সমুদ্রতলের অদ্ভুতুড়ে কিছু প্রাণীর কথা

কল্পনায় লেখক-সাহিত্যিকেরা কত বিচিত্র সব প্রাণীর কথাই-না ভাবেন! বিজ্ঞান কল্পগল্পে দেখা মেলে ভিনগ্রহবাসী অদ্ভুত সব জীবের। কিন্তু পৃথিবীতেই আছে এমন অচিনপুর, যেখানে বাস করা প্রাণীদের দেখলে আপনি ভেবে বসতে পারেন সাক্ষাৎ এলিয়েন! এই অচিনপুর আর কিছু নয়, সমুদ্রের গভীর তলদেশ।

সমুদ্র গভীরের সেই অচিনপুরের নিগুঢ় অন্ধকারে বাস করে আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতায় অনেকটা অপরিচিত অদ্ভুতূড়ে সব প্রাণী। গবেষকেরা দেখেছেন, এদের কোনো কোনোটি এই অতল অন্ধকারে টিকে আছে কোটি কোটি বছর। এরা একদম স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয়, এই পৃথিবীতেই বহু অজানা রয়ে গেছে আজও আমাদের। মনে করিয়ে দেয়, পৃথিবীর বুকে এখনও লুকিয়ে আছে এমন অনেক রহস্য, যার কোনো কুলকিনারা পাইনি আমরা আজও। অদ্ভুত এসব প্রাণী আমাদের গ্রহটির অভাবনীয় সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের আদর্শ উদাহরণ।

অ্যাবিসোপেলাজিক অঞ্চল অন্ধকার, যেখানে সূর্যের আলো কখনো পৌঁছায় না। সমুদ্রের এই অঞ্চল ভূপৃষ্ঠ থেকে ৪-৬ হাজার মিটার, অর্থাৎ ১৩-২০ হাজার ফুট গভীরে।

ভূমিকা দীর্ঘ না করে বলি, অদ্ভুতুড়ে এসব প্রাণীর আবাসস্থলটা কেমন। মেক্সিকো ও হাওয়াইয়ের মাঝখানে বিপুল বিস্তৃত প্রশান্ত মহাসাগরের রহস্যময় ক্লারিওন ও ক্লিপারটন অঞ্চল। সেখানেই সমুদ্রবিজ্ঞানীরা খোঁজ পেয়েছেন এসব প্রাণীর। এরা বাস করে অ্যাবিসোপেলাজিক অঞ্চলের অন্ধকারে, যেখানে সূর্যের আলো কখনো পৌঁছায় না। সমুদ্রের এই অঞ্চল ভূপৃষ্ঠ থেকে ৪-৬ হাজার মিটার, অর্থাৎ ১৩-২০ হাজার ফুট গভীরে। এই অঞ্চলের তাপমাত্রা প্রায় ২-৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৩৬-৩৭ ডিগ্রি ফারেনহাইটের মধ্যে থাকে। এখানে পানির চাপ ৭৬ এমপিএ (৭৫০ এটিএম বা বায়ুমণ্ডলীয় চাপ) পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এ অঞ্চলটি গভীর সমুদ্রের তিন-চতুর্থাংশজুড়ে বিস্তৃত।

আরও পড়ুন

কীভাবে এ অঞ্চলে প্রাণীদের খোঁজ পেলেন বিজ্ঞানীরা? সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফি সেন্টার পরিচালিত সিবেড মাইনিং অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স টু এক্সপেরিমেন্টাল ইম্প্যাক্ট (স্মার্টেক্স) মিশনে অংশগ্রহণকারী আন্তর্জাতিক গবেষকদের একটি দল ৩,৫০০-৫,৫০০ মিটার বা ১১,৪৮০-১৮,০৪৫ ফুট গভীরে একটি রিমোটলি অপারেটিং ভেহিকল বা আরওভি, অর্থাৎ দূরনিয়ন্ত্রিত ডুবোযান পাঠিয়েছেন। সেই ডুবোযানের ক্যামেরাতেই মিলেছে এসব প্রাণীর খোঁজ। এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল—নামের বাংলা থেকেই বোঝা যায়—সমুদ্রতলের খনি এবং পরীক্ষামূলক আঘাতে স্থিতিস্থাপকতা নিয়ে গবেষণা।

স্বচ্ছ সমুদ্রশসা

অ্যাবিসোপেলাজিক অঞ্চলে পাওয়া অন্যতম আকর্ষণীয় আবিষ্কার স্বচ্ছ সমুদ্রশসা। ইংরেজি নাম, সি-কিউকাম্বার। তবে স্বচ্ছ এ সমুদ্রশসার ডাকনাম দেওয়া হয়েছে ‘ইউনিকাম্বার’। এটি এলপিডিআই পরিবারের সদস্য। না, সত্যি সত্যি শসা নয় এগুলো, দেখতে শসার মতো। সে জন্যই অমন নাম। দেহ নরম, যদিও দেহপৃষ্ঠের নিচে কিছু অস্থি থাকে। আরওভির ক্যামেরায় তোলা ছবিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এই স্বচ্ছ সমুদ্রশসার পরিপাকতন্ত্র। একদম ভরপেট! পেট পুরে খেয়ে অস্বাভাবিক দীর্ঘ লেজ নেড়ে ছুটছে। এই লেজ এরা ব্যবহার করে সাঁতারের জন্য। এই অভিযানে আবিষ্কৃত প্রাণীদের মধ্যে এসব সমুদ্রশসাই ছিল আকারে সবচেয়ে বড়। এরা সমুদ্রের তলদেশে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার হিসেবে কাজ করে। সাগরতলের পলিযুক্ত পরিবেশে টিকে থাকার জন্য বিশেষভাবে অভিযোজিত এরা।

সূক্ষ্ম গ্লাস স্পঞ্জ

আরও পাওয়া গেছে সূক্ষ্ম গ্লাস স্পঞ্জ—কাপ আকৃতির একধরনের ‘ফিল্টার ফিডার’। পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘজীবী প্রাণীদের একটি এরা। বাঁচে প্রায় ১৫ হাজার বছর পর্যন্ত। প্রশ্ন হলো, ‘ফিল্টার ফিডার’ কী? আসলে, সমুদ্রতলের এসব অঞ্চলে খাদ্যের জন্য বেশির ভাগ প্রাণীকে নির্ভর করতে হয় মেরিন স্নোর ওপর। না, সত্যিকারের তুষার নয়। শামুক, ঝিনুক বা এরকম প্রাণীর খোলস, বিভিন্ন মৃত জীবদেহের অংশবিশেষ, মৃত উদ্ভিদ বা প্ল্যাঙ্কটন, বালু ইত্যাদি ঝরে পড়ে ওপর থেকে। সে জন্যই এর নাম মেরিন স্নো, ঝরে পড়া তুষারের মতো খাদ্য। তবে শুধু এই খাদ্য দিয়ে সব প্রাণীর চলে না। তখন অনেক প্রাণীকে পানি থেকে ছোট জীব ও পলি খেতে হয়। সেগুলো এরা খায় একধরনের বিশেষ ‘ফিল্টার’ অঙ্গের মাধ্যমে। এ অঙ্গে পানি প্রবেশ করে, সেই সঙ্গে প্রবেশ করে এসব ছোট খাদ্য। সে জন্যই এসব প্রাণীকে বলা হয় ফিল্টার ফিডার।

আরও পড়ুন
সূক্ষ্ম গ্লাস স্পঞ্জ—কাপ আকৃতির একধরনের ‘ফিল্টার ফিডার’। পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘজীবী প্রাণীদের একটি এরা। বাঁচে প্রায় ১৫ হাজার বছর পর্যন্ত।
দীর্ঘ দেহের একটি ট্যানাইড ক্রাস্টেশিয়ান

এ ছাড়াও এ অভিযানে পাওয়া গেছে দীর্ঘ দেহের একটি ট্যানাইড ক্রাস্টেশিয়ান—দেখতে অনেকটা কৃমির মতো। পাওয়া গেছে সমুদ্রতারা বা সি-স্টার, প্রবাল এবং অ্যানিমোন। সঙ্গে পাওয়া গেছে আকর্ষণীয় বার্বি রঙের গোলাপী সমুদ্রশূকর বা সি-পিগ। এরাও একধরনের সমুদ্রশসা—অ্যাম্পেরিনা গণের অন্তর্গত, এলপিডিডাই পরিবারের সদস্য। মোটা ও ফোলা দেহের এসব প্রাণীর রং বিখ্যাত বার্বি পুতুলের মতো গোলাপী। ছোট ছোট পা দিয়ে সমুদ্রের তলদেশে ঘুরে বেড়ায় এরা।

গোলাপী সমুদ্রশূকর বা সি-পিগ

অদ্ভুত এসব প্রাণীর ব্যাপারে অনেক কিছুই এখনো অজানা। সুইডেনের গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামুদ্রিক পরিবেশবিদ টমাস ডালগ্রেন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘পৃথিবীর এ অঞ্চলগুলোর ব্যাপারেই আমরা সবচেয়ে কম জানি। এগুলো সবচেয়ে কম অন্বেষণ করা হয়েছে। আমাদের অনুমান, এখানে বাসকারী প্রতি দশটি প্রাণিপ্রজাতির মাত্র একটির বৈজ্ঞানিক বর্ণনা রয়েছে। বাকিগুলো আজও বিজ্ঞানের কাছে অজানা।’ তিনি আরও বলেন, ‘অনুসন্ধানকারীদের আওতার বাইরে রয়ে গেছে, এমন অঞ্চল খুব কমই আছে পৃথিবীতে। এ অভিযানের মাধ্যমে যেন ১৮ শতকে ফিরে গেছি আমরা। নতুন নতুন প্রজাতি আবিষ্কৃত হচ্ছে, বাস্তুতন্ত্রের ব্যাপারে জানা যাচ্ছে নতুন সব তথ্য। এটা খুবই উত্তেজনাকর ব্যাপার।’

অ্যানিমোন

এসব প্রাণী সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ব্যাপক গবেষণা প্রয়োজন। তবে এটুকু স্পষ্ট যে সমুদ্র তলদেশের এই জীববৈচিত্র্যের দিকে আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে আমাদের। এদের সুরক্ষার ব্যপারে উদ্যোগ নিতে হবে। প্রশান্ত মহাসাগরের ক্লারিওন ও ক্লিপারটন অঞ্চলে বর্তমানে গভীর সমুদ্র খননের কাজ চলছে গবেষণাকাজে। তবে সে জন্য যেন সামুদ্রিক বাসস্থানে কোনো প্রভাব না পড়ে, লক্ষ্য রাখতে হবে সে দিকে। এ ছাড়াও প্লাস্টিক দূষণসহ আরও নানাভাবে দূষিত হচ্ছে সমুদ্র। এসব দূষণ কমিয়ে আনতে হবে। তা না হলে একসময় ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে বিপুল সামুদ্রিক প্রাণবৈচিত্র্য।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ, ঢাকা

সূত্র: সাইন্স এলার্ট, উইকিপিডিয়া