প্রাণিজগৎ
পাখির নাম হট্টিটি - ২
এ দেশে কত রকম, কত ধরনের পাখি। রং-বেরঙের এসব পাখি নিয়ে লিখেছেন পাখিবিশারদ ও প্রকৃতিবিদ শরীফ খান…
হট্টিটি পাখির গল্প বলছিলাম। ৯৮ ভাগ ক্ষেত্রে এই পাখিদের ডিম হয় ৪টি, রং মেটে-সবুজ।
বহুবার এদের ডিমের মাপ নিয়েছি আমি। বাসা ও ডিম আশপাশের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকে। এরা বাসা করে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফাল্গুন মাসে, চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। কোনো কারণে বাসার ডিম নষ্ট হলে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে আবারো ডিম পাড়ে। সে ক্ষেত্রে ৫৬ ভাগ সময়ে ডিম হয় দুটি, ৪০ ভাগ সময়ে ৩টি আর ৪ ভাগ সময়ে ৪টি।
৭০ ভাগ ক্ষেত্রে এরা বাসা করে খোলা মাঠে, চষা ক্ষেতে, ছোট ছোট ঘাসের ওপরে বা মাঠে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নানারকম ছোট ছোট উদ্ভিদ-গুল্মের ওপরে। বাসা বাঁধার জায়গা নির্বাচনে বেশি সময় এরা নেয় না। বাসা তৈরি করতে সময় লাগে ৬-১০ দিন। পাখির বাসা বলতে যা বোঝায়, এদের বাসা আদৌ সে রকম নয়। বৃত্তাকারে উপকরণ সাজিয়ে তৈরি। উপকরণ হচ্ছে ছোট ছোট মাটির ঢিল, শামুকের খোল, ইটের খোয়া, পুরোনো দালানের খসে পড়া পলেস্তারার টুকরো, পাথরের ছোট কুঁচি, শুকনো সুপারি, কুমোর বাড়ির ভাঙা মাটির হাঁড়ি-কলসির চাড়া ইত্যাদি। একই উপকরণ দিয়েই বাসা বানায়। মিশেল উপকরণ থাকেই না বলতে গেলে। উল্লেখিত সব উপকরণের বাসা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এমনকি একবার দেখেছিলাম, কাচের মারবেলের উপকরণ—একটি ছেলের ডজন চারেক মারবেল তার বাবা রাগে ছুড়ে দিয়েছিল মাঠে, ওই মারবেল মুখে নিয়েই বাসা সাজিয়েছিল সেই পাখি দম্পতি।
ঢাকা শহরতলীর মাণ্ডা বিলে আমি ১৯৮৪ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত একজোড়া পাখিকে মোটামুটি একই জায়গায় বাসা করতে দেখেছিলাম। এদের বাসা আজও নিয়মিত হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ক্যাম্পাস এলাকায়, বিশেষ একটি ভবনের ছাদে
২০ ভাগ ক্ষেত্রে এরা বাসা করে দালানের ছাদে। ১০ ভাগ করে ভেঙে পড়া মোটা গাছের ওপরে, ধসে পড়া কুটোর পালার মাথায় ও অন্যান্য জায়গায়। ঢাকা শহরতলীর মাণ্ডা বিলে আমি ১৯৮৪ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত একজোড়া পাখিকে মোটামুটি একই জায়গায় বাসা করতে দেখেছিলাম। এদের বাসা আজও নিয়মিত হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ক্যাম্পাস এলাকায়, বিশেষ একটি ভবনের ছাদে। সাভার এলাকায় এই পাখি বেশ আছে। ডেইরি ফার্মের বিশাল এলাকাটা এই পাখিদের স্বর্গরাজ্য। নিয়মিত ডিম-বাচ্চা তোলে ওখানে। জাবি ক্যাম্পাসের ছাদের বাসার উপকরণ হিসেবে আমি পাথরকুচি ও ইটের টুকরো দেখেছি। চমৎকার বাসা সাজায় পরিকল্পিতভাবে। আমি পাথরকুঁচি ও অন্যান্য উপকরণের সংখ্যা যেমন গুনেছি, তেমনি নিয়েছি বাসার মাপ। কী ঢিল, কী অন্যান্য উপকরণ—তার সংখ্যা থাকে ৭০-২০০ পিস। বাসার মাপ ৩৩ × ৩৩ সেন্টিমিটার।
সেই জমিদার বাড়ির ছাদের বাচ্চা ৪টিকে মা-বাবা খাওয়াল ৩ দিন। ছানাগুলো দেখতে যা সুন্দর না! লম্বা পা, রং ধূসর-ছাই, গলা সাদাটে, ঘাড় বাদামি এবং শরীরে কালচে-বাদামি ছিটছোপ ও টান।
লম্বা লম্বা পা। মুরগির ছানার মতো ছাদের ওপরে হাঁটাহাঁটি করে ওরা। মা-বাবার বিপদ সঙ্কেত পেলেই ছাদে বুক মিশিয়ে পড়ে থাকে চুপচাপ।
বিপদ কাটার সঙ্কেত পাওয়ার পরেই নড়ে আবার। মা-বাবাকে খাবার মুখে আসতে দেখলেই নিজেদের মধ্যে হুটোপুটি লাগায়, কার আগে কে খাবে, তা নিয়ে চলে তুমুল প্রতিযোগিতা।
৮ম দিন সকালে মা-বাবা ছাদের ওপরে উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে চেঁচাতে লাগল। এই নেমে আসে ছানাদের মাথার ওপরে, এই উঠে যায় ওপরে। এই একটু দূরে যায়, এই আসে কাছে। আজ কিন্তু ছুটে এল না নীলকণ্ঠ দম্পতি। কেননা ওরা বুঝতে পারছে, এটা হচ্ছে ছানাদের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ার সঙ্কেত। ছানারাও মা-বাবার কণ্ঠ, ওড়াউড়ির ধরন দেখে সহজাত প্রবৃত্তিতে বুঝে ফেলল, ছোট এই পরিসর থেকে তাদের লাফিয়ে পড়তে হবে নিচে। তারপর পেয়ে যাবে বিশাল জগত। পিলপিল গায়ে এগিয়ে ছানাগুলো ঠেলাঠেলি করে এসে দাঁড়াল কার্নিশের ফাঁকে, তাকাল সামনের বিশাল মাঠটির দিকে। মা-বাবা ওদিকেই উড়ছে, আসছে কাছে। আবারো যাচ্ছে মাঠের দিকে। বলছে, ‘জলদি জলদি, লাফ দে, লাফ দে।’
প্রথমে লাফ দিল একটি ছানা। হাস্যকর ভঙ্গিতে সে পড়ল একটা শটিঝোপের মাথায়, তারপর মাটিতে চিৎপটাং। হলো না বিশেষ কিছু। বাকি ৩টি ছানাও লাফ দিল। মা-বাবা শটিঝোপের পাশে নেমে চেঁচাতে লাগল, ‘ভেরি গুড, ভেরি গুড।’
খুব খুশি ওরা। বিশাল দুনিয়া এখন ছানাদের সামনে। উড়তে শেখার আগ পর্যন্ত এই মাঠে হেঁটে বেড়াবে ওরা মা-বাবার পেছনে পেছনে, অথবা সঙ্কেত অনুসরণ করে। মা-বাবা মাটিতে নামবে, খাওয়াবে। আবার হয়তো উড়ে যাবে একটু দূরে খাবার আনতে। এসব সময়ে ছানাদের আশপাশে যদি মানুষ বা অন্য কোনো বন্যপ্রাণী এসে পড়ে—আশেপাশে দেখা যায় কোনো শিকারি পাখি, তাহলে ছুটে আসবে মা-বাবা, চেঁচাবে সমানে, উড়ে উড়ে ঘুরবে। এটা হচ্ছে বিপদ সঙ্কেত। এ সময় বাচ্চারা ঘাস বা ধানের নাড়া অথবা ছোট ছোট মেঠো গাছের ভেতরে ঢুকে ঘাপটি মেরে থাকবে। আশপাশের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। বিপদ কেটে গেলে আবার সঙ্কেত দেবে মা-বাবা। বাচ্চারা তখন আবার নড়বে, মুরগির ছানার মতো হাঁটবে।
এক জায়গায় বসিয়ে মা-বাবা ওদেরকে খাওয়ায় না বা খাবার চেনায় না। মাটিতে বসে সঙ্কেত দেয়। বাচ্চারা হেঁটে সেদিকে এগোয়। দিক নির্দেশনা দিতে এই পাখিরা খুব দক্ষ। আবার শত্রুকে বিভ্রান্ত করতেও ওস্তাদ। ১৯৯৯ সালের ২৪ এপ্রিলে আমার তিন সঙ্গীসহ ডেইরি ফার্ম এলাকায় এই পাখির ৪টি ছানা অনেক খুঁজে পেয়েছিলাম। ওদের মা-বাবাই আমাদের বলে দিচ্ছিল, মাঠের আগাছার ভেতরে ছানা আছে। ছানাগুলো মাটিতে বুক-পেট মিশিয়ে কী রকম যে একাকার হয়ে গিয়েছিল! অভিজ্ঞ চোখ ছাড়া ওই ছানা খুঁজে পাওয়া সম্ভব ছিল না। ছানাগুলোর অবস্থানের কাছে পৌঁছানোমাত্র ওদের মা-বাবা চেঁচাচ্ছিল ‘নিল রে, নিল রে; পালা রে পালা রে!’ ছানাগুলোও পালাচ্ছিল। তখন নজরে পড়ে যায় আমাদের। আমরা ছুটে যাই। ততক্ষণে ছানাগুলো গা-ঢাকা দিয়েছে। আজকের বাঘ বিশেষজ্ঞ ড. মনিরুল খান তখন জাবির ছাত্র। তিনিও ছিলেন সেদিন আমাদের সঙ্গে।
এবার পাখিটির পরিচয় জানা দরকার। তার আগে অতি সংক্ষেপে আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে এই পাখি সম্পর্কে কিছু বলছি।
১. এদের কণ্ঠস্বর মূলত ‘হট্টিটি...টি...টি... হট্টিটি-টিট্’। পুরুষের গলা বেশি চড়া ও মোটা ধরনের। মেয়েটির গলা কম চড়া ও বেশি সুরেলা। কণ্ঠস্বর শুনে মেয়ে-পুরুষ শনাক্ত করা সম্ভব।
২. বৃষ্টি নামলে ছানারা বৃষ্টিস্নান করে। শিলাপাত হলে বাবা-মা বাচ্চাদের বুকে আগলে বসে। শিলা বড় বড় হলে মা-বাবা সঙ্কেত দিতে দিতে ছানাদের নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যায়, যাতে শিলাপাতে ছানাদের মৃত্যু না ঘটে। তবু মরে।
৩. যদিও ছানাদের খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, তবু মাঝেমধ্যে শিয়াল-খাটাসের পেটে যায়। রাতে ছানারা আশ্রয় নেয় ঝোপালো জায়গায়।
নীলকণ্ঠের মতো রাতেও এদের চিৎকার শোনা যায় বাড়িতে বসে। হয়তো ছানাদের পাশে বসেছিল, শুনল কোনো শব্দ বা পেল কোনো বিপদের গন্ধ, অমনি উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে থাকবে। ওই চিৎকার শুনে উড়ে আসবে নীলকণ্ঠ, সবাই মিলে চিৎকার করে মাঠ মাত করতে থাকবে
৪. পাঁচ ধরনের ডাক আছে এদের কণ্ঠে—ক. সঙ্গীকে খোঁজার ডাক, খ. বাসা বাঁধার সময় আনন্দের ডাক ও ডিম-বাচ্চা হওয়ার খুশির ডাক, গ. বাচ্চাদের নির্দেশনার ডাক, ঘ. বিপদ সঙ্কেত ও ঙ. বিপদ মুক্তির সঙ্কেত।
৫. এদের গলায় আছে নানা ধরনের কারুকাজ, তাই সব কটি ডাক ফুটিয়ে তুলতে পারে নিখুঁতভাবে।
৬. নীলকণ্ঠের মতো রাতেও এদের চিৎকার শোনা যায় বাড়িতে বসে। হয়তো ছানাদের পাশে বসেছিল, শুনল কোনো শব্দ বা পেল কোনো বিপদের গন্ধ, অমনি উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে থাকবে। ওই চিৎকার শুনে উড়ে আসবে নীলকণ্ঠ, সবাই মিলে চিৎকার করে মাঠ মাত করতে থাকবে।
৭. মাটির ওপর দিয়ে এরা ছুটতে পারে ছন্দময় গতিতে। অত্যন্ত হুঁশিয়ার আর চতুর পাখি এরা। এদের মিষ্টি ডাকেও আছে তাল-লয়-ছন্দ।
লম্বা পা-ওয়ালা সুন্দর এই পাখির নাম লাল লতিকা হট্টিটি। সংক্ষেপে হট্টিটি। ইংরেজি নাম রেডওয়াটলড ল্যাপউইং (Redwattled Lapwing)। বৈজ্ঞানিক নাম: Vanellus indicus। গোষ্ঠী: Charariidae।
আমাদের দেশে সচরাচর আরও যে দুরকম হট্টিটি দেখা যায়, সব কটিই হট্টিটি নামে পরিচিত। লাল লতিকা হট্টিটির চোখের সামনে উঁচু মাংসল অংশটি টকটকে লাল—ওকে বলা হয় লতিকা। লতিকাটির লাল রং দুদিকে এগিয়ে চোখের চারপাশে একটি বৃত্ত এঁকেছে, মনে হয় লাল রঙের চশমা পরে আছে পাখিটি। এদের গলা-বুক- মাথার তালু ও ঠোঁটের আগা কালো। চোখের পাশ থেকে চওড়া সাদা টান নেমে ঘাড় হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বুকের কিছু অংশসহ পেট ও লেজের তলা পর্যন্ত। অর্থাৎ চকচকে সাদা। ডানা বুজানো অবস্থায় পিঠ ও লেজের উপরিভাগটা চকচকে বাদামি, তাতে জলপাই রঙের আভা। ঠোঁট লাল। লম্বা লম্বা পা দুখানা হলুদ! বাসা বাঁধার মৌসুমে এই রংগুলো বেশি উজ্জ্বল হয়।
এদের শরীর ৩৪-৩৭ সেন্টিমিটার। শুধু ঠোঁট ৪ সেন্টিমিটার। লেজ ১২ সেন্টিমিটার ও ডানা ২৩ সেন্টিমিটার লম্বা। এদের শরীরের মাপ আমি নিখুঁতভাবে বহুবার নিয়েছি ও নোট করেছি। আগ্রহী শিশু-কিশোরেরা কখনো যদি স্বাভাবিকভাবে মৃত এই পাখি পেয়ে যায়, তাহলে প্রতিটা অঙ্গের আলাদা আলাদা মাপ নিয়ে লিখে রাখতে পারে নোট খাতায়। বাচ্চা খুঁজে বের করার চেষ্টা তারা করতে পারে। কী সুন্দর বাচ্চা। তবে ছেড়ে দিতে হবে আবার। পাখি আর পাখির ছানারা কত সুন্দর, তাই না? ছানারা উড়তে শেখে ৩০ দিনে।
খাদ্য: পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ। শস্যবীজ, কচিঘাস, কেঁচো ইত্যাদিও খায়। বাচ্চাদের জল খাওয়ার জন্য ওরা জলে বুক ভিজিয়ে আনলে বাচ্চারা ভেজা লোম চুষে জল খায়।
বাসা: বাসার কথা আগেই বলেছি। রূপসা-বাগেরহাট রেলপথ এখন পরিত্যক্ত। ১৯৯৭ সালে বাগেরহাট কলেজ ও ষাটগম্বুজ স্টেশনের মাঝের পুঁটিমারী বিলের ভেতর রেললাইনের মধ্যে আমি বাসা দেখি। বাসায় ছিল ৩টি ডিম।
হট্টিটি সারাদেশেই সন্তোষজনক হারে আছে। ইদানীং এয়ারগান, বন্দুক ও পয়েন্ট ২২ বোরের রাইফেল শিকারিরা মারে এদের মাংস খাওয়ার লোভে। বাগেরহাটের ফকিরহাটের উত্তরের হাওড়ে প্রতি শীতে আসে পরিযায়ী অতি দুর্লভ ধূসরমাথা হট্টিটি। ২০০৮ সালেও আমি, শিপলু খান ও তানভীর খান ৩টি পাখি দেখি।