মৌমাছির জীবন: বিজ্ঞান যখন কবিতার মতো মনে হয়

মধুর খোঁজে শর্ষেফুলে মৌমাছিপ্রথম আলোর ফাইল ছবি

মৌমাছি, মৌমাছি

কোথা যাও নাচি নাচি

দাঁড়াও না একবার ভাই।

ওই ফুল ফোটে বনে

যাই মধু আহরণে

দাঁড়াবার সময় তো নাই।

—নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য

প্রাণিজগতের সবচেয়ে বড় পর্ব আর্থোপোডা। পৃথিবীর প্রাণীদের মধ্যে ৪ ভাগের প্রায় ৩ ভাগ আর্থোপোডা পর্বের। এই পর্বের একটা শ্রেণি পোকামাকড়। পৃথিবীটাই যেন পোকামাকড়ের ঘরবসতি। মানবজাতি ওদের সঙ্গে লড়াই করেই বেঁচে আছে। অথবা উল্টোটাও সত্যি হতে পারে। পোকামাকড়ই হয়তো মানবজাতি, তথা অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে লড়াই করে আজও টিকে আছে। মৌমাছি হলো পতঙ্গ শ্রেণিভুক্ত প্রাণী। তবে মশা বা মাছির মতো এরা ‘প্রকৃত পতঙ্গ’নয়। মশা বা মাছির এক জোড়া ডানা আছে। মৌমাছির সামনে ও পিছনের ডানা ছোট হুক দিয়ে যুক্ত হওয়ায় একে দুই ডানা বিশিষ্ট দেখায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মৌমাছির ডানার সংখ্যা দুই জোড়া। এরা হাইমেনোপ্টেরা বর্গের প্রাণী। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পিপীলিকাও একই বর্গের অন্তর্ভুক্ত। যদিও ওদের ডানা নেই।

পিঁপড়ার কলোনিতে একটি রানি পিঁপড়া থাকে। বেঁচে থাকে প্রায় ১৫-৩০ বছর। বংশ বৃদ্ধি করাও ওর দায়িত্ব। মিলনের আগে রানি ও পুরুষ পিঁপড়ার অস্থায়ী ডানা থাকে। মিলনের পর পিঁপড়া প্রায়ই নিজের ডানা চিবিয়ে খেয়ে ফেলে, আর পুরুষ পিঁপড়া মারা যায়। এজন্যই কথায় বলে ‘পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে’। বেচারা পুরুষ পিঁপড়া! রানি পিঁপড়া জীবনে একবার মিলন ঘটিয়ে কয়েক দশক ধরে শুক্রাণু সঞ্চয় করে এবং আর কখনো সে ওড়ে না। হাজার হাজার ডিম পাড়ে এবং ফেরোমোন ছড়িয়ে কলোনি নিয়ন্ত্রণ করে। রানি পিঁপড়া ছাড়াও কলোনিতে ৯০-৯৯ শতাংশ স্ত্রী পিঁপড়া থাকে। তবে স্ত্রী হয়েও তারা প্রজননে অক্ষম। স্ত্রী পিঁপড়াদেরকে ‘কর্মী পিঁপড়া’বলে। কারণ, খাদ্য সংগ্রহ, লার্ভা লালনপালন, প্রতিরক্ষা, পরিষ্কার করার কাজ তারাই করে। এদের কখনো ডানা থাকে না। প্রায় ১০০-১৫০ মিলিয়ন বছর আগে কর্মী পিঁপড়ারা ওদের ডানা হারিয়েছিল। অর্থাৎ ডাইনোসরদের রাজত্বকালে কর্মী পিপড়ারা ডানা হারিয়েছিল।

পরিবেশের জন্য মৌমাছি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের ফুল ও ফসলের জন্য মৌমাছি অপরিহার্য। মৌমাছি কমে গেলে অর্থনীতিতে সমস্যা দেখা দেবে। কিছু ফসল বড় পরিসরে চাষ করা খুব ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে।

মৌমাছিরাও প্রায় ১২০ মিলিয়ন বছর পরিবর্তিত হয়েছিল। এরা শিকার করার পরিবর্তে পরাগ বা নির্যাস খাওয়ার জন্য অভিযোজিত হয়েছিল। তাই পিঁপড়ার মতো এরাও হাইমেনোপ্টেরা বর্গে পড়েছে। তবে পিঁপড়ার পরিবার ফরমিসিডি, আর মৌমাছির অ্যাপিডি। প্রায় ২০ হাজারের বেশি প্রজাতি নিয়ে এই পরিবার গঠিত।

আরও পড়ুন

সাহিত্যে মৌমাছির বিশেষ জায়গা রয়েছে। শৈশবে গল্পে পড়েছিলাম, ‘জুলেখা বাদশার মেয়ে। তার ভারী অহংকার। একদিন সে ফুলপরীকে বাগানে দেখিয়া রাগিয়া গেল এবং বলিল, ‘আমার বাগানে আর আসিবে না’। পরদিন জুলেখার বিবাহ। বাগানে ফুল ফুটিল না। জুলেখা কাঁদিতে লাগিল। এমন সময় ফুলপরী আসিল। জুলেখা তার নিকট মাফ চাহিল। ফুলপরী হাসিয়া উঠিল। সাথে সাথে বাগানে ফুল ফুটিল, পাখিরা গান গাহিল। জুলেখার মনও খুশিতে ভরিয়া উঠিল।’

এই ফুলপরী আর কেউ নয়, মৌমাছি বা প্রজাপতির মতো পরাগায়নকারী পতঙ্গ। পৃথিবী থেকে সব মৌমাছি অদৃশ্য হয়ে গেলে মানুষ মাত্র চার বছর বেঁচে থাকবে। অনেকের ধারণা, কথাটি নাকি বলেছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। আসলেই তিনি এমন কথা বলেছিলেন কিনা, তার সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ নেই। তবে কথাটি কিন্তু অবহেলা করার সুযোগ নেই।

পরিবেশের জন্য মৌমাছি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের ফুল ও ফসলের জন্য মৌমাছি অপরিহার্য। মৌমাছি কমে গেলে অর্থনীতিতে সমস্যা দেখা দেবে। কিছু ফসল বড় পরিসরে চাষ করা খুব ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে। মৌমাছির সংখ্যা হ্রাস মাংস এবং দুগ্ধজাত পণ্যের উৎপাদনকেও প্রভাবিত করতে পারে। জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর ‘কবিতা ও বিজ্ঞান’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘বৈজ্ঞানিক ও কবি, উভয়েরই অনুভূতি অনির্বচনীয় একের সন্ধানে বাহির হইয়াছে। প্রভেদ এই, কবি পথের কথা ভাবেন না, বৈজ্ঞানিক পথটাকে উপেক্ষা করেন না।’ কিন্তু পরাগায়নের বৈজ্ঞানিক বিষয়টিকে কবি কীভাবে দেখছেন? রবিঠাকুর লিখছেন, ‘অলি বার বার ফিরে যায়, অলি বার বার ফিরে আসে, তবে তো ফুল বিকাশে’ অথবা ‘এবার বসন্তে কি রে যুঁথিগুলি জাগে নি রে, অলিকুল গুঞ্জরিয়া করে নি কি মধুপান’। কাজী নজরুল লিখছেন, ‘ব্যথা মুকুলে অলি না ছুঁলে, বনে কি ফুটে ফুল-পতাকা।’

মৌচাকের কোষগুলো হয় ষড়ভুজাকার। কারণ এতে সর্বোচ্চ মধু ধরে। প্রতিটি কোষ সমান এবং নিখুঁতভাবে সাজানো থাকে। ফুলের পরাগরেণু থেকে মৌমাছির মধু আহরণের বিষয়টিও নান্দনিক।

পিপীলিকার মতো মৌমাছিদেরও একটা রানি মৌমাছি থাকে। একটা মৌচাকে মৌমাছির সংখ্যা বেশি হয়ে গেলে এরা নতুন রানি মৌমাছি সৃষ্টি করে। তখন পুরাতন রানি প্রায় ৬০ শতাংশ ‘কর্মী মৌমাছি’ নিয়ে ওই চাক ছেড়ে বেরিয়ে আসে এবং নতুন কলোনি তৈরি করে।

মৌমাছি প্রথমে মৌচাক তৈরি করে না, বরং অস্থায়ীভাবে একটা বাসা খুঁজতে থাকে। জায়গা নির্বাচিত হয়ে গেলে কর্মী মৌমাছিরা তাদের পেট থেকে নিঃসৃত মোম দিয়ে চাক বানানোর কাজ শুরু করে। তাদের সঙ্গে থাকা রানি মৌমাছি নতুন মৌচাকে ডিম পাড়া শুরু করে। এরা দুই ধরনের ডিম পাড়ে—নিষিক্ত ডিম ও অনিষিক্ত ডিম। নিষিক্ত ডিম ফুটে স্ত্রী মৌমাছি বের হয় এবং অনিষিক্ত ডিম থেকে বের হয় পুরুষ মৌমাছি।

আরও পড়ুন

প্রশ্ন হতে পারে, নতুন এই রানি মৌমাছি কখন পুরুষ মৌমাছির সঙ্গে মিলিত হলো? আসলে সে আবার মিলিত হয় না। রানি মৌমাছি একবারই মৌচাক থেকে বেরিয়ে আসে এবং বাতাসে উড়ন্ত অবস্থায় সে অন্যান্য মৌচাক থেকে আসা একাধিক ড্রোনের সঙ্গে মিলন ঘটায়। রানি মৌমাছি প্রয়োজন অনুসারে ডিম নিষিক্ত করার জন্য শুক্রাণু সংরক্ষণ করে ৫-৭ বছরের জন্য। দ্বিতীয় রানি মৌমাছি মৌচাকে ফিরে গিয়ে এই সংরক্ষিত শুক্রাণু ব্যবহার করেই হাজার হাজার ডিম পাড়ে। ডিম থেকে লার্ভা, লার্ভা থেকে পিউপা এবং পিউপা প্রাপ্তবয়স্ক মৌমাছিতে রূপান্তরিত হয়। অর্থাৎ মেটামরফেসিস পুরোটা সম্পন্ন হয়। ডিম থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া কর্মী মৌমাছির আয়ু মাত্র ২১ দিন।

গাছে গাছে ঝুলছে দৃষ্টিনন্দন জামরুল ফুল। সেই ফুলে ঘুরে ঘুরে মধু সংগ্রহ করছে মৌমাছি। শ্রীপুর, গাজীপুর, ১৮ এপ্রিল ২০২৫
ছবি: সাদিক মৃধা

প্রতিটি কর্মী মৌমাছির কাজের ভাগাভাগি নিখুঁত ও পরিকল্পিত। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কাজ পরিবর্তিত হয়। ১ম-৩য় দিন কোষ পরিষ্কার করা, ৩য়-৯ম দিন লার্ভা পরিচর্যা করা, ৯ম-১৬তম দিন নিজেদের মোমগ্রন্থি থেকে মোম নিঃসরণ করা, মোমের দেয়াল তুলে একের পর এক কোষ তৈরি করা এবং মৌচাক পাহারা দেওয়া, ১৬তম দিন-আমৃত্যু পরাগ থেকে মধু আহরণ ও চাকে নিয়ে আসা।

নতুন এই রানি মৌমাছি কখন পুরুষ মৌমাছির সঙ্গে মিলিত হলো? আসলে সে আবার মিলিত হয় না। রানি মৌমাছি একবারই মৌচাক থেকে বেরিয়ে আসে এবং বাতাসে উড়ন্ত অবস্থায় সে অন্যান্য মৌচাক থেকে আসা একাধিক ড্রোনের সঙ্গে মিলন ঘটায়।

মৌচাকের কোষগুলো হয় ষড়ভুজাকার। কারণ এতে সর্বোচ্চ মধু ধরে। প্রতিটি কোষ সমান এবং নিখুঁতভাবে সাজানো থাকে। ফুলের পরাগরেণু থেকে মৌমাছির মধু আহরণের বিষয়টিও নান্দনিক। অবশ্যই তারা ফুলে হুল ফুটায় না। মৌমাছিরা তাদের প্রোবোসিস ব্যবহার করে ফুল থেকে রস টেনে নেয় এবং পেটে সংরক্ষণ করে। তারপর সে রস মধুতে পরিণত করে। ফুলের ক্ষতি হয় না, বরং পরাগায়ন ঘটে। এতে মৌমাছিরও কোনো ক্ষতি হয় না। একটি ভ্রমর প্রতি ভ্রমণে ৫০-১০০টি ফুলে যেতে পারে এবং প্রক্রিয়াটি পুনরাবৃত্তি করতে পারে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার উদ্যোগে ২০১৮ সাল থেকে প্রতিবছর ২০শে মে বিশ্ব মৌমাছি দিবস উদ্‌যাপন করা হয়। এ বছরের বিশ্ব মৌমাছি দিবসের প্রতিপাদ্য ‘Bee inspired by nature to nourish us all’। এর মানে হলো, প্রকৃতির দ্বারা অনুপ্রাণিত মৌমাছি আমাদের সবার পুষ্টি নিশ্চিত করে।

লেখক: জনস্বাস্থ্য ও হাসপাতাল প্রশাসন বিশেষজ্ঞ, গীতিকার এবং প্রবন্ধকার

আরও পড়ুন