পিঁপড়া সমাজে রানিকেই ছিঁড়ে খেল প্রজারা, কিন্তু কেন

নিজস্ব উপনিবেশ গড়ার ঝুঁকিপূর্ণ পথে রাণীরা। সফল হলেও নিস্তার নেই, সবসময়ই থাকে পরজীবী রাণীর আক্রমণের ভয়ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স

জীববিজ্ঞানী ই.ও. উইলসনের মতে, পিঁপড়ারা পৃথিবীর সবচেয়ে যুদ্ধবাজ প্রাণী। এদের দুই দলের মারামারির কাছে মানুষের বড় বড় যুদ্ধও নাকি নস্যি! কিন্তু সবসময় কি গায়ের জোরেই রাজ্য জয় করা যায়? না। মাঝেমধ্যে দরকার হয় ছলনা, আর ঠান্ডা মাথার গোয়েন্দাগিরি।

সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা এক অদ্ভুত ও লোমহর্ষক ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন। তাঁরা দেখেছেন, একদল পিঁপড়া তাদের নিজেদের পরম আদরের রানিকে মেরে ফেলছে! অথচ এই রানিই কিন্তু ওদের জন্মদাত্রী মা। মজার ব্যাপার হলো, এই হত্যাকাণ্ডের কলকাঠি নাড়ছে বাইরের এক অনুপ্রবেশকারী।

কেন এই অঘটন

একটি নতুন পিঁপড়ার কলোনি বা সাম্রাজ্য গড়ে তোলা খুব কঠিন কাজ। একজন নতুন রানিকে নিরাপদ জায়গা খুঁজতে হয়, ডিম পাড়তে হয়, এবং প্রথম প্রজন্মের শ্রমিকদের বড় করে তুলতে হয়। এই পুরো সময়ে পদে পদে থাকে মৃত্যুর ভয়। একটু ভুল হলেই সব শেষ।

পিঁপড়ারা সংঘবদ্ধভাবে কলোনি করে বসবাস করে।
ফাইল ছবি

তাই কিছু কিছু প্রজাতির স্ত্রী পিঁপড়া একটা বুদ্ধি বের করেছে। তারা ভাবে, এত কষ্ট করে শূন্য থেকে সাম্রাজ্য বানানোর কী দরকার? তার চেয়ে অন্যের তৈরি সাজানো গোছানো একটা রাজ্য দখল করে নিলেই তো হয়!

জার্মান গবেষক এরিক ফ্রাঙ্ক একে বলছেন, পরিশ্রম না করে অন্যের তৈরি শহরের দখল নেওয়া। কিন্তু সমস্যা হলো, ওই রাজ্যে তো একজন রানি আগে থেকেই আছে। হাজার হাজার প্রহরী তাকে পাহারা দিচ্ছে। তাহলে উপায়?

আরও পড়ুন
সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা এক অদ্ভুত ও লোমহর্ষক ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন। তাঁরা দেখেছেন, একদল পিঁপড়া তাদের নিজেদের পরম আদরের রানিকে মেরে ফেলছে! অথচ এই রানিই কিন্তু ওদের জন্মদাত্রী মা।

জাপানের কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা ল্যাবরেটরিতে এই ক্যু বা ক্ষমতা দখলের পুরো প্রক্রিয়াটি দেখেছেন। ঘটনাটি ঘটে অনেকটা স্পাই থ্রিলার মুভির মতো। প্রথমে অনুপ্রবেশকারী স্ত্রী পিঁপড়াটি যে কলোনি দখল করতে চায়, সেই কলোনির কয়েকটা শ্রমিক পিঁপড়ার গায়ের সঙ্গে গা ঘষে। উদ্দেশ্য, ওদের গায়ের গন্ধটা নিজের গায়ে মেখে নেওয়া। ফলে প্রহরীরা তাকে নিজেদের লোক ভেবে ভুল করে এবং কলোনির ভেতরে ঢুকতে দেয়।

এরপর ছদ্মবেশ নিয়ে সে সোজা চলে যায় রানির খাস কামরায়। রানির কাছে পৌঁছেই সে এক অদ্ভুত কাজ করে। নিজের পেট থেকে এক ধরনের তরল পিচকারির মতো ছুড়ে মারে রানির গায়ে। এই তরল ফরমিক অ্যাসিড হতে পারে।

পিঁপড়া রানির অনুগত সৈন্যরা ভুল বুঝে রানিকেই আক্রমণ করে।
ছবি: কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়

এই তরলটাই হলো আসল মারণাস্ত্র। এতে রানি মারা যায় না ঠিকই, কিন্তু তার গায়ের গন্ধ বদলে যায়। ওই তরলটি আসলে এক ধরনের বিপদ সংকেত। মুহূর্তের মধ্যে রানির অনুগত সৈন্যরা ভুল বুঝে আসল রানিকেই আক্রমণ করে। অথচ একটু আগেও রানির জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত ছিল এসব সৈন্যরা। আসলে ওই রাসায়নিকের গন্ধে সৈন্যরা ভাবে, এই রানিই আসলে শত্রু বা কোনো বড় বিপদ! ব্যস, হাজার হাজার শ্রমিক ওদের নিজেদের মায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কামড়ে, খামচে মেরে ফেলে নিজেদের রানিকে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটাই সম্ভবত প্রথম কোনো ঘটনা যেখানে সন্তানকে দিয়ে মাকে খুন করানো হলো!

আরও পড়ুন
রানির কাছে পৌঁছেই অনুপ্রবেশকারী স্ত্রী পিঁপড়া এক অদ্ভুত কাজ করে। নিজের পেট থেকে এক ধরনের তরল পিচকারির মতো ছুড়ে মারে রানির গায়ে। এই তরল ফরমিক অ্যাসিড হতে পারে।
পিঁপড়ারা পৃথিবীর সবচেয়ে যুদ্ধবাজ প্রাণী।
ছবি: অ্যালেক্স ওয়াইল্ড

নতুন রানির রাজত্ব

আসল রানি মারা যাওয়ার পর, সেই অনুপ্রবেশকারী বহুরূপী পিঁপড়াটি সিংহাসনে বসে। যেহেতু তার গায়ে শ্রমিকদের গন্ধ মাখা আছে, তাই সবাই তাকেই নতুন রানি হিসেবে মেনে নেয়। এরপর ওই কলোনির শ্রমিকরা সারাজীবন এই সৎমায়ের সেবা করে এবং তার সন্তানদের লালন-পালন করে।

অন্ধকারে মাটির নিচে এই নাটকটি ঘটে বলেই পিঁপড়ারা চোখে দেখার চেয়ে গন্ধের ওপর বেশি নির্ভর করে। আর সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই এক বহুরূপী দখল করে নেয় আস্ত এক সাম্রাজ্য।

লেখক: ফ্রন্টেন্ড ডেভলপার, সফটভেঞ্চ

সূত্র: এনপিআর ও লাইভ সায়েন্স

আরও পড়ুন