ভাইরাস দিয়েই ব্যাকটেরিয়া মারার নতুন অস্ত্র আবিষ্কার করলেন বিজ্ঞানীরা
এককোষী ব্যাকটেরিয়ার মস্তিষ্ক বা রক্ত নেই। কিন্তু তবুও ব্যাকটেরিয়া ঠিক আমাদের মতোই একটা জটিল উপায়ে নিজের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে! যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির আণবিক জীববিজ্ঞানী জশুয়া মডেলের কাছে এই ধারণাটি এখনও মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো। মানে এককথায় মাইন্ড ব্লোয়িং।
বিজ্ঞানীরা প্রায় ২০ বছর আগেই আবিষ্কার করেছিলেন, ব্যাকটেরিয়ার ক্রিসপার নামে এক ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আছে। এই ব্যবস্থাটি ওদের ফেইজ নামে শত্রু ভাইরাসকে মনে রাখতে সাহায্য করে। পরের বার সেই ভাইরাসকে দেখলেই ওরা চিনে ফেলে এবং ধ্বংস করতে পারে। কিন্তু এই পুরো প্রক্রিয়াটা কীভাবে ঘটে? ব্যাকটেরিয়া ঠিক কীভাবে শত্রুর বিরুদ্ধে নিজেকে ভ্যাকসিনেটেড করে?
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সেল হোস্ট অ্যান্ড মাইক্রোব জার্নালে প্রকাশিত এক নতুন গবেষণায় জীববিজ্ঞানী জশুয়া মডেল এবং তাঁর দল ঠিক এই রহস্যেরই সমাধান করেছেন। তাঁদের এই আবিষ্কার হয়তো একদিন অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়াদের হারাতে সাহায্য করবে। এগুলোর কারণেই বর্তমানে লাখ লাখ মানুষ মারা যায়।
বিজ্ঞানীরা প্রায় ২০ বছর আগেই আবিষ্কার করেছিলেন, ব্যাকটেরিয়ার ক্রিসপার নামে এক ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আছে। এই ব্যবস্থাটি ওদের ফেইজ নামে শত্রু ভাইরাসকে মনে রাখতে সাহায্য করে।
ক্রিসপার রহস্য কী ছিল
ক্রিসপার সিস্টেম ব্যাকটেরিয়াকে নিজের ডিএনএ সম্পাদনা করার ক্ষমতা দেয়। যখন কোনো ভাইরাস ব্যাকটেরিয়াকে আক্রমণ করে, তখন ব্যাকটেরিয়া একটি বিশেষ এনজাইম ব্যবহার করে ওই ভাইরাসের ডিএনএর ছোট্ট একটা টুকরো কেটে নেয়। এই টুকরোকে বলে স্পেসার। এরপর ব্যাকটেরিয়া এই স্পেসার বা শত্রুর ডিএনএর টুকরোটি নিজের ডিএনএর ভেতর গেঁথে রাখে।
এই পদ্ধতিটা অনেকটা শত্রুর ছবি তুলে রাখার মতো! পরেরবার যখন ওই একই ভাইরাস আক্রমণ করে, ব্যাকটেরিয়া তখন এই ছবিটা মিলিয়ে দেখেই তাকে চিনে ফেলে এবং ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এতদিন এটাই বুঝতেন না যে, একটা ভয়ানক যুদ্ধের মাঝখানে ব্যাকটেরিয়া ঠিক কখন, কীভাবে এই ছবিটা তোলার সময় পায়? জশুয়া মডেল বলেন, ‘আমরা এটাকে ক্রিসপার রহস্য বলতাম, কারণ আমরা বুঝতেই পারছিলাম না ভেতরে ঠিক কী ঘটছে।’
এই রহস্য সমাধানের জন্য বিজ্ঞানীদের আগে ভাইরাসের ফেইজ চরিত্রটা বুঝতে হয়েছে। এই ভাইরাসগুলো ব্যাকটেরিয়ায় ঢোকার পর দুটো কাজ করতে পারে। প্রথমত, ব্যাকটেরিয়ার কোষের ভেতরে ঢুকেই তোলপাড় শুরু করে। দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে এবং সবশেষে কোষটিকে ফাটিয়ে বের হয়ে যায়। এটা হলো সরাসরি যুদ্ধ। আর দ্বিতীয়ত, ভাইরাসটি ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএর ভেতরে চুপচাপ লুকিয়ে পড়ে এবং ঘুমন্ত অবস্থায় চলে যায়। এই ঘুমন্ত অবস্থাটা নিয়ে গবেষণা করা ভীষণ কঠিন।
যখন কোনো ভাইরাস ব্যাকটেরিয়াকে আক্রমণ করে, তখন ব্যাকটেরিয়া একটি বিশেষ এনজাইম ব্যবহার করে ওই ভাইরাসের ডিএনএর ছোট্ট একটা টুকরো কেটে নেয়। এই টুকরোকে বলে স্পেসার।
মডেলের দল তখন একটি দারুণ পরীক্ষা চালান। তাঁরা স্ট্রেপটোকক্কাস পায়োজেনেস ব্যাকটেরিয়াকে এমন ভাইরাস দিয়ে সংক্রমিত করেন, যারা ঘুমন্ত অবস্থায় যেতে পারে। পাশাপাশি, তাঁরা কিছু ব্যাকটেরিয়াকে এমনভাবে তৈরি করা ভাইরাস দিয়ে সংক্রমিত করেন, যারা শুধু সক্রিয় থাকতেই বাধ্য। কখনোই ঘুমাতে পারে না।
এরপর তারা বেঁচে যাওয়া ব্যাকটেরিয়াগুলোকে সংগ্রহ করে তাদের ডিএনএ পরীক্ষা করেন। তাঁরা দেখতে চাইলেন, কোন কোন ভাইরাসের স্পেসার সংগ্রহ করতে পেরেছে। ফলাফল ছিল একদম স্পষ্ট! বিজ্ঞানীরা দেখলেন, ব্যাকটেরিয়া কেবল সেই ভাইরাসগুলোর ডিএনএ সংগ্রহ করতে পেরেছে, যারা তাদের ভেতরে ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল।
যে ভাইরাসগুলো সরাসরি যুদ্ধ শুরু করেছিল, তাদের বিরুদ্ধে ব্যাকটেরিয়া কোনো স্মৃতি বা স্পেসার তৈরি করতে পারেনি। কারণ, সেই যুদ্ধে ব্যাকটেরিয়া এত দ্রুত মারা যাচ্ছিল যে, তার স্পেসার নেওয়ার সময়ই পায়নি!
জশুয়া মডেল ব্যাখ্যা করেন, যখন ভাইরাসটি নিষ্ক্রিয় বা ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে, তখন ব্যাকটেরিয়া কিছুটা সময় পায়। এই শান্ত সময়েই সে ধীরেসুস্থে ওই ঘুমন্ত ভাইরাসের ডিএনএর একটা টুকরো কেটে নিয়ে নিজের স্মৃতিতে সংরক্ষণ করে ফেলে। ক্রিসপার সিস্টেম ভাইরাসের এই নিষ্ক্রিয় রূপটির বিরুদ্ধেই স্মৃতি তৈরি করে, ঠিক যেভাবে আমাদের ভ্যাকসিন কাজ করে।
তাঁরা আরও পরীক্ষা করে দেখেছেন, যে ব্যাকটেরিয়াগুলো এভাবে ভ্যাকসিনেটেড হয়েছে, পরেরবার সেই একই ভাইরাস আক্রমণ করতে এলে তারা খুব সহজেই তাকে চিনে ফেলে এবং যুদ্ধ করে হারিয়ে দেয়!
বিজ্ঞানীরা দেখলেন, ব্যাকটেরিয়া কেবল সেই ভাইরাসগুলোর ডিএনএ সংগ্রহ করতে পেরেছে, যারা তাদের ভেতরে ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল।
এই আবিষ্কার কেন এত গুরুত্বপূর্ণ
নেদারল্যান্ডসের ডেলফ্ট ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী স্ট্যান ব্রাউন্স এই আবিষ্কারকে ‘অসাধারণ’ বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ, আমরা এখন অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছি। আমাদের এমন ব্যাকটেরিয়া মারার জন্য নতুন অস্ত্র দরকার, যা অ্যান্টিবায়োটিকেও মরে না। এই নতুন অস্ত্রের নাম হলো ফেইজ থেরাপি। অর্থাৎ, ভাইরাস দিয়েই ব্যাকটেরিয়াকে মারা!
কিন্তু ব্যাকটেরিয়াও খুব চালাক। ওদেরও বাঁচার জন্য ১৫০টিরও বেশি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আছে। এই নতুন গবেষণা আমাদের বুঝতে সাহায্য করল, ব্যাকটেরিয়ার সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা— ক্রিসপার—কীভাবে কাজ করে।
এখন বিজ্ঞানীরা এমনভাবে ফেইজ থেরাপি বা ভাইরাস ডিজাইন করতে পারবেন, যা ব্যাকটেরিয়ার এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকেই ফাঁকি দিতে পারবে, অথবা ব্যাকটেরিয়াকে ভ্যাকসিনেটেড হওয়ার সময়ই দেবে না! এটা সংক্রামক রোগের চিকিৎসায় এক নতুন দুয়ার খুলে দিতে পারে।