শিম্পাঞ্জিদের সুখ-দুঃখের সঙ্গী জেন গুডঅল
শিম্পাঞ্জিরা কি মানুষের মতোই হাসে, কাঁদে কিংবা যুদ্ধ করে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এক তরুণী পাড়ি জমিয়েছিলেন আফ্রিকার গহীন জঙ্গলে। সম্বল ছিল কেবল ধৈর্য আর সাহস। জেন গুডঅল আমাদের শিখিয়েছিলেন প্রাণীর চোখের ভাষা পড়তে। ২০২৫ সালে পৃথিবী হারাল প্রকৃতির এই অকৃত্রিম বন্ধুকে। জঙ্গলের গভীরে শিম্পাঞ্জিদের সঙ্গে তাঁর রোমাঞ্চকর জীবনের গল্প পড়ুন…
২০২৫ সালে বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তিদের মধ্যে জেন গুডঅল অন্যতম। এ বছর আমরা তাঁকে হারিয়েছি। দীর্ঘ জীবন শিম্পাঞ্জিদের জন্য কাজ করে এ বছর ১ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
শিম্পাঞ্জিদের নিয়ে কাজ করার শুরুতে তিনি ছিলেন অন্য গবেষকদের তুলনায় আলাদা। তিনি শুরুতেই শিম্পাঞ্জিদের আলাদা করে নাম দিয়েছিলেন, ঠিক মানুষের নামের মতো। তখন বিষয়টি ভীষণ বিতর্কিত ছিল।
১৯৬০ সাল। সে যুগে বিজ্ঞানীদের শেখানো হতো, যে প্রাণীদের নিয়ে গবেষণা করা হবে, সেগুলোর নাম দেওয়া যাবে না। নাম দিলে নাকি আবেগ জড়িয়ে পড়ে, নিরপেক্ষতা নষ্ট হয়। আজও বিজ্ঞানের বড় অংশে এই ধারণা বহাল আছে। কিন্তু জেন গুডঅল সে ধরনের বিজ্ঞানী ছিলেন না। আসলে তিনি তখন বিজ্ঞানীই ছিলেন না।
বয়স মাত্র ২৬। তাঁর একমাত্র ডিগ্রি ছিল সেক্রেটারিয়াল স্কুলের একটি সনদ। আর এই অভিজ্ঞতার অভাবই তাঁকে কিছুটা সুবিধা দিয়েছিল। বিখ্যাত জীবাশ্মবিদ লুই লিকি ভেবেছিলেন, নতুন চোখ আর নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বন্য শিম্পাঞ্জিদের রহস্যভেদ করা সম্ভব হতে পারে। তাই তিনি জেন গুডঅলকে পাঠান তানজানিয়ার জঙ্গলে।
এই ধারণা যে একেবারেই ভুল ছিল না, তা খুব দ্রুতই প্রমাণিত হয়। দিনের পর দিন, ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায়ই খালি পায়ে জেন ঘুরে বেড়াতেন জঙ্গলে। লক্ষ্য একটাই, শিম্পাঞ্জিদের সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি করা। তিনি দূরে বসে নীরবে নোট করতেন। অপেক্ষা করতেন, এই অদ্ভুত সাদা বনমানুষটিকে শিম্পাঞ্জিরা একদিন মেনে নেয় কি না।
প্রথম কয়েক মাস শিম্পাঞ্জিরা তাঁকে এড়িয়ে চলত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারস্পরিক কৌতূহল জয়ী হয়। ধীরে ধীরে এরা কাছে আসে, এমনকি জেনের ক্যাম্পের ভেতর পর্যন্ত চলে আসে। জেন এদের কলা খাওয়াতেন। শিম্পাঞ্জিরা তাঁকে নিজেদের দলের মতো করে খুঁটে খুঁটে পরিষ্কার করত। তিনিও শিম্পাঞ্জিদের গা হাতড়ে দিতেন। এদের জন্মে আনন্দ করতেন, মৃত্যুর সময় কাঁদতেন।
পরিচয় যত গভীর হতে লাগল, ততই তিনি এদের কাছের একজন হয়ে উঠলেন। নাম দিলেন ডেভিড গ্রেবিয়ার্ড, মিস্টার ম্যাকগ্রেগর, লর্ড ড্রাকুলা, ফ্লো, মেলিসা। বছর পেরোতে পেরোতে জেন গুডঅল যখন বিশ্বের সবচেয়ে খ্যাতিমান শিম্পাঞ্জি বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠলেন, নামের তালিকাও দীর্ঘ হলো। বিথোভেন, ফ্রয়েড, গ্রাউচো, মিডজ—নামের শেষ নেই।
জন্মের সময় জেন গুডঅলের নাম ছিল ভ্যালেরি জেন মরিস-গুডঅল। ইংল্যান্ডের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মেছিলেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন প্রকৃতিপ্রেমী, দুঃসাহসী আর প্রাণী ভালোবাসতেন। একবার তিনি একটি পাখিকে নিজের বইয়ের তাকেই বাসা বাঁধতে রাজি করিয়েছিলেন। তাঁর মা এই আগ্রহগুলোতে উৎসাহ দিতেন, বাবা তাঁর জীবনে অনেকটা অনুপস্থিত ছিলেন। রাতে জেন প্রায়ই স্বপ্ন দেখতেন আফ্রিকা ভ্রমণ করছেন, তাঁর প্রিয় গল্পের নায়কদের মতো।
ওয়েট্রেস আর সেক্রেটারির কাজ করে টাকা জমিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি আফ্রিকায় পৌঁছে যান। শিম্পাঞ্জিদের সঙ্গে যোগাযোগ হওয়ার পর তাঁর জীবনের পথ যেন স্থির হয়ে যায়। পরবর্তী ৬৫ বছর তিনি কাটান শিম্পাঞ্জিদের জীবন নথিবদ্ধ করতে, এদের টিকিয়ে রাখতে। মধ্যবয়সে জঙ্গলে স্থায়ীভাবে থাকা সম্ভব না হওয়ায় তিনি হয়ে ওঠেন পরিবেশকর্মী ও শিক্ষক। বছরের প্রায় ৩০০ দিন পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন বক্তৃতা দিতে। ৯১ বছর বয়সে মৃত্যুর সময়ও তিনি একটি বক্তৃতা সফরের মাঝপথে ছিলেন।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি তাঁর গবেষণার অর্থ জুগিয়েছিল। তাঁকে বানিয়েছিল এক বৈশ্বিক মিডিয়া চরিত্র। মজার ব্যাপার হলো, তাঁর সবচেয়ে যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ছিল শিম্পাঞ্জিরা মাংস খায়, এরা নিজ হাতে সরঞ্জাম বানায় এবং ব্যবহার করে।
ক্যামেরা এই জঙ্গলে পৌঁছানোর আগেই তিনি এগুলো আবিষ্কার করেছিলেন। তখনো বিশ্ব জানত না, জেন গুডঅল দেখতে কেমন। তিনি নিজেও সেটাই চাইতেন। কিন্তু ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বুঝে ফেলেছিল, এখানে এক অসাধারণ দৃশ্যকাহিনি লুকিয়ে আছে। খাকি শর্টস পরা স্বর্ণকেশী এক নারী, আফ্রিকার শিম্পাঞ্জিদের মুখোমুখি হয়ে আছেন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি ছবি তোলার জন্য একজন আলোকচিত্রী পাঠাল। জেনের নির্দিষ্ট ভঙ্গির ছবি তোলার তালিকা দিয়ে দিল। বাইনোকুলার হাতে জেন, হাসছেন জেন, রান্না করছেন জেন, ঝরনার পানিতে চুল ধুচ্ছেন জেন।
তাঁর লেখায় শিম্পাঞ্জিদের সমাজের জটিলতা ফুটে উঠত। হিংসা, দলবদ্ধ হওয়া, বিভক্তি, বিশ্বাসঘাতকতায় ভরা থাকত। শিম্পাঞ্জিরা একে অন্যের সঙ্গে খুনসুটি করে।
জেন এ ব্যাপারটা পছন্দ করেননি। তবু তিনি মেনে নেন। তিনি বুঝেছিলেন, ঠিক যেমন একটি শিম্পাঞ্জি ঘাসের শলাকা দিয়ে উইপোকার বাসা থেকে খাবার বের করে, তেমনি তিনিও খ্যাতিকে কাজে লাগাতে পারবেন। শিম্পাঞ্জিদের নিয়ে গবেষণা এবং এদের সুরক্ষার কাজে লাগবে। বই, প্রবন্ধ, ছবি আর চলচ্চিত্র তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। ১৯৬৫ সালে সিবিএসে প্রচারিত তথ্যচিত্র মিস গুডঅল অ্যান্ড দ্য শিম্পাঞ্জিস দেখেছিল প্রায় আড়াই কোটি মানুষ। সেই তথ্যচিত্রের আলোকচিত্রী ও চিত্রগ্রাহক, ডাচ নাগরিক হুগো ভ্যান লয়িকে গুডঅল বিয়ে করেছিলেন। এই দম্পতির এক ছেলে। সে আংশিকভাবে জঙ্গলেই বড় হয়েছিল। শিম্পাঞ্জিদের আঘাত থেকে বাঁচাতে এই ছেলেকে খাঁচার ভেতরে খেলতে দিতেন তাঁরা।
পরে জেন গুডঅল কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নেন, যা তাঁকে বৈজ্ঞানিক মহলে আরও গ্রহণযোগ্য করে তোলে। কিন্তু তিনি কখনো নিজেকে নিজের কাজ থেকে আলাদা করেননি। বক্তৃতার সময় তিনি মানুষকে আকর্ষণ করতে পারতেন। মানুষের সামনে শিম্পাঞ্জিদের ভাষা অনুকরণ করে দেখিয়ে তিনি সবাইকে মুগ্ধ করতেন। খাবারের গর্জন, সতর্কতার ডাক, আর্তচিৎকার ফুটিয়ে তুলতেন।
তাঁর লেখায় শিম্পাঞ্জিদের সমাজের জটিলতা ফুটে উঠত। হিংসা, দলবদ্ধ হওয়া, বিভক্তি, বিশ্বাসঘাতকতায় ভরা থাকত। শিম্পাঞ্জিরা একে অন্যের সঙ্গে খুনসুটি করে। এদের ঠান্ডা লাগে, পছন্দের খাবার খায়, বেবুনদের ভেজা ডাল নেড়ে বিরক্ত করে। বৃষ্টিতে এরা নাচে, মৃতদের জন্য শোক করে, কখনো কখনো শোকে মরে যায়। তিনি এদের আলাদা আলাদা চিন্তাশীল সত্তা হিসেবে তুলে ধরেন। শিম্পাঞ্জি ডেভিড গ্রেবিয়ার্ডকে নিয়ে তিনি লিখেছেন, এর চোখ ছিল সবচেয়ে সুন্দর; যেখানে ধরা পড়ত আত্মবিশ্বাস, মর্যাদা আর নিজের মতো করে চলার দৃঢ়তা।
তবে শিম্পাঞ্জিরা ভয়ানক সহিংসও হতে পারে। একবার ফ্রোডো নামে এক পুরুষ শিম্পাঞ্জি তাঁর মাথায় এমন জোরে পা দিয়েছিল যে প্রায় তাঁর ঘাড় ভেঙে যাচ্ছিল। তিনি দেখেছেন, আধিপত্য দেখাতে এরা কীভাবে দাঁত বের করে, লোম খাড়া করে, ডাল টেনে টেনে দৌড়ায়। তিনি লিখেছেন শিম্পাঞ্জির বানরশিশু হত্যার দৃশ্য। এমনকি শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে সংঘটিত গণহত্যার মতো ঘটনাও তাঁর লেখায় ফুটে উঠেছে; যার সঙ্গে মানুষের যুদ্ধের অনেক মিল আছে।
মানুষের ডিএনএর প্রায় ৯৯ শতাংশই শিম্পাঞ্জির সঙ্গে মিলে যায়। এরা আয়নায় নিজেকে চিনতে পারে। সাংকেতিক ভাষা শেখে। জিনিসপত্র বাছাই করতে পারে। জেন গুডঅলের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল, তিনি শিম্পাঞ্জিকে কখনো ভয়ের জায়গা থেকে দেখেননি। যতটা সম্ভব, শিম্পাঞ্জিদের কাছে গিয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, অনেক দিন তিনি শিম্পাঞ্জিদের চোখে চোখ রেখে তাকাতে সাহস পেতেন না। ভেবেছিলেন, এতে এরা হুমকি অনুভব করবে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। যদি দৃষ্টিতে কোমলতা থাকে, অহংকার না থাকে, তাহলে শিম্পাঞ্জি তা বুঝতে পারে। তারাও একই দৃষ্টিতে তাকাতে পারে।
এই ছিলেন জেন গুডঅল। একজন মানুষ, যিনি প্রাণীকে ভালোবেসেছিলেন।