কাক বংশপরম্পরায় প্রায় ১৭ বছর ধরে রাগ পুষে রাখতে পারে
সস্তা মুভিতে ভিলেনদের একটা কমন বৈশিষ্ট্য খেয়াল করেছ? তারা বেশ চালাক-চতুর হয়, আর সেই চালাকিটা ব্যবহার করে শয়তানি কাজে। প্রকৃতির রাজ্যেও কিন্তু ব্যাপারটা অনেকটা তেমনই। বুদ্ধি থাকলেই যে সে প্রাণীটা সাধু হবে, এমন কোনো কথা নেই। ডলফিনের কথাই ধরো। এরা এতই বুদ্ধিমান যে নিজেদের মধ্যে রীতিমতো রাজনীতি করে। শিম্পাঞ্জিরা তো আরও একধাপ এগিয়ে। এরা দিব্যি মিথ্যা কথা বলতে পারে এবং অভিনয় করতে পারে।
কিন্তু আজ ডলফিন বা শিম্পাঞ্জি নয়, কথা বলব আমাদের বাড়ির আঙিনার অতি পরিচিত এক পাখিকে নিয়ে। অবহেলায় যাকে আমরা ঝাড়ুদার পাখি বলি, সেই কাকের বুদ্ধির দৌড় শুনলে তোমার পিলে চমকে যাবে। কাকের সঙ্গে যদি একবার বেয়াদবি করেছ তো মরেছ! কারণ কাক এমন এক প্রাণী, যে কিনা নজিরবিহীনভাবে দীর্ঘ সময় ধরে রাগ পুষে রাখতে পারে।
এর পেছনে একটা গল্প আছে। অবশ্য গল্পটা শুনলে বিশ্বাস করতে চাইবে না। বন্য পরিবেশে একটা সাধারণ কাকের গড় আয়ু কত জানো? বড়জোর সাত থেকে আট বছর। কিন্তু ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনের বন্যপ্রাণী বিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং কাক-বিশেষজ্ঞ জন মারজলুফ এক অদ্ভুত দাবি করেছেন। তিনি দেখেছেন, কাকেরা মানুষের ওপর রাগ বা ক্ষোভ মনে রাখতে পারে প্রায় ১৪-১৭ বছর পর্যন্ত!
ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনের বন্যপ্রাণী বিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং কাক-বিশেষজ্ঞ জন মারজলুফ দেখেছেন, কাকেরা মানুষের ওপর রাগ বা ক্ষোভ মনে রাখতে পারে প্রায় ১৪-১৭ বছর পর্যন্ত!
অঙ্কটা মিলছে না তো? কাক বাঁচে ৮ বছর, আর রাগ মনে রাখে ১৭ বছর! এর মানে হলো, যে কাকটার সঙ্গে তুমি খারাপ ব্যবহার করেছিলে, সে মরে যাওয়ার পরেও ওর নাতি-পুতিরা তোমাকে চিনে রাখবে এবং সুযোগ পেলেই ঠোকর মারবে। মানে বংশপরম্পরায় এরা শত্রু চিনে রাখে।
অধ্যাপক মারজলুফ এই পরীক্ষাটা শুরু করেছিলেন ২০০৬ সালে। তিনি দেখতে চেয়েছিলেন, কাকেরা আসলে মানুষের চেহারা মনে রাখতে পারে কি না। তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলের পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় গিয়ে ৭ থেকে ১৫টি কাক ধরেন। তারপর সেগুলোর পায়ে ব্যান্ড পরিয়ে ছেড়ে দেন।
কিন্তু কাক ধরার সময় তাঁরা একটা বিশেষ কাজ করেছিলেন। প্রত্যেকে মুখে একটা ভয়ংকর দানবের মুখোশ পরেছিলেন। মুখোশটা দেখতে এতই বীভৎস ছিল যে হ্যালোউইনের দিন পরলে মানুষও ভয় পাবে। আর কন্ট্রোল গ্রুপ হিসেবে আরেক দল গবেষক পরেছিলেন আমেরিকার সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনির মুখোশ।
ফলাফল কী হলো জানো? ওই দানবের মুখোশ পরা লোকগুলোকে দেখলেই কাকেরা ক্ষ্যাপাটে হয়ে যেত। ওরা কর্কশ স্বরে চিৎকার করত এবং দলবেঁধে আক্রমণ করত। অন্যদিকে ডিক চেনির মুখোশ পরা লোকগুলোকে ওরা পাত্তাই দিত না।
সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হলো, কাক ধরার ঘটনাটা ঘটেছিল একবার। কিন্তু এরপর বছরের পর বছর ধরে যখনই কেউ ওই দানবের মুখোশ পরে ওই এলাকায় যেত, কাকেরা তাকে আক্রমণ করত। যে কাকগুলোকে ধরা হয়নি, তারাও আক্রমণ করত! কারণ কাকেরা একে অপরের সঙ্গে কথা বলে এবং তথ্য আদান-প্রদান করে।
কাক বাঁচে ৮ বছর, আর রাগ মনে রাখে ১৭ বছর! এর মানে হলো, যে কাকটার সঙ্গে তুমি খারাপ ব্যবহার করেছিলে, সে মরে যাওয়ার পরেও ওর নাতি-পুতিরা তোমাকে চিনে রাখবে।
এই প্রসঙ্গে আরেকটা মজার তথ্য দিই। কাক শুধু শত্রু চিনে রাখে না, এরা মৃত সঙ্গীর জন্য একধরনের শেষকৃত্য বা ফিউনারেলও করে। যখন কোনো কাক মারা যায়, অন্য কাকেরা তাকে ঘিরে জড়ো হয়। তারা আসলে শোক পালন করে না, বরং বোঝার চেষ্টা করে কেন সঙ্গীটি মারা গেল। এতে ভবিষ্যতে ওরা সেই বিপদ এড়িয়ে চলতে পারে।
কাকের মস্তিষ্কের গঠন নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন, এদের মস্তিষ্কের নিডোপ্যালিয়াম অংশটি মানুষের মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের মতোই কাজ করে। মানুষের এই অংশ সমস্যা সমাধান এবং পরিকল্পনার কাজ করে। এ কারণেই কাকও শিম্পাঞ্জির মতো টুলস বা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে পারে।
মারজলুফ ২০১০ সালে তার গবেষণাপত্রে লিখেছিলেন, কাকেরা লিঙ্গ, বয়স বা উচ্চতা বিচার করে না। তুমি ছেলে না মেয়ে, বুড়ো না বাচ্চা; তা ওদের দেখার বিষয় নয়। ওদের টার্গেট শুধু ওই চেহারা বা ফেস। এমনকি ওই মুখোশ পরা লোকটা কীভাবে হাঁটছে, সেটাও ওরা খেয়াল রাখে।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ল্যাব অফ অর্নিথোলজির গবেষক কেভিন ম্যাকগোয়ানের অভিজ্ঞতা আরও ভয়াবহ। তিনি নিউইয়র্কে কাকের পায়ে ব্যান্ড পরানোর কাজ করতেন। কিছুদিন পর তিনি খেয়াল করলেন, তিনি পার্কে গেলেই কাকেরা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে তার মাথার ওপর ঘুরপাক খেতে থাকে আর চিৎকার করে।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘ভাবুন তো, একটা পাবলিক পার্ক, শত শত মানুষ হাঁটছে। কিন্তু কাকেরা আর কাউকে কিচ্ছু বলছে না, শুধু আমাকে দেখলেই আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করছে। আমি রীতিমতো ভীত হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল ওগুলো আমার দিকেই তাকিয়ে আছে।’
মারজলুফ ২০১০ সালে তার গবেষণাপত্রে লিখেছিলেন, কাকেরা লিঙ্গ, বয়স বা উচ্চতা বিচার করে না। তুমি ছেলে না মেয়ে, বুড়ো না বাচ্চা; তা ওদের দেখার বিষয় নয়। ওদের টার্গেট শুধু ওই চেহারা বা ফেস।
মারজলুফের সেই ২০০৬ সালের পরীক্ষার পর কেটে গেছে ১৭ বছর। কাকের প্রজন্ম পাল্টেছে। কিন্তু সেই দানব মুখোশ পরা লোকটাকে দেখলেই আজও সিয়াটলের কাকেরা তেড়ে আসে। হয়তো নিজেদের বাবার মুখে শোনা গল্পের ভিলেনকে তারা আজও ভোলেনি।
কাকের বুদ্ধিমত্তার আরেকটি প্রমাণ হলো, ওরা নিজেদের চেহারা আয়নায় চিনতে পারে। বিশেষ করে করভিড গোত্রের কাকেরা। খুব কম প্রাণীই এই কাজটা করতে পারে। আর ওরা ভবিষ্যতের জন্য খাবার লুকিয়ে রাখার সময় যদি দেখে অন্য কোনো কাক দেখে ফেলেছে, তবে ওরা মিথ্যা অভিনয় করে খাবার লুকানোর ভান করে। কিন্তু আসলে খাবারটা বুকের পালকের মধ্যে লুকিয়ে অন্য জায়গায় নিয়ে যায়।
অর্থাৎ, কাক কিন্তু ভারী বুদ্ধিমান প্রাণী। শুধু বুদ্ধিমান বললে কম বলা হবে, ওরা প্রতিশোধপরায়ণ প্রাণীও বটে! তাই বলে কাক দেখলেই আঘাত করতে যেও না যেন। কারণ, শুধু বুদ্ধি দিয়ে কাক তোমাকে কাবু করতে পারবে না। আর এখন দেশে তেমন কাকই বা কোথায়! ফলে কাক নিয়ে তোমাদের ভীত হওয়ার কিছু নেই। বরং ওদের বুদ্ধির জোরটা জেনে রাখা ভালো। আর রাস্তায় কাক দেখলে অন্তত মনে মনে ওদের বুদ্ধির জন্য প্রশংসা করতে পারো।
