তিন পায়ের সিংহের হার না মানা গল্প

জ্যাকব চোরাশিকারির ফাঁদে পড়ে তার পিছনের বাম পা হারানছবি: অ্যালেক্স ব্রাসকোস্কি

বনের রাজা সিংহ। তার গাম্ভীর্য, শক্তি, আর শিকার করার কায়দায় একটা রাজকীয় ভাব থাকে। কিন্তু উগান্ডার কুইন এলিজাবেথ ন্যাশনাল পার্কে এমন এক সিংহ আছে, যার গল্পটা সাধারণ কোনো রাজার গল্প নয়। ওটার নাম জ্যাকব।

জ্যাকবের জীবনটা কোনো মুভির ট্র্যাজেডি হিরোর চেয়ে কম নয়। চোরাশিকারিদের পাতা ফাঁদে আটকে তার পেছনের বাঁ পা শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, এক বুনো মহিষের গুঁতোয় সে হারিয়েছে তার একটি চোখও। ভাবুন তো, এক চোখ নেই, এক পা নেই; এমন একটা ভাঙাচোরা সিংহ বনের হিংস্র পরিবেশে কীভাবে টিকে থাকবে?

গবেষক আর বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত ছিলেন, জ্যাকব আর বাঁচবে না। কারণ, সিংহরা সাধারণত দলবেঁধে শিকার করে। আর আহত সিংহরা দলের দয়ায় বেঁচে থাকে কিংবা ছিঁচকে চোরের মতো মরা পশু খেয়ে দিন পার করে। কিন্তু জ্যাকব যে হার মানতে শেখেনি! সে শুধু টিকেই থাকল না, বরং শিকার করার এমন এক নতুন কৌশল রপ্ত করল, যা দেখে গবেষকেরাও অবাক হয়েছেন।

আরও পড়ুন
সিংহরা সাধারণত দলবেঁধে শিকার করে। আর আহত সিংহরা দলের দয়ায় বেঁচে থাকে কিংবা ছিঁচকে চোরের মতো মরা পশু খেয়ে দিন পার করে।

চিতা বাঘের কায়দায় শিকার

সিংহরা সাধারণত খোলা মাঠে দৌড়ে শিকার ধরে। কিন্তু জ্যাকবের তো দৌড়ানোর ক্ষমতাই নেই। তিন পায়ে সে জোরে ছুটবে কীভাবে? তাই বলে কি না খেয়ে মরবে? একদম না। জ্যাকব তার শিকার করার স্টাইলটাই বদলে ফেলল। সে সিংহের স্বভাব ঝেড়ে ফেলে হয়ে উঠল অনেকটা চিতা বাঘের মতো।

আলেকজান্ডার ব্র্যাকজকোস্কি নামে এক গবেষক ২০১৭ সাল থেকে জ্যাকবকে নজরে রাখছেন। প্রথমে তিনিও জ্যাকবের বেঁচে থাকা নিয়ে ধোঁয়াশায় ছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি ড্রোনের থার্মাল ক্যামেরায় ধরা পড়ল জ্যাকবের আসল রহস্য।

জ্যাকব এখন আর খোলা মাঠে শিকার করে না। সে ঘন ঝোপঝাড় আর জঙ্গলের আড়ালে ওত পেতে বসে থাকে। একদম নিঃশব্দে। শিকার যখন খুব কাছে চলে আসে, তখন সে আচমকা লাফিয়ে পড়ে। যেহেতু সে দৌড়াতে পারে না, তাই তাকে বুদ্ধি খাটিয়ে একদম খুব কাছ থেকে আক্রমণ করতে হয়। কখনো কখনো সে গর্ত খুঁড়ে শিকার বের করে আনে, যা সিংহদের স্বভাবে সচরাচর দেখা যায় না।

জ্যাকব শিকার করার জন্য সিংহের স্বভাব ঝেড়ে ফেলে অনেকটা চিতা বাঘের মতো হয়ে উঠেছে
ছবি: ইমার্জিং ডেস্টিনেশনস

খাবারের মেন্যু পরিবর্তন

শুধু শিকারের কায়দা নয়, জ্যাকব তার খাবারের মেন্যুও বদলে ফেলেছে। সাধারণ সিংহরা হরিণ, অ্যান্টিলোপ বা মহিষের মতো বড় আর দ্রুতগতির প্রাণী শিকার করে। কিন্তু জ্যাকব জানে, ওগুলোর পেছনে ছোটার সাধ্য তার নেই। তাই সে টার্গেট করেছে ফরেস্ট হগকে।

এই হগগুলো ওজনে প্রায় ২০০ কেজি হয়। জ্যাকব একাই, কখনো বা তার ভাই টিবুকে সঙ্গে নিয়ে এই বিশাল হগ শিকার করে। এটা সিংহটির জন্য অনেক ঝুঁকির কাজ। কারণ, হগগুলোও বেশ হিংস্র স্বভাবের হয়। কিন্তু পেটের দায়ে জ্যাকব সেই ঝুঁকিটাই নিচ্ছে এবং সফলও হচ্ছে। গবেষক ব্র্যাকজকোস্কি বলছেন, ‘জ্যাকব জানে সে বেশি জোরে দৌঁড়াতে পারবে না। তাই সে তার খাবারের ধরন পরিবর্তন করেছে। এটা তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয়।’

আরও পড়ুন
জ্যাকব এখন আর খোলা মাঠে শিকার করে না। সে ঘন ঝোপঝাড় আর জঙ্গলের আড়ালে ওত পেতে বসে থাকে। একদম নিঃশব্দে। শিকার যখন খুব কাছে চলে আসে, তখন সে আচমকা লাফিয়ে পড়ে।

কুমিরের নদীতে বিশ্বরেকর্ড

জ্যাকবের সাহসের গল্প এখানেই শেষ নয়। গত বছর সে এবং তার ভাই টিবু মিলে কাজিঙ্গা চ্যানেল নামে এক নদী সাঁতরে পার হয়েছিল। নদীটি কুমিরে গিজগিজ করে। অথচ জ্যাকব তার তিন পা নিয়েই প্রায় দেড় কিলোমিটার পথ সাঁতরেছে! সিংহদের ইতিহাসে এত লম্বা পথ সাঁতড়ানোর রেকর্ড আর নেই। গত দুই বছরে সে প্রায় ১০-২০ বার এই নদী পারাপার করেছে। হয়তো খাবারের খোঁজে, কিংবা সঙ্গীর খোঁজে। কিন্তু এক পা ছাড়া কুমিরের মুখে ঝাঁপ দেওয়াটা চাট্টিখানি কথা নয়।

বেঁচে থাকার জীবন্ত প্রতীক

প্রাণী বিশেষজ্ঞ ক্রেগ প্যাকার বা জর্জ শ্যালের মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানীরাও জ্যাকবকে দেখে অবাক। শ্যালের বলেন, ‘ওরা যোদ্ধা প্রজাতি, কিন্তু জ্যাকব এক অনন্য উদাহরণ।’ সাধারণত অঙ্গহানি হলে বন্য প্রাণীরা মারা পড়ে, কিন্তু জ্যাকব প্রমাণ করেছে, খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা থাকলে যেকোনো পরিস্থিতিতেই টিকে থাকা সম্ভব!

লেখক: ফ্রন্টেন্ড ডেভলপার, সফটভেঞ্চ

সূত্র: নিউ সায়েন্টিস্ট

আরও পড়ুন