হাঙরের নাম শুনলেই মনটা ভয়ে আঁতকে ওঠে। এ জন্য দায়ী হলিউডের মুভিগুলো। হাঙর নিয়ে অনেক মুভি আছে। সেগুলোতে হাঙরকে দেখানো হয় ভয়ংকর প্রাণী হিসেবে। বাস্তবের হাঙর মুভির মতো অতটা ভয়ংকর নয়। এরা অন্যান্য শিকারি মাছের মতোই সাধারণ। তবে আকারে অনেক বড় হওয়ায় এদের মানুষ বেশি ভয়। এই বিশালাকৃতির মাছটি পৃথিবীতে টিকে আছে ডাইনোসরের আগে থেকে। কীভাবে এতদিন টিকে রইল, সমুদ্রের কোথায় বাস করে, কী খায়—এসব প্রশ্নের উত্তর মিলবে এই লেখায়।
শুরুতে হাঙরের ঘরবাড়ির কথা জানা যাক। পৃথিবীর প্রায় সব মহাসাগরেই দেখা যায় এই জলদানোকে। প্রবাল প্রাচীর থেকে শুরু করে বরফে ঢাকা আর্কটিক অঞ্চল—সবখানেই এদের দেখা মেলে। কিটফিন প্রজাতির হাঙরের দেখা মেলে সমুদ্রের অনেক গভীরে। এতই গভীরে এরা থাকে যে সেখানে আলোও ভালোভাবে পৌঁছায় না। কিছু হাঙর আবার খাবারের খোঁজে সমুদ্রের অনেকটা পথ পাড়ি দেয়। বিজ্ঞানীরা জিপিএস ট্র্যাকার ব্যবহার করে দেখেছেন, দৈত্যাকার হোয়াইট হাঙর খাবারের খোঁজে প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিতে পারে। কিছু হাঙর আবার আরামদায়ক তাপমাত্রার জন্য পানির ওপরের স্তরে থাকে। এগুলোকে সাধারণত পানির ৩০-৩০০ ফুটের মধ্যে দেখা যায়। আবার কিছু প্রজাতির হাঙরের দেখা মিলেছে প্রশান্ত মহাসাগরের একটি আগ্নেয়গিরির আশপাশে।
এবার জানা যাক হাঙরের খাবার-দাবারের কথা। বেশির ভাগ হাঙরই মাংসাশী। তবে অবাক করা ব্যাপার হলো, হাঙর সামুদ্রিক ঘাসও খেতে পারে। ছোট হ্যামারহেড হাঙর শাকসবজি এবং সামুদ্রিক কচ্ছপও হজম করতে পারে। আসলে ছোট প্ল্যাঙ্কটন থেকে শুরু করে কাঁকড়া, মাছ, সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী সীলসহ প্রায় সবই খায় হাঙর। অনেক হাঙর আবার স্কুইড, ডলফিন ও মৃত তিমি খায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এদের খাদ্যাভাসেরও পরিবর্তন হতে পারে। তবে হাঙরের খাবারের তালিকায় মানুষ নেই। মুভির মতো এরা মানুষ দেখলেই আক্রমণ করে না। বিষয়টা মোটামুটি গুজব। ২০২৪ সালে হাঙরের আক্রমণে বিশ্বে ৭ জনের মৃত্যুর ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। এই পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায়, হাঙর কতটা আক্রমণাত্মক।
আচ্ছা, পৃথিবীতে কত ধরনের হাঙর আছে? এককথায় বললে, এখনো বিশ্বে প্রায় ৫০০ প্রজাতির হাঙর বেঁচে আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ছোট হাঙরের কথা শুনলে বিশ্বাস হতে চাইবে না। এই হাঙর আপনি পকেটে নিয়েই ঘুরতে পারবেন। এদের নাম বামন ল্যান্টার্ন। দৈর্ঘ্য মাত্র ১৬-২০ সেন্টিমিটার। আবার দৈত্যাকার হোয়েল শার্কও রয়েছে। এরাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মাছ। দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০ ফুট। একটা বড় আকারের স্কুল বাসের সমান। এদের কামড় আফ্রিকান সিংহের চেয়ে তিন গুণ বেশি শক্তিশালী।
হাঙরকে অনেকে বিপন্ন মনে করেন। আসলেই কি এদের বিপন্ন বলা যায়? দুঃখজনক হলেও সত্যি, মানুষের কর্মকাণ্ডের ফলে এক-তৃতীয়াংশ হাঙর বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। নদী ও সমুদ্রে মাছ ধরার কারণে প্রতিবছর প্রায় ৮ কোটি হাঙর মারা যায়। যদিও মাছ শিকারি নৌকাগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে হাঙর শিকার করে না। কিন্তু অন্যান্য মাছ ধরার জালে হাঙরও ধরা পড়ে। এতে অনেক হাঙর মারা যায়। মাংস ও তেলের জন্য অনেকে হাঙর শিকার করে। অনেক দেশে হাঙরের পাখনার স্যুপ উপাদেয় খাবার হিসেবে বিবেচিত।
এক বাটি স্যুপের খরচ ১২ হাজার টাকার বেশি। এ কারণে অনেকে হাঙর শিকার করে। যদিও এটা ঠিক নয় এবং আইন বিরুদ্ধ কাজ। ক্রমাগত এভাবে হাঙরের সংখ্যা কমতে থাকলে বাস্তুতন্ত্র এলোমেলো হয়ে যেতে পারে। হাঙরের মতো সর্বোচ্চ স্তরের খাদক টিকে না থাকলে খাদ্যজাল ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে। পাশাপাশি হাঙর অক্সিজেন উৎপাদনকারী প্ল্যাংকটন খেয়ে সাগরে অক্সিজেনের ভারসাম্য বজায় রাখে। ফলে হাঙরের সংখ্যা এভাবে কমতে থাকলে একসময় এই প্রজাতি বিপন্ন হয়ে যেতে পারে।