মানুষের জন্যই কি তিমির যোগাযোগ ব্যাহত হচ্ছে

নীল তিমিছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

ফসিলের প্রমাণ দেখে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, প্রায় ৫ কোটি বছর আগে তিমির পূর্বপুরুষেরা স্থলেই বাস করত। পরে ওরা জলজ জীবনের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেয়। এই অভিযোজনের অংশ হিসেবে তাদের নাকের ছিদ্র মাথার ওপরে চলে আসে। এতে তিমিরা সহজে শ্বাস নিতে পারে। ওদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সাঁতারের উপযোগী পাখনা বা ফ্লিপারে রূপান্তরিত হয়।

তিমি এক প্রকার সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী। এরা যোগাযোগের জন্য বিভিন্ন ধরনের শব্দ তৈরি করে। এই শব্দ ব্যবহার করেই ওরা শিকার করে, পথ চলে এবং সঙ্গীকে আকর্ষণ করে। বিশেষ করে বেলিন প্রজাতির বড় তিমিদের গান গাওয়ার বিষয়টি বিজ্ঞানীদের কাছে বরাবরই এক রহস্য ছিল। মহাসাগরের গভীরে বসবাসের কারণে জীবিত তিমি নিয়ে গবেষণা করা অত্যন্ত কঠিন। তাই এই রহস্যের সমাধান মিলছিল না।

আরও পড়ুন
জাহাজের সঙ্গে সংঘর্ষে তিমি মৃত্যুর হার বাড়ছে
ছবি: আর্থ ডট কম

তবে কীভাবে হলো এই গবেষণা

সম্প্রতি এ রহস্যের সমাধান হয়েছে। ২০২৪ সালের শুরুতে নেচার সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি যুগান্তকারী গবেষণাপত্রে ডেনমার্কের বিজ্ঞানীরা এর ব্যাখ্যা দেন। তাঁরা গবেষণার জন্য বিরল একটি সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনটি বেলিন তিমি মারা গিয়ে প্রায় অক্ষত অবস্থায় সমুদ্রসৈকতে ভেসে আসে। এর মধ্যে একটি হাম্পব্যাক, একটি সাই ও একটি মিনকি। বিজ্ঞানীরা দ্রুত তিমি তিনটিকে গবেষণাগারে নিয়ে সেগুলোর স্বরযন্ত্র বা ল্যারিংক্স পরীক্ষা করেন।

গবেষণায় তাঁরা দেখতে পান, বেলিন তিমির স্বরযন্ত্রে U-আকৃতির একটি বিশেষ তরুণাস্থি। এই তরুণাস্থি একটি চর্বিযুক্ত কুশনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। বিজ্ঞানীরা কৃত্রিমভাবে বাতাস প্রবাহিত করে দেখেন, এই কুশনের কম্পনেই তিমিরা গানের মতো নিম্ন কম্পাঙ্কের শব্দ তৈরি করে।

জীবিত তিমিরা শ্বাসপ্রশ্বাসের বাতাসকে স্বরযন্ত্রের ভেতরেই পুনর্ব্যবহার করতে পারে। এ কারণেই ওরা পানির নিচে দীর্ঘ সময় ধরে বাতাস না ছেড়েও গান গাইতে পারে। গবেষকেরা ল্যারিংক্সের একটি ত্রিমাত্রিক কম্পিউটার মডেল তৈরি করে দেখান, পেশি সংকোচনের মাধ্যমে তিমিরা শব্দের কম্পাঙ্ক নিয়ন্ত্রণ করে।

আরও পড়ুন

ক্রমশ কমে আসছে তিমির গান…

এই গবেষণার সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিকটি হলো, বেলিন তিমির গানের কম্পাঙ্ক সমুদ্রগামী জাহাজের প্রপেলারের শব্দের কম্পাঙ্কের সঙ্গে মিলে যায়। শারীরবৃত্তীয় সীমাবদ্ধতার কারণে তিমিরা ওদের গানের সুর বা পিচ খুব বেশি পরিবর্তন করতে পারে না। ফলে জাহাজের শব্দের কারণে ওদের গান ঢাকা পড়ে যায়। এই শব্দ দূষণের কারণে মহাসাগরে এক তিমি দূর থেকে অন্য তিমির গান শুনতে পায় না। এতে এসব সামুদ্রিক বড় তিমির যোগাযোগ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। তিমির বেঁচে থাকার জন্য এই যোগাযোগ ব্যবস্থা অপরিহার্য। গান গেয়েই তারা সঙ্গী খুঁজে বের করে এবং নিজেদের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করে। গবেষণাপত্রটির প্রধান লেখক ও ডেনমার্কের ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ডেনমার্কের অধ্যাপক কোয়েন ইলিম্যানসের মতে, ‘তিমির টিকে থাকার জন্য শব্দ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই সমুদ্রে বাণিজ্যিক জাহাজের সংখ্যা বাড়া মানে তিমিদের অস্তিত্বকেই সংকটের দিকে ঠেলে দেওয়া।’

সূত্র: সায়েন্স ফোকাস ডটকম

আরও পড়ুন