অ্যানথ্রাক্স: কী, কেন, কীভাবে

রংপুরের পীরগাছায় সম্প্রতি অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় অর্ধশত ব্যক্তি। যদিও উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ এখনো নিশ্চিতভাবে এই দুজনের মৃত্যুর কারণ হিসেবে অ্যানথ্রাক্সকে দায়ী করেনি। তবে প্রাণিসম্পদ বিভাগ অসুস্থ গরুর মাংস পরীক্ষা করে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু শনাক্ত করেছে।

যে দুই ব্যক্তি মারা গেছেন, প্রথম আলো সূত্রে জানা গেছে, দুজনেই অসুস্থ গরুর মাংস কাটা বা খাওয়ার পর এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। আক্রান্ত ব্যক্তিরা বলছেন, রোগটি উপজেলার চারটি ইউনিয়নে ছড়িয়ে পড়েছে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) একটি বিশেষজ্ঞ দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করছে। উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ মানুষকে সচেতন করতে এবং গবাদিপশুকে টিকা দিতে কাজ করছে, যাতে এই রোগের বিস্তার ঠেকানো যায়।

এই রোগ শুধু বাংলাদেশের সমস্যা না। আফ্রিকা ও এশিয়ার কিছু দেশেও এ রোগের বিস্তার আছে। যেমন, এখন পাঁচটি আফ্রিকান দেশ অ্যানথ্রাক্সের প্রাদুর্ভাবের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এ পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ২০০ জন মানুষ এসব দেশে অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন প্রায় ২০ জন।

কেনিয়া, মালাউই, উগান্ডা, জাম্বিয়া এবং জিম্বাবুয়েতে ছড়িয়েছে অ্যানথ্রাক্স। ১ হাজার ১৬৬টি ঘটনা বা নমুণা থেকে মাত্র ৩৫ জনের শরীরে ল্যাব পরীক্ষায় অ্যানথ্রাক্স নিশ্চিত হয়েছে।

আরও পড়ুন

অ্যানথ্রাক্স কী

বাংলাদেশে গরুর আক্রান্ত হওয়ার খবর সবচেয়ে বেশি শোনা যায়। বাংলায় একে বলা হয় তড়কা রোগ। এই রোগের নামকরণ করা হয়েছে কারণ এর কারণে ত্বকে কালো রঙের ক্ষত বা পোড়া অংশ দেখা দেয়। এই রোগ অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না। আক্রান্ত পশুর মাংস খাওয়ার মাধ্যমে এটি মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়। এ কারণেই রংপুরের পীরগাছায় যত্রতত্র গরুর মাংস বিক্রি করতে নিরুৎসাহিত করা করা হচ্ছে।

অ্যানথ্রাক্স রোগ ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস (Bacillus anthracis) নামে খুব শক্তিশালী একটি ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে হয়। ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস একটি গ্রাম-পজিটিভ ব্যাকটেরিয়া। এটি একটি বিশেষ ধরনের ব্যাকটেরিয়া। গ্রাম স্টেইন নামে একটি পরীক্ষার মাধ্যমে এই নাম এসেছে। ১৮৮৪ সালে ডেনিশ বিজ্ঞানী হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান গ্রাম এই পরীক্ষা উদ্ভাবন করেছিলেন। ব্যাকটেরিয়ার কোষপ্রাচীর বা বাইরের আবরণের গঠন কেমন, তার ওপর ভিত্তি করে ব্যাকটেরিয়াকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। গ্রাম-পজিটিভ এবং গ্রাম-নেগেটিভ। গ্রাম-পজিটিভ ব্যাকটেরিয়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এদের কোষপ্রাচীর খুব মোটা হয়। এই পুরু স্তরের কারণে গ্রাম স্টেইন পরীক্ষায় ব্যবহৃত ক্রিস্টাল ভায়োলেট রং ওদের প্রাচীরে আটকে যায়। ফলে মাইক্রোস্কোপে দেখলে এই ব্যাকটেরিয়াগুলোকে নীল বা বেগুনি রঙের দেখা যায়। এই ব্যাকটেরিয়া মাটির মধ্যে সবখানেই আছে। পশু বা বন্যপ্রাণীকে সংক্রমিত করতে পারে এই ব্যাকটেরিয়া। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলেই অ্যানথ্রাক্স দেখা যায়। সংক্রামিত প্রাণী এবং এদের তৈরি পণ্য যেমন লোম, পশম, মাংস বা দুধের সংস্পর্শে এলে মানুষ অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হতে পারে।

আক্রান্ত পশুর মাংস খেলে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। মানুষের শরীরে অ্যানথ্রাক্স আক্রমণ করলে ত্বকে কালো ঘা এবং ফোলাভাব সৃষ্টি হয়। জ্বর হতে পারে।

এটি শত শত বছর ধরে মাটি ও পানিতে টিকে থাকতে পারে। চারণভূমি থেকে মাটির স্পোর খেয়ে গবাদি পশুর এই সংক্রমণ হয়। মাত্র দুই বা তিন দিনের মধ্যেই পশু অসুস্থ হয়ে মারা যায়। বিশেষ করে আমাদের দেশে সম্প্রতি ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। ফলে গবাদি পশুর মধ্যে এই রোগ ছড়ানো অস্বাভাবিক নয়।

আক্রান্ত পশুর মাংস খেলে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। মানুষের শরীরে অ্যানথ্রাক্স আক্রমণ করলে ত্বকে কালো ঘা এবং ফোলাভাব সৃষ্টি হয়। জ্বর হতে পারে। বুকে ছড়িয়ে পড়লে রোগী শ্বাসরোধ হয়ে মারা যেতে পারে।

এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু দেশে বন্যপ্রাণী, গবাদি পশু এবং মানুষের মধ্যে অল্প কিছু অ্যানথ্রাক্স আক্রান্তের ঘটনা দেখা যায়। অ্যানথ্রাক্সের স্পোর যখন মানবদেহে প্রবেশ করে, তখন মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়। একবার শরীরে প্রবেশ করলে স্পোরগুলো অঙ্কুরিত হয় এবং সংখ্যাবৃদ্ধি পায়। এভাবে শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। একই সঙ্গে এই ব্যাকটেরিয়া বিষ তৈরি করে। এর প্রভাবে অনেক গুরুতর রোগ হয়। শ্বাস-প্রশ্বাস, ত্বকের কাটা বা আঁচড়, দূষিত খাবার বা পানীয়, বিশেষ করে জ্বাল না দেওয়া দুধ বা ভালোভাবে রান্না না করা মাংস খাওয়ার মাধ্যমে অ্যানথ্রাক্সের স্পোর শরীরে প্রবেশ করতে পারে। রংপুরে মৃত দুজনের একজন অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত গরু কাটাকাটির সময় নিজের আঙুল কেটে ফেলেন। পরে তিনি আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

আরও পড়ুন

অ্যানথ্রাক্স কেন ছড়িয়ে পড়েছে

পীরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মুহাম্মদ তানভীর হাসনাত প্রথম আলোকে বলেন, ‘অ্যানথ্রাক্সের বিষয়টি বেশ কয়েক দিন ধরে আলোচনা হচ্ছে। মাসখানেক আগে কিছু গবাদিপশুর শরীরে এ রোগের উপসর্গ দেখা দেয় ও মারা যায়। ওই গবাদিপশুর মাংস কাটাকাটি করা থেকে অ্যানথ্রাক্স রোগের জীবাণু ছড়াতে পারে।’

পরে প্রাণিসম্পদ বিভাগ নমুনাগুলো পরীক্ষা করে গত সপ্তাহে জানিয়েছে, মাংসে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু পাওয়া গেছে। যে রোগীরা হাসপাতালে যাচ্ছেন, তাঁদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ১০-১২ জন রোগী অ্যানথ্রাক্সের চিকিৎসা নিয়েছেন বলে দাবি করেছেন এই কর্মকর্তা।

পীরগাছা সদর, তাম্বুলপুর, ছাওলা ও পারুল ইউনিয়নে ঘুরে প্রথম আলো অন্তত অর্ধশত রোগীর তথ্য পেয়েছে। তাঁরা কেউ চিকিৎসাধীন, কেউ চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন। আক্রান্ত ব্যক্তিরা বলছেন, দুই মাস আগে উপজেলায় অ্যানথ্রাক্স রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। তাঁদের অভিযোগ, স্বাস্থ্য বিভাগ সময়মতো পদক্ষেপ না নেওয়ায় উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে অ্যানথ্রাক্স ছড়িয়ে পড়েছে।

আবার নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, উগান্ডায় প্রথম সন্দেহজনক গবাদি পশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে গত জুনে। মানুষের প্রথম মৃত্যুর খবর আসে জুলাইয়ে। অক্টোবরের শেষের দিকে কমপক্ষে ২৪টি পশু মারা গেছে। বাংলাদেশে দুজনের মৃত্যু হয়েছে জুলাই ও সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে।

রংপুরের পীরগাছার দেউতি, পূর্ব পারুল, আনন্দী ধনীরাম, কদমতলা, শঠিপাড়া গ্রাম ঘুরে প্রথম আলোর প্রতিবেদক জানতে পেরেছেন, গত ২ মাসে অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত হয়ে তিন শতাধিক গবাদিপশু মারা গেছে।

রোগটি যেহেতু মানুষের মধ্যে খুব রেয়ার বা সহজে দেখা যায় না, তাই এর ভ্যাকসিনও সহজলভ্য নয়। আফ্রিকা সিডিসি বা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিভাগ অ্যানথ্রাক্স নিয়ে কাজ করছে।

তাই সন্দেহ নেই রংপুরে অ্যানথ্রাক্স ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ, আক্রান্ত রোগীদের হাতে ও বাহুতে চুলকানির ক্ষত, ফোলাভাব ও মাথাব্যথা হয়েছে। এগুলো অ্যানথ্রাক্সের খুব পরিচিত লক্ষণ। অ্যানথ্রাক্সের ভ্যাকসিন থাকা সত্ত্বেও আফ্রিকা বা এশিয়ার দেশগুলোতে এগুলো সহজলভ্য না। যেখানে এই রোগের প্রকোপ বেশি, সেখানে জনসাধারণের জন্য এটি পাওয়া যায় না। সাধারণত কিছু উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য এটি দেওয়া হয়। যেমন, সামরিক বাহিনীর সদস্য, গবেষণাগারের কর্মী এবং যারা গবাদি পশু নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের।

রোগটি যেহেতু মানুষের মধ্যে খুব রেয়ার বা সহজে দেখা যায় না, তাই এর ভ্যাকসিনও সহজলভ্য নয়। আফ্রিকা সিডিসি বা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিভাগ অ্যানথ্রাক্স নিয়ে কাজ করছে। অনেকেই হাসপাতালে না গিয়ে স্থানীয় কবিরাজদের কাছে চিকিৎসা নিতে যান। ফলে রোগীর চিকিৎসা সহজে সমাধান হয় না।

আরও পড়ুন

কীভাবে অ্যানথ্রাক্সের চিকিৎসা করা হয়

অ্যানথ্রাক্স একটি গুরুতর রোগ হলেও এটি চিকিৎসাযোগ্য। অ্যানথ্রাক্সের মূল চিকিৎসা হলো অ্যান্টিবায়োটিক। সাধারণত পেনিসিলিন, ডক্সিসাইক্লিন বা কুইনোলোনের মতো অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। কিছু অ্যান্টিবায়োটিকের অ্যানথ্রাক্স ব্যাকটেরিয়াকে নিষ্ক্রিয় করে। যদি রোগীর লক্ষণ গুরুতর হয়, তাহলে তাকে একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হতে পারে। 

কিছু রোগীর ক্ষেত্রে অ্যানথ্রাক্স ব্যাকটেরিয়া শরীর থেকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল হয়ে গেলেও রোগের কারণে দেখা দিতে পারে গুরুতর জটিলতা। এমন পরিস্থিতিতে রোগীকে আইসিইউতে ভর্তি বা শ্বাসনালীতে নল স্থাপনের প্রয়োজন হতে পারে। অ্যানথ্রাক্সের ভ্যাকসিন বা টিকা রয়েছে। তবে এটি সবার জন্য সহজলভ্য নয়।

অ্যানথ্রাক্স ঠেকাতে রংপুরে এখন পর্যন্ত ৩৪ হাজার ৩৩৭টি গবাদিপশুকে অ্যানথ্রাক্স রোগ নির্মূলের টিকা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অসুস্থ গবাদিপশু জবাই না করতে করা হচ্ছে উঠান বৈঠক। লিফলেট বিতরণসহ সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালমান আছে।

তাই যদি কারো অ্যানথ্রাক্সের লক্ষণ দেখা যায়, তবে সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া উচিত। যদি প্রাণীর মধ্যে অ্যানথ্রাক্স দেখা দেয়, তবে প্রাণী চিকিৎসকের সাহায্য নিতে হবে।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, কিশোর আলো

সূত্র: প্রথম আলো ও নিউইয়র্ক টাইমস