অচেনা রাস্তায় মস্তিষ্ক কীভাবে নতুন পথ খুঁজে নেয়
প্রতিদিনের মতো অফিস বা ভার্সিটিতে যাচ্ছেন। রাস্তায় দেখলেন বিশাল জ্যাম। বিরক্ত হয়ে বসে আছেন। এমন সময় হঠাৎ আপনার মাথায় এল, ‘আরে! ওই পেছনের গলিটা দিয়ে ঘুরে গেলে তো এতক্ষণে পৌঁছে যেতাম!’
এই যে হুট করে একটা বিকল্প রাস্তার কথা মাথায় এল, এটা কি শুধুই কাকতালীয়? বিজ্ঞানীরা বলছেন, একদমই না। এটা আপনার মস্তিষ্কের এক অসাধারণ জিপিএস সিস্টেমের কারসাজি! এ বিষয়ক গবেষণা পত্রটি সম্প্রতি নেচার কমিউনিকেশনস জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
আমাদের মস্তিষ্কে হিপোক্যাম্পাস নামে একটা অংশ আছে। ইয়েল স্কুল অফ মেডিসিনের গবেষক জর্জ ড্রাগোই এবং তাঁর দল বলছেন, এই হিপোক্যাম্পাস হলো আমাদের মস্তিষ্কের জিপিএস।
গুগল ম্যাপ যেমন রাস্তাঘাট দেখিয়ে দেয়, হিপোক্যাম্পাসও তেমনি আমাদের আশপাশের পরিবেশের একটা কগনিটিভ ম্যাপ তৈরি করে রাখে। তবে এই ম্যাপ কিন্তু মুখস্থ করা ম্যাপ নয়। এটা এতই স্মার্ট যে, আপনি কোনো রাস্তায় আটকে গেলে সে নিজেই কাল্পনিক সব বিকল্প পথ তৈরি করে ফেলতে পারে।
বিজ্ঞানীরা ইঁদুরের ওপর এক মজার পরীক্ষা চালিয়েছেন। ইঁদুরের মস্তিষ্কের গঠন আমাদের মতোই। প্রথমে ইঁদুরগুলোকে একটা সাধারণ গোলকধাঁধায় দৌড়াতে দেওয়া হলো। ওরা রাস্তা চিনে নিল। এরপর ওদের বিশ্রাম দেওয়া হলো। বিজ্ঞানীরা তখন চুপিসারে গোলকধাঁধার একটা অংশ বদলে সেখানে একটা ইউ (U) আকৃতির নতুন রাস্তা জুড়ে দিলেন। এরপর ইঁদুরগুলোকে আবার ছাড়া হলো সেখানে। সবচেয়ে অবাক করা ঘটনাটা ঘটল তখনই। বিজ্ঞানীরা ইঁদুরের মস্তিষ্কের সিগন্যাল রেকর্ড করে দেখলেন, ওই নতুন রাস্তায় পা ফেলার আগেই ইঁদুরগুলোর মস্তিষ্ক ঘুমের মধ্যে বা বিশ্রামের সময় ওই অচেনা রাস্তার কথা কল্পনা করছিল!
মস্তিষ্কে হিপোক্যাম্পাস নামে একটা অংশ আছে। ইয়েল স্কুল অফ মেডিসিনের গবেষক জর্জ ড্রাগোই এবং তাঁর দল বলছেন, এই হিপোক্যাম্পাস হলো আমাদের মস্তিষ্কের জিপিএস।
গবেষক ইউচেন ঝো বলছেন, ‘ইঁদুরের মস্তিষ্ক যেন আগে থেকেই জানত যে সামনে নতুন কোনো চ্যালেঞ্জ বা রাস্তা আসছে। ওরা মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল।’ একে বলা হয় প্রি-ওয়্যারিং। অর্থাৎ, মস্তিষ্ক আগে থেকেই বিকল্প পথের নকশা করে রেখেছিল।
ইঁদুরগুলো যখন ওই নতুন রাস্তায় ঢুকল, তখন ওদের মস্তিষ্কে এক অদ্ভুত খেলা শুরু হলো। বিজ্ঞানীরা দেখলেন, ওদের মস্তিষ্কের কোষগুলো সেকেন্ডের ভগ্নাংশে ফ্লিকার করছে। মানে মস্তিষ্ক একবার ভাবছে, ‘আমি এখন এই নতুন রাস্তায় আছি’, পরক্ষণেই ভাবছে, ‘আগে তো এখানে পুরনো রাস্তাটা ছিল।’ অর্থাৎ, মস্তিষ্ক বর্তমান অবস্থান এবং পুরনো স্মৃতির মধ্যে বারবার লাফালাফি করে ম্যাপটা আপডেট করে নিচ্ছে। এটাকে বিজ্ঞানীরা থিটা ওয়েভ বা বিশেষ মস্তিষ্কের তরঙ্গের কাজ বলছেন।
শেষে যখন ইঁদুরগুলোকে আবার সেই পুরনো রাস্তায় ফিরিয়ে নেওয়া হলো, দেখা গেল ওদের সেই পুরনো ম্যাপ আর আগের মতো নেই। নতুন অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিশে সেটা আপডেট হয়ে গেছে।
শুধু রাস্তা চেনার জন্য নয়, এই গবেষণা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ। গবেষক ড্রাগোই বলছেন, ‘আমাদের মস্তিষ্ক এভাবেই কল্পনা আর স্মৃতির মধ্যে সমন্বয় করে।’
কিন্তু যাদের পিটিএসডি বা ট্রমার সমস্যা আছে, তাদের ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থাটা ঠিকমতো কাজ করে না। তখন পুরনো খারাপ স্মৃতিগুলো বর্তমানের সঙ্গে মিশে যায় এবং মানুষ হ্যালুসিনেশন বা বিভ্রমে ভোগে।
অর্থাৎ, জ্যামে বসে হুট করে কোনো শর্টকাট রাস্তার কথা মাথায় এলেই বুঝবেন, আপনার মস্তিষ্কের জিপিএস পুরোদমে কাজ করছে!