গুলবাগিচায় বুলবুলি তুই

ছবি: উইকিপিডিয়া

পাঁচতলার জানালার কার্নিশ পেরিয়েও ওপরের দিকে ছড়িয়ে পড়েছে বয়সী আমড়াগাছটার শাখা-প্রশাখা। জানালার রঙিন থাই গ্লাস খুলে পাকা আমড়া পাড়া যায় হাত বাড়িয়ে। একটু দূরেই একটা বারোমাসি কামরাঙা গাছ! হরেক রকম পাখি গাছ দুটিতে ঘোরাফেরা করে সারা দিন। দোয়েল-শালিক (৩ প্রজাতি), টুনটুনি, বুলবুলি, টিয়া, নীলটুনি, কাঠঠোকরা, ফিঙে (ক্বচিৎ আসে), কোকিল-হলদে বউ, বসন্তবৌরি ইত্যাদি পাখি। জানালা বন্ধ রাখলে ওরা আমাকে দেখতে পায় না—আমি খুব কাছ থেকে দেখতে পাই ওদের, কেননা থাই গ্লাসের বাইরে থেকে ওরা আমাকে দেখতে পায় না। এই সুযোগে আমি জানালার পাশে বসে ওদের মজার কাণ্ডকারখানা উপভোগ করি। যেমন প্রজনন মৌসুমে ফিঙেরা এসে বসে জানালায়—কাচের ভেতরে নিজেদের প্রতিবিম্ব দেখে প্রতিদ্বন্দ্বী নিজের  ভাবে। দারুণ আক্রোশে আস্ফালন করে আর প্রতিদ্বন্দ্বীকে লক্ষ করে কাচের ওপরে ঠোকরাতেই থাকে। প্রতিবিম্বও তো একই কাজ করে! অতএব, আসল পাখিটা আরও খেপে যায়। জানালার কাচে নাক-চোখ মিশিয়ে মাত্র দু-তিন ইঞ্চি দূর থেকে আমি দেখি ওদের। ফিঙেদের কী রোষ! চোখ লাল। দৃষ্টি ভয়ংকর।

ছবি: আ ন ম আমিনুর রহমান

একই কাজ করে শালিক, টিয়া, নীলটুনি ও দোয়েলরাও। দারুণ মজার কাণ্ডই বটে! এটা ওরা করে আশপাশে বাসা যখন করে, তখন। গত ৯ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত আমি গ্রামের বাড়িতে ছিলাম। আমার নবনির্মিত বাড়িটার থাই গ্লাসে যেন রুটিন করে রোজই সকালে ছাতারে-ফিঙে ও দোয়েলরা মাঝেমধ্যে এসে একই কাজ করত। উপভোগ করেছি দারুণভাবে। বাড়িটি ফাঁকাই পড়ে থাকে। গেঁয়োই রয়ে গেছে! ঢাকার পাখিরা দু-এক দিন বাদেই ভুলটা বুঝতে পারে।

ঢাকার বাসার পাঁচতলায় বরাবরের মতো এক সকালে জানালার কাচে ঠোকাঠুকি শুনে তাকিয়ে দেখি একটি বুলবুলিকে। এপ্রিল চলছে। বাসা বাঁধার ভরা মৌসুম চলছে ওদের। জানালার পাশে যাই। মাত্র এক ফুট দূরের চমত্কার সরু তে-ডালার মধ্যে মেয়ে বুলবুলি চোখে পড়ে! পরিবারের অন্যদের ডেকে দেখালাম—দেখালাম না সাত বছর বয়সী নাতিটিকে। কেননা ওর নজরে পড়লে অতি কৌতূহলে ও বুলবুলি দম্পতিকে তিষ্ঠোতে দেবে না।

ছানাদের বয়স যখন ১৪ দিন হলো, তখন বাসা ছেড়ে বসল পাশের একখানা সরু ডালে।

মেয়েটি কেবল বাসার ভিত রচনা করেছে—সাজিয়েছে দু-চার গাছি সরু-শুকনো লতা ও অন্যান্য উপকরণ। পুরুষটি কাচে ঠোঁট চালিয়েই যাচ্ছে ঠকঠক শব্দে। দু-পাঁচ দিন বাদেই ক্ষান্ত দেবে।

মেয়েটি ডাকাডাকি-লাফালাফি করে উপকরণ আনতে উড়ে যায় দূরে, পুরুষটি পাশে পাশে যায়, আবার ফিরেও আসে। আবারও যায়। এমনিতে এরা সব সময় জোড়ায় জোড়ায় চলে ও থাকে। বাসা বানানো থেকে শুরু করে ডিম-ছানা পাহারা ও ছানাদের স্বাবলম্বী হওয়া পর্যন্ত পুরুষ বউকেসহ সবকিছুই কড়া প্রহরায় রাখে। বাসার আশপাশে কাক-দোয়েল-ফিঙে এলে তেড়ে যায় চরম রোষে।

বাসাটি সম্পূর্ণ হলো সাড়ে ছয় দিনে। কী চমত্কার গোলগাল আঁটসাঁট গড়নের বাটির মতো বাসা! প্রথম ডিমটি পাড়ল একদিন পর। মোট ডিম হলো ৩টি। সাড়ে তেরো দিন তা দেওয়ার পর ছানা ফুটল। ডিমের খোসা মুখে ধরে ওদিকে ফেলে দিয়ে এল। এভাবে ছানাদের বয়স যখন ১৪ দিন হলো, তখন বাসা ছেড়ে বসল পাশের একখানা সরু ডালে। কী সুন্দর ছানারে! লেজ যেন নেই-ই। বোকা বোকা চাহনি। মা খাবার আনতে যায়—যায় বাবাও। তবে, আমড়াগাছে কাক বসলে কীভাবে যেন টের পেয়েই তিরবেগে চলে আসে ধমক মারতে মারতে—ডাইভ মারে কাকদের পিঠের ওপরে।

দিন যায়। ছানারা বাড়ে। এডাল-ওডাল করে। একদিন উড়ে চলে গেল অন্যদিকে। বাসাটা শূন্যই পড়ে রইল। ওই বাসায় আর ফিরবে না কোনো দিন ছানারা। পাখির বাসার এটাই বড় ট্র্যাজেডি!

যে বুলবুলিটার কথা বলা হলো এতক্ষণ, ঢাকা শহরে সেটা প্রচুর আছে। সারা বাংলাদেশেই আছে। ঢাকা শহরের পার্ক-বাগান-উদ্যান-বাড়ির আঙিনাসহ মহাব্যস্ত রাজপথের পাশের গাছপালা-ঝোপঝাড় এমনকী ফুলবাগানেও এদের মহা ব্যস্ত অবস্থায় দেখা যায়। ডাকাডাকি-লাফালাফি করে প্রায় সর্বক্ষণ। খুব সাহসী ও লড়াকু পাখি এরা। এককালে গ্রামবাংলার অনেক মেলায় ‘বুলবুলির লড়াই’ হতো। বাল্যকালে বাগেরহাটের ‘সাধুর গাছতলার মেলায়’ আমি এদের মরণপণ লড়াই দেখেছি।

আরও পড়ুন
মূল খাদ্য ওদের নানান রকম ফল, বিশেষ করে কলা, পেয়ারা, বরই, জাম, জামরুলসহ নানান রকম পোকামাকড়-লার্ভা-ফুলের নরম পাঁপড়ি-মধুরেণু। প্রায় নিয়মিত গোসল করে এরা।

‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল’—গানের কথাগুলো সারা বাংলাদেশ তো বটেই—রাজধানী ঢাকা শহরেও আজও বর্তমান। এই শহরে ফুলবাগান-ছাদবাগানও এখন প্রচুর। বুলবুলিদের খাদ্য প্রাচুর্য আছে এই রাজধানীতে—আছে নিরাপদ আশ্রয় ও বাসা বানানোর জুতসই অনেক স্থান তথা গাছ। গাছের ডাল ছাড়াও এরা পাইপ-কার্নিশ ইত্যাদি জায়গায়ও বাসা করে। ওরা তাই এই রাজধানী ছেড়ে আর যাবে না কোথাও। মূল খাদ্য ওদের নানান রকম ফল, বিশেষ করে কলা, পেয়ারা, বরই, জাম, জামরুলসহ নানান রকম পোকামাকড়-লার্ভা-ফুলের নরম পাঁপড়ি-মধুরেণু। প্রায় নিয়মিত গোসল করে এরা। সুযোগ পেলে পান করে বৃষ্টির জল ও শিশির কণা। ৩০–৪০ বছর আগেও ঢাকা শহর ও শহরতলিতে এদের তাল-খেজুরের রস পান করার সুযোগ ছিল, এখন কী আর আছে!

খুব সাহসী ও লড়াকু পাখি বুলবুলি
ডিম পাড়ে ২-৪টি। ডিম ফোটে ১৪-১৮ দিনে। এটির নাম ‘সিপাহী বুলবুলি’ বা সেনাপতি। শুধু ‘সিপাহী’ নামেও পরিচিত। রেজি নাম রেড–হুইস্কারড বুলবুল।

এই বুলবুলির ইংরেজি নাম রেড–ভেন্টেড বুলবুল। বৈজ্ঞানিক নাম pycnonotus cafer। দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশে এটি ‘ঝুঁটকুলি’ নামে পরিচিত। ‘কুলি’ অর্থ বুলবুলি। দৈর্ঘ্য ২০ সেমি। ওজন ৪২ গ্রাম। এক নজরে মাথায় ঝুঁটিওয়ালা কালচে ধূসর রঙের পাখি। লেজের গোড়ার তলদেশ সিঁদুর-লাল। বুকে ছোট ছোট বাদামি ছিট-ছোপ। চওড়া-চৌকো লেজ। মাথা কালো, চোখ গাঢ় বাদামি। লেজের পালক এরা প্রয়োজনে অনেকটাই ছোট হাতপাখার মতো মেলে দিতে পারে। লেজের তলার পালকের আগা সাদা। নীলচে কালো ঠোঁট, কালচে পা।

ঢাকা শহরে আরও এক প্রজাতির বুলবুলি নজরে পড়ে। খুবই সুদর্শন ওটা—দেখতেও বর্ণিতটার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর। ওদের মাথার চকচকে কালচে খাড়া-সুগঠিত ঝুঁটিটা নান্দনিক সৌন্দর্যে ভরপুর। গলা-বুক-পেট সাদা। চোখের পাশে আলতা রঙের পট্টি। অবসারণী টকটকে লাল। পা ও ঠোঁট কালো। এরাও গোলগাল বাসা বানায় নিচু ঘন ঝোপঝাড় বা ঝোপালো গাছের শাখায়। ডিম পাড়ে ২-৪টি। ডিম ফোটে ১৪-১৮ দিনে। এরাও খায় নানান রকম ফল ও ফুলের নির্যাস। এটির নাম ‘সিপাহী বুলবুলি’ বা সেনাপতি। শুধু ‘সিপাহী’ নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম রেড–হুইস্কারড বুলবুল। বৈজ্ঞানিক নাম pycnonotus jocosus, দৈর্ঘ্য ২০ সেমি। ওজন ২৮ গ্রাম। সংখ্যায় এরা রাজধানীতে খুবই কম।

লেখক: পাখিবিশারদ

*লেখাটি ২০১৯ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মে সংখ্যায় প্রকাশিত

আরও পড়ুন