দেহঘড়ি
অ্যালার্জির সাতকাহন
কথায় কথায় অনেকে বলেন, আমার ওই জিনিসে অ্যালার্জি আছে। আবার অনেকের নানা কারণে—কিছু খেলে বা নিশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে কিছু প্রবেশ করলে অ্যালার্জি হয়। কিন্তু অ্যালার্জি আসলে কী? কেন হয় এ রকম? এমন নানা প্রশ্নের জবাব...
অ্যালার্জি শব্দটি আমাদের সুপরিচিত। আমরা প্রায় সময় বলি, ওই জিনিসে আমার অ্যালার্জি আছে। কিন্তু অ্যালার্জি কী বা কেন হয়, সে সম্পর্কে অনেকের স্পষ্ট ধারণা নেই।
অ্যালার্জি কী
অ্যালার্জি মানে কোনো বিশেষ বস্তুর প্রতি আমাদের অতি সংবেদনশীলতা। সেই বস্তু খাদ্য হতে পারে, হতে পারে এমন কিছু, যা ত্বকের সংস্পর্শে এসেছে, কিংবা নাক দিয়ে নিশ্বাসের মাধ্যমে প্রবেশ করেছে, কিংবা কোনো ওষুধ বা ইনজেকশন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে একে টাইপ ওয়ান হাইপারসেনসিটিভিটি রিঅ্যাকশন বলা হয়। যে বস্তুর সংস্পর্শে এলে অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া ঘটে, তার নাম অ্যালার্জেন বা অ্যান্টিজেন। যখন কোনো অ্যালার্জেন শরীরে প্রথম প্রবেশ করে বা সংস্পর্শে আসে, তখন তার বিপরীতে রক্তে ‘আইজি ই’ ধরনের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। রক্তের টি লিম্ফোসাইট, বি লিম্ফোসাইট, মাস্ট সেল, ব্যাসোফিল ইত্যাদি কোষ ওই বস্তুকে কিন্তু চিনে রাখে। একে বলে সেনসিটাইজেশন। পরে যতবার শরীর ওই বিশেষ অ্যালার্জেনের সংস্পর্শে আসবে, ততবার কোষগুলো অতি সক্রিয় হয়ে উঠবে এবং অ্যালার্জেন ধ্বংস করার জন্য বিশেষ ধরনের রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করতে থাকবে। গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিকগুলো হচ্ছে হিস্টামিন, লিউকোট্রায়েন্স, সাইকোইন, প্রস্টাগ্ল্যান্ডিন, প্লাটিলেট অ্যাকটিভেটিং ফ্যাক্টর ইত্যাদি। এ রাসায়নিকগুলো শরীরের বিভিন্ন স্থানে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে সক্ষম। বিশেষ করে এগুলো রক্তনালির দেয়ালগুলোর পারমিয়েবিলিটি বাড়িয়ে দেয় বা ছিদ্রগুলো বড় করে দেয়। যার ফলে রক্তনালির ভেতরকার তরল বাইরে বেরিয়ে এসে জমা হয়। রক্তনালি ও অন্যান্য অঙ্গের মাংসপেশি সংকোচন করে। প্রচুর মিউকাস বা আঠালো তরল নিঃসরণ করে। এসব প্রতিক্রিয়ার কারণে বিশেষ কিছু উপসর্গ দেখা দেয়।
যেকোনো বিশেষ বস্তুর প্রতি অ্যালার্জি থাকতে পারে। একেকজনের একেক বস্তুর প্রতি অ্যালার্জি থাকে। তবে সাধারণভাবে ধুলাবালু, মাকড়সার ঝুল, ডাস্ট মাইট বা বাড়িতে ক্ষুদ্র কণা, পশুপাখির লোম, ফুলের রেণু, পোকামাকড়ের দেহাবশেষ, কার্পেট বা পোশাকের আঁশ ইত্যাদি অ্যালার্জেন হিসেবে কাজ করে।
কী হয় অ্যালার্জি হলে
অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া হলে শরীরের ভেতর যেসব রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে, তার ফলে নাক দিয়ে পানি ঝরা, চোখ দিয়ে পানি পড়া, চোখ-নাক লালচে দেখানো, ত্বকে লাল হয়ে চুলকানি বা দানা দেখা দেওয়া, গলায় অস্বস্তি বা কাশি, শ্বাসকষ্ট, পেটে ব্যথা, পাতলা পায়খানা ইত্যাদি হতে পারে। এমনকি তীব্র হাইপারসেনসিটিভিটি রিঅ্যাকশনে মানুষ অজ্ঞান হয়ে পড়তে পারে, রক্তচাপ ও হৃৎস্পন্দন কমে গিয়ে মারাও যেতে পারে। এ পরিস্থিতিকে বলে অ্যানাফাইলেকটিক শক।
হাঁপানি বা অ্যাজমা, অ্যালার্জিক রাইনাইটিস, অ্যালার্জিক ডারমাটাইটিস, অ্যালার্জিক কনজাংটিভাইটিস, আরটিকেরিয়া, হে ফিভার, ড্রাগ রিঅ্যাকশন, ফুড অ্যালার্জি ইত্যাদি অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়ার নানা রূপ। কারও একধরনের অ্যালার্জি থাকলে অন্য ধরনের থাকা অস্বাভাবিক নয়। পরিবারে অন্যদের থাকলে এ সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
কিসে হয় অ্যালার্জি
যেকোনো বিশেষ বস্তুর প্রতি অ্যালার্জি থাকতে পারে। একেকজনের একেক বস্তুর প্রতি অ্যালার্জি থাকে। তবে সাধারণভাবে ধুলাবালু, মাকড়সার ঝুল, ডাস্ট মাইট বা বাড়িতে ক্ষুদ্র কণা, পশুপাখির লোম, ফুলের রেণু, পোকামাকড়ের দেহাবশেষ, কার্পেট বা পোশাকের আঁশ ইত্যাদি অ্যালার্জেন হিসেবে কাজ করে। বিশেষ কোনো খাবারের প্রতি অ্যালার্জি থাকতে পারে। যেমন সামুদ্রিক খাবার বা সি-ফুড, বাদাম, ডিম, বেগুন ইত্যাদি। কোনো বিশেষ ওষুধ, অ্যান্টিবায়োটিক বা ইনজেকশনে অ্যালার্জি হতে পারে। রক্ত সঞ্চালনের পরও অ্যালার্জি হতে পারে।
সাধারণত যাঁদের অ্যালার্জির সমস্যা আছে, তাঁদের বলা হয় এটপিক ইনডিভিজুয়াল। পরিবারে অ্যালার্জির ইতিহাস থাকে প্রায়ই। এটি তাঁদের বিশেষ একটি প্রবণতা। এ সমস্যা কখনো সম্পূর্ণ ভালো হবে না।
যাঁদের অ্যালার্জি আছে, তাঁরা কী করবেন
যাঁদের বিশেষ কোনো বস্তুর প্রতি অ্যালার্জি থাকে, তাঁরা কিছুদিন পরই বুঝে যান কোন বস্তুগুলো তাঁদের শত্রু। সেই বস্তু এড়িয়ে চলতে হবে। যেমন যাঁদের সি-ফুডে অ্যালার্জি, তাঁরা সেটা খাবেন না। যাঁদের ধুলাবালুতে অ্যালার্জি, তাঁরা ঘর ঝাড়পোঁছ করবেন না, ধূলিময় স্থানে মাস্ক পরবেন। কারও যদি কোনো বিশেষ ওষুধে অ্যালার্জি হয়ে থাকে, সেটা অবশ্যই চিকিৎসককে জানাতে হবে। এভাবে নিজের চারপাশে প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন।
তারপরও যদি কোনো অ্যালার্জেনের সংস্পর্শে এসে উপসর্গ শুরু হয়ে যায়, তবে দ্রুত অ্যান্টিহিস্টামিন-জাতীয় ওষুধ, ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োজন হলে স্টেরয়েড গ্রহণ করতে হবে। শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানির টান উঠে গেলে স্টেরয়েড ও ব্রংকোডাইলেটর ইনহেলার ব্যবহার করতে হবে। প্রয়োজন হলে স্টেরয়েড ইনজেকশন বা অ্যান্টিহিস্টামিন ইনজেকশন লাগতে পারে। যদি কারও চেতনা লুপ্ত হয়ে আসতে থাকে, তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, রক্তচাপ ও হৃৎস্পন্দন দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে, তবে বুঝতে হবে অ্যানাফাইলেকটিক শক হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে দ্রুত রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দিতে হবে।
অ্যালার্জি কি কখনো ভালো হবে না
সাধারণত যাঁদের অ্যালার্জির সমস্যা আছে, তাঁদের বলা হয় এটপিক ইনডিভিজুয়াল। পরিবারে অ্যালার্জির ইতিহাস থাকে প্রায়ই। এটি তাঁদের বিশেষ একটি প্রবণতা। এ সমস্যা কখনো সম্পূর্ণ ভালো হবে না। তবে চিকিৎসা ও সচেতনতার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। বর্তমানে নানা ধরনের ইমিউনোথেরাপির মাধ্যমে অ্যালার্জির চিকিৎসা করা হচ্ছে। অল্পবয়স্কদের ক্ষেত্রে ইমিউনোথেরাপির মাধ্যমে ডি-সেনসিটাইজেশন বেশি কার্যকর।