণু তৈরি করতে পারে।
মডেলগুলো হাতে পাওয়ার পর রবসনের মাথায় আসে, এগুলো দিয়ে চাইলেই যেমন ইচ্ছা তেমন গঠন বানানো যায় না। একেকটি অণু বানাতে অনেক ধরনের তথ্য কাজে লাগে। এক পরমাণু অন্য আরেক পরমাণুর সঙ্গে শুধু নির্দিষ্ট উপায়েই যুক্ত হতে পারে। তখন তাঁর মনে প্রশ্ন উঁকি দেয়, পরমাণুর এই বিশেষ ধর্ম ব্যবহার করে কি অণুর সঙ্গে অণু যুক্ত করা যাবে?
প্রতিবছর ক্লাসে মডেল নিয়ে যান, একই চিন্তা মাথায় আসে। কিন্তু আর বেশি দূর আগানো হয় না। এভাবে কেটে যায় এক যুগের বেশি। শেষে চিন্তা করেন, এ ধরনের কিছুটা সরল একটি অণু বানানোর চেষ্টা করবেন। এ জন্য বেছে নেন ডায়মন্ড বা হীরার গঠন। ডায়মন্ডে একটা কার্বন অন্য চারটা কার্বনের সঙ্গে বন্ধন গঠন করে। প্রতিটি কার্বন পরমাণু অন্য চারটি কার্বন পরমাণুর সঙ্গে যুক্ত হয় বলে হীরা এত শক্ত। রবসন ভাবেন, কার্বনের বদলে তিনি ব্যবহার করবেন কপার আয়ন। কারণ, ধনাত্মক কপার আয়ন চারটা লিগ্যান্ড বা অণু আকর্ষণ করতে পারে।
অণু হিসেবে বেছে নেন টেট্রাসায়ানো–টেট্রাফিনাইলমিথেন। এই অণুর কেন্দ্রে আছে একটা কার্বন পরমাণু। এই কার্বন পরমাণুর সঙ্গে যুক্ত হয় চারটা একই রকম গ্রুপ, সায়ানোফিনাইল। প্রতি গ্রুপের বাইরের দিকে আছে একটা করে সায়ানো গ্রুপ। সায়ানো গ্রুপ আবার আকর্ষিত হয় ধনাত্মক কপারের প্রতি। রবসনের কাজের জন্য আদর্শ অণু।
হীরায় এক কার্বন থেকে আরেক কার্বনের দূরত্ব খুব কম, কিন্তু এই বিশাল অণু দিয়ে ডায়মন্ডের গঠন বানানো গেলে এক কপার থেকে আরেক কপারের দূরত্ব হবে অনেক। এমন গঠনে ভেতরে বেশ ফাঁকা জায়গা থাকা উচিত। তখন পর্যন্ত যে রসায়নবিদ্যা, তাতে যে কেউ ভাবতেন—এমন কিছু বানাতে গেলে কোনো ক্রিস্টাল স্ফটিকাকার গঠন হবে না, বরং নন–ক্রিস্টালাইন বা অস্ফটিক আকৃতির হবে।
গবেষণাগারে ফল এল রবসনের অনুকূলে। কপার আয়ন ও অণুর মধ্যে আকর্ষণে হীরার মতো গঠনই তৈরি হলো। আর অণুগুলোর বিশাল আকৃতির জন্য বিশাল অণুর মধ্যে ফাঁকা জায়গা তৈরি হলো। ক্রিস্টালাইন এই পদার্থে দেখা গেল অনেক ফাঁকা জায়গা। রবসন ১৯৮৯ সালে তাঁর গবেষণা প্রকাশ করলেন জার্নাল অব আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি বা জ্যাকস–এ।
এই মফ তৈরিতে সফল হয়ে রবসন পরপর কয়েকটি একই ধরনের পদার্থ বানিয়ে দেখান। এরই মধ্যে একটা আণবিক গঠনের ফাঁকা জায়গায় একধরনের আয়ন দিয়ে পূর্ণ করেন। এরপর অন্য আরেক আয়ন আছে, এমন তরলে পদার্থগুলো ডুবিয়ে দেখতে পান, আয়ন বিনিময় হচ্ছে। আগের আয়ন তরলে চলে গিয়ে তরল থেকে আয়ন তাঁর তৈরি পদার্থের মধ্যে চলে যাচ্ছে। এভাবে আয়ন বিনিময় দিয়ে তিনি প্রমাণ করেন, এসব অণুত্বে শুধু যে ফাঁকা জায়গা আছে, তা নয়; এর ভেতরে অন্য পরমাণু, আয়ন বা অণুও প্রবেশ করানো যায় মূল গঠনের কোনো ক্ষতি না করেই।
খুব চমৎকার ধর্ম, সন্দেহ নেই। কিন্তু রবসনের বানানো গঠনের স্থায়িত্ব খুব বেশি ছিল না, সহজেই ভেঙে যায়। ফলে অনেক বিজ্ঞানীই এগুলো চমৎকার অণু বলে স্বীকৃতি দিলেও অধিকাংশের কাছে মনে হয় অদরকারি যৌগ হিসেবে। তাই এ ব্যাপারে সামান্যই আগ্রহ দেখা গেছে পরের এক দশক। এই এক দশকে জিনিসটাকে গবেষকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে ভূমিকা রাখেন কিতাগাওয়া ও ওমর ইয়াগি। এবার আমরা তাঁদের কথাই জানব।
কপার আয়ন ও অণুর মধ্যে আকর্ষণে হীরার মতো গঠনই তৈরি হলো। আর অণুগুলোর বিশাল আকৃতির জন্য বিশাল অণুর মধ্যে ফাঁকা জায়গা তৈরি হলো।
২
সুসুমু কিতাগাওয়া অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন চীনা দার্শনিক ঝুয়াংজি দ্বারা। এই দার্শনিকের মতে, যা কিছুই আমরা দরকারি ভাবি, তাকে প্রশ্ন করতে হবে। এখন যা কিছুর দরকার নেই, ভবিষ্যতেও তা অদরকারি থাকবে, এমনটা বলা যায় না। কিতাগাওয়া ফাঁকা জায়গাওয়ালা অণুর গঠন নিয়ে গবেষণা করতে চাইলেন, এমন পদার্থের কোনো দরকার আছে কি না, এ নিয়ে খুব একটা না ভেবেই।
১৯৯২ সালে কিতাগাওয়া প্রথম যে অণুটি বানালেন, তা ছিল দ্বিমাত্রিক; মাঝে বিশাল বিশাল ফাঁকা জায়গা। তিনি সংযোগের জন্য ব্যবহার করেন কপার আয়ন। এই দ্বিমাত্রিক অণু মাঝের ফাঁকা জায়গায় অ্যাসিটোন অণু লুকাতে পারে। এমন কোনো পদার্থের বিশেষ চাহিদা নেই। কিতাগাওয়া যদিও খুব আগ্রহ নিয়ে এ গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু গবেষণার অর্থায়নে তিনি তেমন সফলতা পাচ্ছিলেন না। গবেষণার অর্থায়নের প্রতিষ্ঠানগুলো তাঁর প্রস্তাবকে অদরকারি ভেবে ফান্ড দিচ্ছিল না।
এমন অবস্থায় কিতাগাওয়ার গবেষক দল বড় ব্রেকথ্রু পেল ১৯৯৭ সালে। তাঁরা বাইপিরিডিনকে যুক্ত করলেন কোবাল্ট, নিকেল অথবা জিংক আয়ন দিয়ে। দেখা গেল, এভাবে তৈরি মফ ভেতরে ফাঁকা চ্যানেল বা সুড়ঙ্গের মতো তৈরি করতে পারে। ভেতরের ফাঁকা জায়গার পানি সরিয়ে তাঁরা দেখালেন, মিথেন, অক্সিজেন বা নাইট্রোজেনের মতো গ্যাস এই ফাঁকা জায়গায় আকৃতি পরিবর্তন না করেই প্রবেশ করতে পারে।
এই আবিষ্কারেও অবশ্য গ্র্যান্ট পাওয়া সহজ হয়নি। কারণ, একই রকম গুণ আছে জিওলাইটের। বহু আগে থেকেই এই জিওলাইট আছে। কিতাগাওয়া এরপর ১৯৯৮ সালে বুলেটিন অব কেমিক্যাল সোসাইটি অব জাপান–এ লিখলেন, এ ধরনের আণবিক গঠন বানানোর সুবিধা হলো, ইচ্ছেমতো গঠন তৈরি সম্ভব। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় গুণাগুণ দেওয়া সম্ভব, যাতে বিশেষ কাজে এমন অণু ব্যবহার করা যাবে। এ লেখায় কাজ হলো। তিনিসহ অনেক গবেষকই ফান্ড পেতে শুরু করলেন। এরপর তাঁরা প্রয়োজন অনুযায়ী মফ বানানো শুরু করলেন।
কিতাগাওয়ার প্রায় একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে বসে মেটাল অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্কের কাজ করতে শুরু করেন ওমর ইয়াগি। ১৯৬৫ সালে ওমর ইয়াগির জন্ম জর্ডানের এক শরণার্থী ক্যাম্পে। তাঁর পরিবার ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার সময় ফিলিস্তিনের আল–মাসমিয়া থেকে বাস্তুচ্যুত হয়। তিনি তাঁর পরিবারের সঙ্গে জর্ডানের আম্মানে এক শরণার্থী ক্যাম্পে মাত্র এক রুমের বিদ্যুৎহীন বাসায় থাকতেন, একই ঘরে তাঁদের গৃহপালিত পশুও থাকত। এমন কষ্টের জীবনে স্কুল ছিল তাঁর পছন্দের জায়গা। সেখানেই একদিন গোপনে লাইব্রেরিতে ঢুকে একটা বই খুলে ছবি দেখেন। বইটা ছিল রসায়নের, সেখানেই তিনি প্রথম আণবিক গঠনের কোনো ছবি দেখেন। এভাবেই তাঁর জীবন জড়িয়ে যায় রসায়নের সঙ্গে।
১৫ বছর বয়সে পড়াশোনার জন্য তাঁর বাবা তাঁকে পাঠিয়ে দেন যুক্তরাষ্ট্রে। এখানেই পরবর্তী পড়াশোনা। এ সময়ে তাঁর রসায়নের প্রতি আকর্ষণ হয় নতুন নতুন পদার্থ ডিজাইন করতে পারার আশায়। কিন্তু তাঁর মতে, রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অণু তৈরি খুব অনিশ্চিত প্রক্রিয়া। রসায়নবিদেরা কয়েকটা পদার্থ একসঙ্গে মিলিয়ে সাধারণত তাপ দেন। এরপর রাসায়নিক বিক্রিয়ায় নতুন পদার্থ তৈরি হয়। সমস্যা বাধে, এ প্রক্রিয়ায় কাঙ্ক্ষিত পদার্থের সঙ্গে উৎপন্ন হয় অযাচিত আরও অনেক পদার্থ। ওমর ইয়াগির চিন্তা, এ প্রক্রিয়া কীভাবে আরও নিয়ন্ত্রিত উপায়ে করা যায়।
ওমর ইয়াগির ইচ্ছা ছিল রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটানো লেগোর মতো, একটা পিসের সঙ্গে আরেকটা যুক্ত করে বড় ক্রিস্টাল গঠন তৈরি। তাঁর গ্রুপ প্রথম সফলতা দেখে ১৯৯৫ সালে। তারা দুটি দ্বিমাত্রিক নেটওয়ার্ক তৈরিতে সক্ষম হয়। এ ক্ষেত্রে তারা ব্যবহার করে কপার বা কোবাল্ট আয়ন। কোবাল্ট আয়নের তৈরি নেটওয়ার্কে দেখা গেল, অন্য অণু ঢোকানো যায়। এমন অবস্থায় এই পদার্থ ৩৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা পর্যন্ত স্থিতিশীল থাকে।
১৯৯২ সালে কিতাগাওয়া প্রথম যে অণুটি বানালেন, তা ছিল দ্বিমাত্রিক; মাঝে বিশাল বিশাল ফাঁকা জায়গা। তিনি সংযোগের জন্য ব্যবহার করেন কপার আয়ন।
বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই ধাতব আয়নের সঙ্গে যুক্ত বড় অণুকে বলা হতো কো–অর্ডিনেশন পলিমার। এরপর বিভিন্ন সময় ইনফিনিট পলিমারিক ফ্রেমওয়ার্ক, কো–অর্ডিনেশন নেটওয়ার্কস, নেটওয়ার্ক স্ট্রাকচার্স ইত্যাদি ব্যবহার হয়েছে। ১৯৯৫ সালে নেচারে প্রকাশিত এক নিবন্ধে ওমর ইয়াগি মেটাল অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্ক ব্যবহার করেন। এরপর ধীরে ধীরে নামটি জনপ্রিয় হয়।
ইয়াগির এরপরের বড় সাফল্য ছিল মফ–৫ (এমওএফ–৫) তৈরি। ১৯৯৯ সালে তিনি এই মফের গঠন প্রকাশের পর থেকে ক্ল্যাসিকে পরিণত হয়েছে। এই মফ ৩০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত স্থিতিশীল থাকতে পারে এবং এর মধ্যে এত ফাঁকা জায়গা যে মাত্র এক গ্রাম মফের মধ্যে প্রায় ২ হাজার ৯০০ মিটার স্কয়ার পৃষ্ঠতল আছে, যা একটা ফুটবল মাঠের সমান। পদার্থটি ফোমের মত, কিন্তু এর মধ্যে ছিদ্র হলো আণবিক গঠনেই। এ জন্যই এত ফাঁকা জায়গা। জিওলাইটের চেয়ে এই পদার্থে অনেক বেশি ফাঁকা জায়গা, তাই সহজেই এ পদার্থের গুরুত্ব সবার কাছে ধরা পড়ে।
ইয়াগির গ্রুপ এরপর ২০০২ ও ২০০৩ সালে সায়েন্স ও নেচার জার্নালে দুটি নিবন্ধে দেখায়, মেটাল অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্ক প্রয়োজন অনুসারে পরিবর্তন করা যায়। তারা দেখায়, প্রয়োজনীয় গুণাগুণসম্পন্ন মফ ডিজাইন করে ল্যাবে বানানো সম্ভব। এমনকি তারা নিজেদের বানানো মফ–৫ পরিবর্তন করে দেখায়, এর ভেতরের ছিদ্রের আকার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, প্রয়োজনে ছোট বা বড় ছিদ্রযুক্ত মফ বানানো যায়।
এরপর আসলে ঝড়ের বেগে গবেষকেরা মেটাল অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্ক গবেষণায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। পৃথিবীজুড়ে হাজার হাজার গবেষক মফ নিয়ে গবেষণা করছেন। এখন পর্যন্ত অন্তত এক লাখ এমন ফ্রেমওয়ার্কের গঠন প্রকাশিত হয়েছে। হালের আরেক আকর্ষণ—কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করেও বানানো হচ্ছে মফ।
কথা হচ্ছে, মফের আসলেই ব্যবহার কোথায়? মফ গবেষকেরা বলেন, ব্যবহারের জায়গার অভাব নেই। ওমর ইয়াগির গ্রুপই দেখিয়েছে, অ্যারিজোনার মরুভূমিতে মফ ব্যবহার করে রাতে বাতাস থেকে জলীয় বাষ্প আটকে ফেলা যায় এবং সেই পানি আবার সকালে সূর্যের তাপে বের করে ব্যবহার করা সম্ভব।
তবু অনেকে মনে করেন, মেটাল অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্ক প্রয়োজনের তুলনায় বেশি মনোযোগ পাচ্ছে। গবেষকেরা এক লাখ পদার্থের গঠন প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সরাসরি এই পদার্থ কাজে লাগছে, এমন সফলতা খুব সামান্য। বড় স্কেলে উদাহরণ দিতে গেলে হাতে গোনা দু–একটি উদাহরণই দেওয়ার থাকে। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সাফল্য রাসায়নিক কোম্পানি বিএসএএফ প্রতিবছর কয়েক শ টন কাফ–২০ (CALF-20) উৎপাদন করছে কানাডায় কার্বন ক্যাপচার টেকনোলজির জন্য। এ ছাড়া কিছু স্টার্টআপ কিছু কাজে মফ ব্যবহার করছে।
তবে এত এত গবেষণার জন্য বিপুল পরিমাণ টাকার দরকার হয়। মফের কার্যকারিতা এখনো বড় স্কেলে দেখা না গেলেও অধিকাংশের বিশ্বাস, অনেক সমস্যার সমাধানেই মফ ব্যবহার করা যাবে। এ জন্যই এই ফিল্ডের গবেষণায় বিপুল পরিমাণ অর্থায়ন বেশ অনেক বছর ধরেই চলছে, তেমন কোনো পরিবর্তন অবশ্য এখনো হয়নি। এ ছাড়া ল্যাব স্কেলে অনেক গবেষক দেখিয়েছেন, কার্বন ক্যাপচার, পানি পরিশোধন, পানিকে লবণমুক্ত করা, বিক্রিয়ার ক্যাটালিস্ট বা অনুঘটক হিসেবে, পিফ্যাসের (PFAS) মতো ক্ষতিকর দূষকের রাসায়নিক ছাঁকনি ইত্যাদিতে মেটাল অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্ক সফলতার সঙ্গে ব্যবহার করা যাবে। এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, ল্যাব স্কেল থেকে এসব মফ শিল্পকারখানায় লাভজনক উপায়ে উৎপাদনের পদ্ধতি খুঁজে বের করা।
শেষ করা যাক মফসংক্রান্ত লেখকের একটি পর্যবেক্ষণ দিয়ে। ফ্রেমওয়ার্কগুলো তৈরি হয় একই ধরনের গঠন পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে। তাই যেকোনো মফের ছবি দেখলেই নানা প্রতিসাম্য বা সিমেট্রি চোখে পড়ে। অনেকটা ইসলামিক আর্টের জ্যামিতিক গঠনের মতো। এসব জ্যামিতিক গঠন দেখতে অসম্ভব সুন্দর। বৈজ্ঞানিক ও ব্যবহারিক গুরুত্বের বাইরে তাই এসব গঠনের শৈল্পিক আবেদনও হয়তো গবেষকদের অনুপ্রাণিত করে। কারণ, বিভিন্ন সেমিনারে গবেষকেরা গর্বের সঙ্গে তাঁদের তৈরি সুন্দর সুন্দর ফ্রেমওয়ার্কের ছবি দেখাতে পছন্দ করেন। এ সময় গবেষকদের সঙ্গে দর্শকও মুগ্ধ হন।