মানুষ কীভাবে বিড়ালকে পোষ মানালো
ড্রয়িংরুমের সোফায় যে বিড়ালটি পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে, কিংবা মাঝরাতে খাবার চেয়ে যে বিড়ালটা আপনাকে জ্বালাতন করেছে, ওটাকে দেখে কি দুর্ধর্ষ শিকারি মনে হয়? হাজার হাজার বছর আগে এই নিরীহদর্শন প্রাণীটিই ছিল বুনো জঙ্গলের ত্রাস। অথচ আজ সে আমাদের বিছানার দখল নিয়ে বসে আছে। উল্টো মানুষই তার সেবা করছে!
প্রশ্ন হলো, এই বুনো বিড়াল কীভাবে মানুষের এত কাছের বন্ধু হয়ে উঠল? এই যাত্রাটা কি খুব সহজ ছিল? বিজ্ঞানীরা এতদিন যা ভাবতেন, নতুন গবেষণা বলছে ঘটনা মোটেও তেমন নয়। বিড়ালের ভদ্র হয়ে ওঠার ইতিহাস আসলে অনেক বেশি জটিল, অনেক বেশি রোমাঞ্চকর এবং কিছুটা ব্যর্থতায় ভরা!
সম্প্রতি সায়েন্স এবং সেল জেনোমিকস জার্নালে প্রকাশিত দুটি নতুন গবেষণা আমাদের বিড়াল সম্পর্কে পুরোনো সব ধারণা প্রায় পাল্টে দিয়েছে।
পোষ মানানো মোটেও সোজা ছিল না
আমরা হয়তো ভাবি, কুকুর যেমন খুব সহজেই মানুষের বন্ধু হয়ে গিয়েছিল, বিড়ালের ক্ষেত্রেও হয়তো তেমনই ঘটেছিল। হয়তো একদিন কোনো আদিম মানুষ বুনো বিড়ালকে একটু দুধ খেতে দিয়েছিল, আর সেদিন থেকেই বিড়াল মানুষের পোষ মেনে গেল! কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মিসৌরির ফেলাইন জেনেটিসিস্ট লেসলি লায়ন্স বলছেন, ‘পোষ মানানো এক রাতের ঘটনা নয়। হুট করে একদিন সব বিড়াল জঙ্গল ছেড়ে মানুষের কোলে এসে বসে পড়েনি।’
নতুন গবেষণা বলছে, বিড়ালের পোষ মানার প্রক্রিয়াটি ছিল অত্যন্ত ধীর এবং চড়াই-উতরাইয়ে ভরা। উত্তর আফ্রিকা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং সুদূর চীনে বিশাল এলাকাজুড়ে বিড়ালের ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা অদ্ভুত সব তথ্য পেয়েছেন। সেসব একটুখানি জানার চেষ্টা করি।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মিসৌরির ফেলাইন জেনেটিসিস্ট লেসলি লায়ন্স বলছেন, ‘পোষ মানানো এক রাতের ঘটনা নয়। হুট করে একদিন সব বিড়াল জঙ্গল ছেড়ে মানুষের কোলে এসে বসে পড়েনি।’
চীন: যেখানে বিড়াল পোষ মানেনি
সেল জেনোমিকস জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাটি ফোকাস করেছে প্রাচীন চীনের ওপর। সেখানে বিজ্ঞানীরা এক অদ্ভুত প্রজাতির বিড়ালের খোঁজ পেয়েছেন। সেই প্রজাতির নাম ‘এশিয়ান ওয়াইল্ডক্যাট’ বা ‘লেপার্ড ক্যাট’। আকারে-আকৃতিতে এরা আমাদের বর্তমানের পোষা বিড়ালের মতোই ছিল। কিন্তু স্বভাব মোটেও একরকম ছিল না! লেসলি লায়ন্সের ভাষায়, ওসব বিড়াল ছিল বেশ হিংস্র!
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৩ হাজার ৫০০ বছর ধরে এই বুনো লেপার্ড ক্যাটরা চীনের মানুষের কাছাকাছি বসবাস করেছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এত দীর্ঘ সময় মানুষের পাশে থেকেও তারা কখনো পুরোপুরি পোষ মানেনি। একে বিজ্ঞানীরা বলছেন পোষ মানানোর ব্যর্থ চেষ্টা।
তাহলে চীনে এখনকার শান্তশিষ্ট বিড়ালগুলো এল কোত্থেকে? উত্তর—সিল্ক রোড। গবেষণা বলছে, সত্যিকারের পোষা বিড়ালরা চীনে এসেছিল অনেক পরে, আজ থেকে প্রায় ১ হাজার ৪০০ বছর আগে, সিল্ক রোড ধরে। অর্থাৎ, ব্যবসায়ীদের হাত ধরে। আর সেই পুরোনো বুনো লেপার্ড ক্যাটরা কোথায়? ওগুলো মানুষের সঙ্গ ত্যাগ করে আবার জঙ্গলে ফিরে গিয়েছিল। আজও তারা বুনো হিসেবেই প্রকৃতির আড়ালে লুকিয়ে আছে।
সত্যিকারের পোষা বিড়ালরা চীনে এসেছিল অনেক পরে, আজ থেকে প্রায় ১ হাজার ৪০০ বছর আগে, সিল্ক রোড ধরে। অর্থাৎ, ব্যবসায়ীদের হাত ধরে।
ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য: ডিএনএর নতুন রহস্য
সায়েন্স জার্নালের গবেষণাটি নজর দিয়েছে ইউরোপ এবং উত্তর আফ্রিকার বিড়ালদের। এতদিন বিজ্ঞানীরা ভাবতেন, আমাদের পোষা বিড়ালরা বুঝি অনেক আগেই বুনো স্বভাব ঝেড়ে ফেলেছিল। কিন্তু নতুন নিউক্লিয়ার ডিএনএ বিশ্লেষণে বেরিয়ে এল ভিন্ন তথ্য।
তুরস্কের হাজার হাজার বছরের পুরোনো বিড়ালের হাড়গোড় পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে যান। ইতালির রোম টর ভেরগাটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যালিও জেনেটিসিস্ট মার্কো ডি মার্তিনো বলেন, ‘আমরা প্রথমবারের মতো এদের নিউক্লিয়ার জেনোম দেখার সুযোগ পেয়েছি। আর যা দেখেছি, তা চমকে দেওয়ার মতো।’
দেখা গেল, হাজার বছর আগে মানুষের আশপাশে ঘুরঘুর করা ওই বিড়ালগুলো আসলে পুরোপুরি বুনো ছিল। এরা মানুষের সঙ্গে থাকত ঠিকই, কিন্তু সুযোগ পেলেই জঙ্গলে গিয়ে বুনো বিড়ালদের সঙ্গে মিশত। ওদের রক্তে তখনো বুনো স্বভাব পুরোপুরি ছিল।
এর মানে কী জানেন? এর মানে হলো, বিড়াল প্রজাতিটা কুকুর বা অন্য প্রাণীর মতো নয়। এরা অত্যন্ত স্বাধীনচেতা। বিড়ালরা জটিল প্রাণীও বটে! এরা শুধু মানুষের সঙ্গে বসে থাকত না, নিজেদের ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াত।
মার্কো ডি মার্তিনো বলেন, ‘আমরা প্রথমবারের মতো এদের নিউক্লিয়ার জেনোম দেখার সুযোগ পেয়েছি। আর যা দেখেছি, তা চমকে দেওয়ার মতো।’
বিড়াল পোষ মানল কখন
এই দুটি গবেষণার ফলাফল মিলিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন এক নতুন সিদ্ধান্তে এসেছেন। তাঁরা বলছেন, সত্যিকারের পোষা বিড়ালের উদ্ভব হয়েছে আমাদের ধারণার চেয়ে অনেক পরে। সম্ভবত মাত্র ২ হাজার বছর আগে বিড়ালরা পুরোপুরি গৃহপালিত হয়েছে। সত্যিকারের পোষা বলতে বোঝানো হয়েছে, যারা পুরোপুরি মানুষের ওপর নির্ভরশীল এবং মানুষের ঘরের সদস্য ছিল।
পৃথিবীর ইতিহাসের তুলনায় দুই হাজার বছর কিন্তু খুব সামান্য সময়। আর এই অল্প সময়ের মধ্যেই বিড়ালরা কীভাবে গোটা পৃথিবী জয় করে নিল, সেটাই এক বিস্ময়!
এখন আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, বিজ্ঞানীরা এতদিন কেন এসব জানতেন না? এর একটা বড় কারণ হলো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের অভাব। মানুষ সাধারণত গরু, ছাগল বা হরিণ শিকার করে খেত, তাই মাটির নিচে এগুলোর হাড় প্রচুর পাওয়া যায়। কিন্তু মানুষ সচরাচর বিড়াল খেত না। তা ছাড়া বিড়ালের হাড় খুব ছোট হওয়ায় সেগুলো মাটির নিচে টিকে থাকাও কঠিন। তাই বিড়ালের সঠিক ইতিহাস বের করা অনেকটা অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মতো।
বিড়াল কিন্তু আজও আমাদের কাছে রহস্যই। আমাদের কোলে বসে আদর খায় ঠিকই, কিন্তু তাদের চোখের দিকে তাকালে এখনো সেই বুনো শিকারির ঝলক দেখা যায়! তবে সেই প্রাচীন বুনো রক্ত হয়তো এখন আর বিড়ালের মধ্যে নেই।