একুশ শতকের অন্যতম সেরা ও বহুল ব্যবহৃত আণবিক কাঠামোর আবিষ্কারকদের নোবেল জয়

এ বছর রসায়নে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে বিজ্ঞানী সুসুমু কিতাগাওয়া, রিচার্ড রবসন এবং ওমর এম ইয়াঘিকে। ‘ধাতব-জৈব কাঠামো’ নামে নতুন একধরনের আণবিক কাঠামো আবিষ্কারের জন্য তাঁদের এ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এই কাঠামো কী? কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ? রসায়নে নোবেল জয়ী এ গবেষণার আদ্যোপান্ত…

চলতি বছর রসায়নে নোবেল পেলেন সুসুমু কিতাগাওয়া, রিচার্ড রবসন এবং ওমর এম ইয়াঘিছবি: নোবেল প্রাইজ ডটঅর্গ

এ বছর রসায়নে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে বিজ্ঞানী সুসুমু কিতাগাওয়া, রিচার্ড রবসন এবং ওমর এম ইয়াঘিকে। ‘ধাতব-জৈব কাঠামো’ বা ‘মেটাল-অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্ক’ নামে নতুন একধরনের আণবিক কাঠামো আবিষ্কারের জন্য তাঁদের এ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এই কাঠামো কী? কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?

বিশাল এক বাড়ির কথা ভাবুন। আপনার জন্য নয়, পানির অণুর জন্য এই বাড়ি সত্যিই বিশাল। আয়েশ করে থাকার ব্যবস্থা যাকে বলে! সারা বিশ্বের বহু গবেষণাগারে গত কয়েক দশকে বানানো হয়েছে এরকম অনেক আণবিক বাড়ি। এই বাড়িই সেই ধাতব-জৈব কাঠামো।

এ ধরনের বহুরকম কাঠামো বানানো যায়। এগুলো বিশেষভাবে ডিজাইন করতে হয়। কোনোটি কার্বন ডাই-অক্সাইডকে আটকানোর জন্য বিশেষভাবে নকশা করা, তো কোনোটি পানি থেকে পার-এবং পলিফ্লুরোঅ্যালকাইল পদার্থ বা পিএফএএস(PFAS) আলাদা করার জন্য, শরীরের ভেতরে নির্দিষ্ট জায়গায় ওষুধ পৌঁছে দেওয়া কিংবা অত্যন্ত বিষাক্ত গ্যাস নিয়ন্ত্রণের জন্য। এতক্ষণে হয়তো বুঝতেই পারছেন, বাড়ি না বলে একে চাইলে প্যাকেটও ভাবতে পারেন আপনি। প্রতিটি কাজের জন্য বিশেষভাবে নকশা বা ডিজাইন করতে হয় প্যাকেটের। এই প্যাকেটে চাইলে ফল থেকে নির্গত ইথিলিন গ্যাস আটকে রাখা যায়, তখন ফলটা ধীরে ধীরে পাকে। এরকম আরও বহু ব্যবহার আছে এই কাঠামোর।

এই কাঠামো বলি, বা প্যাকেট—কিংবা কাব্য করে বলা যায় ‘অণুদের ঘর’—ধাতব-জৈব কাঠামো যে বেশ কাজের, এটুকু নিশ্চয়ই এতক্ষণে স্পষ্ট। ইতিহাসে প্রথম এ ধরনের ধাতব-জৈব কাঠামো বানিয়েছেন এবারের নোবেল জয়ী তিন বিজ্ঞানী, তুলে ধরেছেন এর অপার সম্ভাবনা। তাঁদের কাজের ওপর ভিত্তি করে আজ রসায়নবিদেরা হাজারো ধরনের ভিন্ন ভিন্ন ধাতব-জৈব কাঠামোর নকশা করছেন, বানাচ্ছেন—এবং এভাবে রসায়নের জগতে তৈরি হচ্ছে নতুন সব বিস্ময়।

এই বিস্ময়ের সূচনা এক ক্লাসিক রসায়ন ক্লাস থেকে। শিক্ষার্থীরা তখন রড আর বল দিয়ে অণুর মডেল বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা জানত না, এই খেলতে খেলতে শেখার মাধ্যমে সূচনা হচ্ছে ইতিহাসের। যে ইতিহাস জয় করে নেবে রসায়নে নোবেল পুরস্কার ২০২৫।

আরও পড়ুন

কাঠের মডেল থেকে নতুন ধরনের আণবিক গঠন আবিষ্কার

সেটা ১৯৭৪ সালের কথা। রিচার্ড রবসন তখন অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্নের শিক্ষক। তাঁর কাঁধে চাপানো হয়েছে গুরু দায়িত্ব—কাঠের বল দিয়ে পরমাণুর মডেল তৈরির ব্যবস্থা করতে হবে। এই মডেল দিয়ে শিক্ষার্থীরা আণবিক কাঠামো বানাবে।

এ জন্য কাঠের গোলকগুলোতে ছিদ্র করতে হবে। এই ছিদ্রে বসবে কাঠের দণ্ড (রাসায়নিক বন্ধন বোঝাবে এগুলো)। খাপে খাপে মিলতে হবে, তবেই তৈরি করা যাবে বিভিন্ন পরমাণুর মডেল। খাপ বা ছিদ্রের অবস্থান আবার সব ক্ষেত্রে একরকম হবে না। পরমাণু অনুযায়ী আলাদা হবে। সেটাই স্বাভাবিক। নাইট্রোজেন মৌলের দুটি অণু যেভাবে বন্ধন তৈরি করে, কার্বন বা ক্লোরিন তো আর সেভাবে বন্ধন তৈরি করে না। প্রতিটির গঠন আলাদা, কাজেই প্রতিটি বন্ধন (দণ্ড) পরমাণু ভেদে গোলকের (পরমাণু) ভিন্ন জায়গায় বসবে, সে জন্যই ছিদ্র করতে হবে সেই নির্দিষ্ট জায়গা বুঝে।

তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্কশপের সাহায্য নিতে হলো রবসনকে। তিনি ওদের নির্দিষ্ট করে বলে দিলেন, কোথায় ছিদ্রগুলো করতে হবে।

ওয়ার্কশপ থেকে কাঠের বলগুলো ফেরত এল। রবসন কয়েকটি অণু তৈরি করে পরীক্ষা করে দেখলেন, ঠিকঠাক আছে কি না। এমন সময়ই এল যুগান্তকারী চিন্তাটা। তিনি উপলব্ধি করলেন, বলগুলোতে গর্তের অবস্থানের মধ্যে লুকিয়ে আছে বিপুল পরিমাণ তথ্য। ছিদ্র কোথায় করা হয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করে মডেলের অণুগুলো আপনাতেই সঠিক আকার এবং কাঠামো পেয়ে যাচ্ছে। এই উপলব্ধি থেকে এল পরবর্তী ধারণা—তিনি যদি শুধু পরমাণুর বদলে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের অণুকে যুক্ত করতে পরমাণুর ভেতরে লুকিয়ে থাকা অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যগুলো ব্যবহার করেন, তাহলে কী হবে? তিনি কি নতুন ধরনের আণবিক কাঠামো বানাতে পারবেন?

আরও পড়ুন

***

প্রতি বছর নতুন শিক্ষার্থীদের পড়ানোর জন্য এ ধরনের কাঠের মডেল বানাতে হতো রবসনকে। প্রতিবারই তাঁর মাথায় এই চিন্তা আসত। এভাবে, শুধু ভাবতে ভাবতে এবং আর কিচ্ছু না করে কেটে গেল এক দশক। অবশেষ—অবশেষে রবসন ভাবলেন, বিষয়টা পরীক্ষা করেই দেখা যাক না!

হীরার গঠন মনে ধরল খুব। এতে প্রতিটি কার্বন পরমাণু আরও চারটি কার্বন পরমাণুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে ছোট পিরামিড আকারের কাঠামো তৈরি করে (দ্বিতীয় ছবিতে বিষয়টা দেখানো হয়েছে)। এরকম একটা সরল কাঠামো নিয়েই শুরু করলেন তিনি। কিন্তু এই কাঠামোটা কার্বন নয়, বরং ধনাত্মক চার্জযুক্ত তামার আয়ন (Cu+) দিয়ে বানানো। যেনতেন ভাবে এই আয়নটা বেছে নেওয়া হয়নি। কার্বনের মতোই, কপার আয়নও চারপাশে চারটি ভিন্ন পরমাণুর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, সে জন্যই এটাকে বেছে নেওয়া।

এরপর কপার আয়নের সঙ্গে চার বাহুযুক্ত একটা অণুকে যুক্ত করে দিলেন রবসন। অণুটা হলো—4',4'',4''',4''''-টেট্রাসায়ানোটেট্রাফেনাইলমিথেন। নাম দেখে ভয় পাবেন না, এই জটিল নাম মনে রাখার কোনো দরকার নেই। শুধু এটুকু জানলেই হবে যে এর প্রতিটি বাহুর শেষে ‘নাইট্রাইল’ নামে একটি রাসায়নিক গ্রুপ ছিল, এই গ্রুপটি ধনাত্মক চার্জযুক্ত কপার আয়নের প্রতি আকৃষ্ট হয় (ছবি ২)।

সে কালের বেশির ভাগ রসায়নবিদ হয়তো ধরেই নিতেন, কপার আয়ন এবং চার-বাহুযুক্ত অণুকে একসঙ্গে যুক্ত করলে যে জঞ্জাল তৈরি হওয়ার কথা, সেটাকে খাঁটি বাংলায় বলা যায় ‘কাকের বাসা’। কিন্তু রবসনের অনুমান ঠিক ছিল। দেখা গেল, কপার আয়ন এবং সেই অণুর পারস্পরিক আকর্ষণের ফলে মিলেঝিলে একটা বিশাল আণবিক কাঠামো তৈরি হয়েছে। হীরায় কার্বন যেমন সুশৃঙ্খল এবং প্রশস্ত স্ফটিকাকার কাঠামো তৈরি করে, একইরকম ক্রিস্টাল কাঠামো পাওয়া গেল এ ক্ষেত্রে। হীরার সঙ্গে এর অমিলও আছে একটা। হীরা বেশ ঘনবদ্ধ কাঠামোর যৌগ। আর রবসনের তৈরি আণবিক কাঠামোটায় আছে বিশাল সব আণবিক গহ্বর। (এখানে যতবার আমরা বড় বা বিশাল বলব, সেটাকে আণবিক পরিসরে ধরতে হবে। ডাইনোসর-ধ্বংসকারী উল্কাপিণ্ডের আঘাতে সৃষ্ট চিক্সুলুব খাদের মতো বিশাল গহ্বরের কথা ভাববেন না, প্লিজ!)

নতুন ধরনের এই রাসায়নিক আবিষ্কারের কাহিনি প্রকাশের উদ্যোগ নিলেন রবসন। সেটা ১৯৮৯ সাল। অবশেষে জার্নাল অব দ্য আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি-তে প্রকাশিত হলো তাঁর এ গবেষণার কথা। সে গবেষণাপত্রে তিনি আশা প্রকাশ করলেন—অনেকের মতে, খানিকটা ‘বাড়িয়ে’ বললেন—এভাবে হয়তো নতুন ধরনের পদার্থ তৈরি করা যেতে পারে। এসব পদার্থকে হয়তো এমন সব বৈশিষ্ট্য দেওয়া যাবে (অবশ্যই কৃত্রিমভাবে), যেগুলোর কথা আগে কেউ কল্পনাও করেনি। তাঁর আশা, এ জিনিস মানবজাতির অনেক কাজে লাগবে।

আজ আমরা জানি, তিনি একদমই বাড়িয়ে বলেননি। রবসন ভবিষ্যৎ বুঝতে পেরেছিলেন।

আরও পড়ুন

নষ্ট জিনিসও কাজে লাগে—কিতাগাওয়া

সুসুমু কিতাগাওয়া তাঁর পুরো গবেষণা-জীবনেও ‘নষ্ট জিনিসের উপযোগিতা’ খুঁজে ফিরেছেন। ছাত্রজীবনে নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী হিদেকি ইউকাওয়ার একটি বই পড়েছিলেন তিনি। ইউকাওয়া মেসন কণা আবিষ্কার করেছিলেন, এবং এরই সূত্র ধরে পরে আবিষ্কৃত হয়েছিল শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বল। যা-ই হোক, সেই বইয়ে ইউকাওয়া প্রাচীন চীনা দার্শনিক ঝুয়াংজির কথা বলেছেন। এই দার্শনিক বলতেন, আমরা আসলে ‘উপকারী’ বলতে কী বুঝি বা বোঝাই, এ নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ আছে। কোনো জিনিস তাৎক্ষণিকভাবে কাজে না লাগলেও পরে কাজে লাগতে পারে।

এই দর্শনের অনুসারী কিতাগাওয়া যখন ছিদ্রযুক্ত আণবিক কাঠামো তৈরির সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন, তখন এর উপযোগিতা বা সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ থাকতেই হবে—এমন কিছু তাঁর মাথায় ছিল না। ১৯৯২ সালে তিনি যখন নিজের প্রথম আণবিক কাঠামোটি উপস্থাপন করেন, ওটা আসলেই তেমন কাজের কিছু ছিল না। জিনিসটা ছিল একটা দ্বি-মাত্রিক পদার্থ, ভেতরে গহ্বর আছে, ওর মধ্যে অ্যাসিটোন অণু লুকিয়ে থাকতে পারত।

জিনিসটা কাজের না হলেও অণু তৈরির এই পদ্ধতি আণবিক কাঠামো তৈরিতে নতুন ধারার সূচনা করে। এ ক্ষেত্রে কিতাগাওয়াও রবসনের মতো কপার আয়নকেই ‘ইট’ হিসেবে ব্যবহার করেছেন এবং সেটাকে জুড়ে দিয়েছেন বিশাল আরেক অণুর সঙ্গে।

দুনিয়ার সবাই শুধু গবেষণার জন্য গবেষণার মানে বোঝেন না। কাজেই ফান্ডিং বা অনুদান চেয়ে আবেদন করে বারে বারে প্রত্যাখ্যাত হতে থাকেন কিতাগাওয়া। যে জিনিস কোনো কাজে লাগে না, তার পেছনে টাকা বিনিয়োগের কোনো অর্থ খুঁজে পাননি বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু এই বিজ্ঞানী হাল ছাড়েননি।

তাঁর প্রথম বড় সাফল্য আসে ১৯৯৭ সালে। কোবাল্ট, সঙ্গে নিকেল বা জিঙ্ক আয়ন এবং 4,4'-বাইপিরিডিন নামে একটি অণু ব্যবহার করে তাঁর দলের গবেষকেরা ত্রি-মাত্রিক ধাতব-জৈব কাঠামো তৈরি করে। এর ভেতরে একধরনের খোলা পানিভর্তি সুড়ঙ্গ ছিল (ছবি ৩)। নমুনা থেকে পানি সরিয়ে ফেলে বিজ্ঞানীরা দেখলেন, পানি ছাড়াও কাঠামোটা স্থিতিশীল আছে। ভেতরের সুড়ঙ্গ এখন খালি। সেটা চাইলে গ্যাস দিয়ে ভরে ফেলা যায়। পদার্থটির আকার স্থিতিশীল থাকে, বদলে যায় না—ওভাবেই সেটা মিথেন, নাইট্রোজেন এবং অক্সিজেন শোষণ ও ত্যাগ করতে পারে।

সমস্যা হলো, জিওলাইট (Zeolites) নামে একটা পদার্থ আবিষ্কৃত হয়েছে বহু আগে। সেটা সিলিকন ডাই-অক্সাইড দিয়ে বানানো যায়, এবং ওতেও এরকম গহ্বর আছে। সেটাও গ্যাস শোষণ করতে পারে। একই রকম আরেকটা জিনিস বানানোর মানে তাহলে কী? প্রশ্নের উত্তর যেহেতু নেই, বিনিয়োগকারীদের মন গলল না। কিতাগাওয়া তবু হাল ছাড়লেন না। তিনি বুঝলেন, এই ধাতব-জৈব কাঠামো কেন অনন্য, এর কারিশমা আসলে কী—তা মানুষকে বোঝাতে হবে। ১৯৯৮ সালে তিনি বুলেটিন অব দ্য কেমিক্যাল সোসাইটি অব জাপান-এ তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখলেন।

লিখলেন, জিওলাইটের সঙ্গে এর একটা বড় পার্থক্য, এ ধরনের কাঠামো বিভিন্ন ধরনের অণু দিয়ে বানানো সম্ভব। ফলে বিভিন্ন জায়গায় এ কাঠামো কাজে লাগানো সম্ভব। আবার জিওলাইট শক্ত, কিন্তু ধাতব-জৈব কাঠামো নমনীয়ও হতে পারে। ব্যাস, এবারে কাজ হলো। ফান্ডিং মিলল—এবং নিজের দলকে নিয়ে নমনীয় ধাতব-জৈব কাঠামো বানাতে শুরু করলেন কিতাগাওয়া। ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রে তখন আরেক রাসায়নিক অভিযানে নেমেছেন ওমর ইয়াঘি।

আরও পড়ুন

ইয়াঘির হাত ধরে রসায়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচন

ওমর ইয়াঘি যে রসায়ন পড়বেন, সে কথা তাঁর ছোটবেলায় বললে কেউ বিশ্বাস করত না। তিনি নিজেও বিশ্বাস করতেন কি না, সন্দেহ আছে! স্বাভাবিক। জর্ডানের আম্মান শহরে বেশ কটি ভাইবোনকে নিয়ে তাদের বাস। সেখানে বিদ্যুৎ নেই, নেই পানি। ঘর মাত্র একটা। ওর মধ্যেই জীবনযাপন। কঠিন এ জীবনে তাঁর একটুকরো আশ্রয় ছিল স্কুল।

তখন তাঁর বয়স দশ। সে সময় একদিন তিনি স্কুলের লাইব্রেরিতে লুকিয়ে ঢুকে পড়লেন। বন্ধই থাকত লাইব্রেরিটা। কিন্তু সেদিন কোনো কারণে খোলা ছিল। লুকিয়ে চুরিয়ে সেই লাইব্রেরির এক তাক থেকে তুলে নিলেন একটা বই। খুলে দেখেন, দুর্বোধ্য সব ছবি, কিন্তু তবু চোখ সরাতে পারছেন না। আণবিক কাঠামোর সঙ্গে সেই তাঁর প্রথম পরিচয়।

১৫ বছর বয়সে বাবার কড়া নির্দেশে পড়াশোনার জন্য পাড়ি জমালেন যুক্তরাষ্ট্রে। রসায়নের প্রতি এবং নতুন পদার্থ ডিজাইনের প্রতি ততদিনে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন ইয়াঘি। কিন্তু বুঝতে পারছেন, নতুন অণু তৈরির প্রচলিত পদ্ধতি ঠিক অনুমানযোগ্য নয়। অর্থাৎ, আগে থেকে বোঝা যায় না, জিনিসটা কী তৈরি হবে।

১৯৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে একদল গবেষককে নিয়ে তিনি যখন কাজ শুরু করেন, তখন ভাবলেন, রাসায়নিক পদার্থ তৈরির আরও নিয়ন্ত্রিত কোনো উপায় খুঁজে বের করা যায় কি না। তাঁর লক্ষ্য ছিল, লেগোর টুকরোর মতো বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানকে যুক্তিসঙ্গত নকশার মাধ্যমে জুড়ে দিয়ে বড় আকারের ক্রিস্টাল বা স্ফটিক তৈরি করা।

অবশেষে তাঁর দলের গবেষকেরা যখন ধাতব আয়নের সঙ্গে জৈব অণু মেশাতে শুরু করেন, তাঁরা সফল হন। ১৯৯৫ সালে ইয়াঘি দুটি ভিন্ন দ্বি-মাত্রিক পদার্থের কাঠামো প্রকাশ করেন। এগুলো জালের মতো, কপার বা কোবাল্ট দিয়ে সংযুক্ত। কোবাল্ট দিয়ে তৈরি কাঠামোটির খালি জায়গায় অন্য অণু রেখে দেওয়া যায়। জায়গা পুরোপুরি ভরে গেলে সেটা এত স্থিতিশীল হয়ে ওঠে যে ৩৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাতেও ভেঙে পড়ে না। বিশ্বখ্যাত নেচার জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে ইয়াঘি এই পদার্থের সবিস্তার বর্ণনা দেন। তিনিই প্রথম এর নাম দেন ‘ধাতব-জৈব কাঠামো’ (Metal-organic framework—MOF)।

১৯৯৯ সালে ইয়াঘি MOF-5 দেখিয়ে গোটা বিশ্বকে চমকে দেন। ধাতব-জৈব কাঠামোর জগতে এটি ছিল এক মাইলফলক। ‘ক্লাসিক’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে গেছে এই কাঠামো। কারণ, এটি অত্যন্ত প্রশস্ত এবং স্থিতিশীল আণবিক কাঠামো। খালি থাকা অবস্থায়ও এটি ৩০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সহ্য করতে পারত। অবিচল এই কাঠামো এত প্রচণ্ড তাপেও ভেঙে পড়ত না। তার ওপর এর ভেতরে আছে বিপুল প্রশস্ত গহ্বর বা গর্ত। মাত্র কয়েক গ্রাম MOF-5-এর অভ্যন্তরীণ পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল একটা ফুটবল মাঠের সমান! এর মানে, জিওলাইটের চেয়ে অনেক বেশি গ্যাস শোষণ করতে পারে।

আরও পড়ুন

দিকে দিকে ধাতব-জৈব কাঠামোর জয়

২০০২ এবং ২০০৩ সালে ওমর ইয়াঘি ধাতব-জৈব কাঠামোর ভিত্তিকে চূড়ান্ত রূপ দেন। সায়েন্স এবং নেচার জার্নালে প্রকাশিত দুটি প্রবন্ধে তিনি দেখান, ধাতব-জৈব কাঠামোকে যুক্তিসঙ্গতভাবে পরিবর্তন করে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য দেওয়া সম্ভব। তিনি MOF-5-এর ১৬টি ভিন্ন সংস্করণ তৈরি করেন। এগুলোর কোনোটির ভেতরের গহ্বর ছিল মূল (প্রথম তৈরি) কাঠামোর চেয়ে বড়, কোনোটি আবার ছিল ছোট (ছবি ৬)। এর একটি সংস্করণ বিপুল পরিমাণে মিথেন গ্যাস সংরক্ষণ করতে পারে। ইয়াঘির মতে, প্রাকৃতিক গ্যাসে চালিত যানবাহনে এটি ব্যবহার করা যেতে পারে।

এরপর থেকেই বিশ্বজুড়ে ধাতব-জৈব কাঠামোর ব্যবহার চলছেই। ইয়াঘির দল অ্যারিজোনার মরুভূমির বাতাস থেকে পানি সংগ্রহ করেছে। রাতের বেলা তাদের তৈরি ধাতব-জৈব কাঠামো বাতাস থেকে জলীয় বাষ্প শোষণ করত। সকালে যখন সূর্য উঠে পদার্থটিকে গরম করত, তখন বিজ্ঞানীরা সেই পানি সংগ্রহ করতে পারতেন।

এমআইএল-১০১ (MIL-101) নামের একটি কাঠামোর ভেতরে আছে বিশাল গহ্বর। দূষিত পানিতে অপরিশোধিত তেল এবং অ্যান্টিবায়োটিকের ভাঙনের ক্ষেত্রে অনুঘটক হিসেবে ব্যবহৃত হয় এটি। পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে হাইড্রোজেন বা কার্বন ডাই-অক্সাইড সংরক্ষণ করতে পারে। এরকম কোনো কাঠামোর আছে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণের অবিশ্বাস্য ক্ষমতা, কোনোটি পানি থেকে সরাতে পারে দূষক পদার্থ, কোনোটি স্বাভাবিক চাপে হাইড্রোজেন সংরক্ষণ ও নির্গমনের জন্য বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়।

হাইড্রোজেনের বিষয়টা নিয়ে একটুখানি বলা উচিৎ। যানবাহনের জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেন ব্যবহৃত হতে পারে, কিন্তু সাধারণ উচ্চ-চাপের ট্যাঙ্কে এই গ্যাস অত্যন্ত বিস্ফোরক। এ ক্ষেত্রে ধাতব-জৈব কাঠামো বেশ কাজের—হাইড্রোজেন সংরক্ষণ এবং নিরাপত্তায় (যেহেতু প্রচণ্ড তাপ সহ্য করতে পারে) ব্যবহৃত হয়।

নোবেল কমিটির দেওয়া বিবৃতিতে তারা লিখেছে, ‘অনেকে মনে করেন, ধাতব-জৈব কাঠামো হয়ে উঠতে পারে একুশ শতকের সেরা পদার্থ।’ কারণ, ওপরে যা বললাম, এরকম বহু বহু জায়গায় এ ধরনের কাঠামো ব্যবহার হচ্ছে। আসলেই এটি সেরা হয়ে উঠবে কি না, আমরা জানি না। কিন্তু মানুষের জন্য এটি যে বিজ্ঞানের অন্যতম সেরা ও বিস্ময়কর এক উপহার, তা নিশ্চয়ই আলাদা করে বলার দরকার নেই।

সূত্র: নোবেল প্রাইজ ডটঅর্গ