কুকুরের এত জাত এল কোথা থেকে

বর্তমানে অনেক জাতের কুকুর মানুষের সঙ্গে বাস করে।ছবি: ড্যান পেট কেয়ার

মানুষের কাছাকাছি থাকে, মানুষ লালনপালন করে এমন প্রাণীর বহু জাত বা ব্রিড দেখা যায়। কুকুর-বিড়ালের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি বেশ চোখে পড়ে। একই এলাকায় থাকা এক ব্যক্তি এক জাতের কুকুর পালন করেন তো দেখা যায় পাশের বাসায় আরেক জাতের কুকুর পালন করছে। প্রশ্ন হলো, এত জাতের কুকুর এল কোথা থেকে?

বর্তমানে অনেক জাতের কুকুর মানুষের সঙ্গে বাস করে। ল্যাব্রাডর রিট্রিভার, গোল্ডেন রিট্রিভার, ডোবারম্যান, অ্যালসেশিয়ান, হাস্কি, শেটল্যান্ড শিপডগসহ নানা জাত। এতদিন আমাদের জানা ছিল, কুকুরের আলাদা জাত তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল ভিক্টোরিয়ান যুগে। ১৮৩৭ সালের জুন থেকে ১৯০১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়কালকে বলা হয় ভিক্টোরিয়ান যুগ। এখন নতুন গবেষণা বলছে, নানান জাতের কুকুর ব্রিড করার প্রবণতা শুরু হয়েছিল বহু আগে। সময়টা প্রায় ১০ হাজার বছর আগে।

ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব এক্সেটারের বায়োআর্কিওলজিস্ট কার্লি অ্যামিন ও তাঁর সহকর্মীরা সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, ৫০ হাজার বছরের বেশি সময়জুড়ে জীবিত ছিল এমন ৬০০টিরও বেশি ক্যানিড তাঁরা বিশ্লেষণ করেছেন। ক্যানিড হলো কুকুর, নেকড়ে শিয়াল বা এই জাতের প্রাণী। বিশ্লেষণ করে তাঁরা বুঝতে পেরেছেন, কুকুরের শরীর, মাথা, মুখের যে বৈচিত্র্য আমরা দেখি, তার অনেককিছুই আদিম যুগে ছিল।

গবেষক কার্লি অ্যামিন বলেছেন, ‘১০ হাজার বছর আগেই আধুনিক কুকুরের অর্ধেক বৈচিত্র্য উপস্থিত ছিল।’ এই তথ্য কুকুরের বৈচিত্র্য নিয়ে ধারণাটাই বদলে দিয়েছে।

আরও পড়ুন
কুকুরের আলাদা প্রজাতি তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল ভিক্টোরিয়ান যুগে। ১৮৩৭ সালের জুন থেকে ১৯০১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়কালকে বলা হয় ভিক্টোরিয়ান যুগ।

এই গবেষকেরা দেখতে চেয়েছিলেন, নেকড়ে থেকে কীভাবে কুকুর এল? কোথায়, কখন, কীভাবে এটি ঘটেছে? এসব প্রশ্ন নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে বহুদিন ধরে বিতর্ক আছে। এই নতুন গবেষণায় বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, সবচেয়ে পুরোনো ক্যানিড খুলি ১২ হাজার ৭০০ বছরেরও আগের। তখন লেট প্লাইস্টোসিন যুগ। কুকুরের খুলি ছিল বেশ সরু, লম্বাটে এবং নেকড়ের মতো। এর তুলনায় আধুনিক কুকুরের খুলিগুলো অনেক বৈচিত্র্যময়। কোনোটি ছোট, কোনোটি চওড়া, আবার কোনোটি শক্তপোক্ত।

সবচেয়ে বুদ্ধিমান কুকুরের প্রজাতি বর্ডার কলি
ফাইল ছবি

মজার বিষয় হলো, পাগ প্রজাতির কুকুরের মতো খুব বেশি চ্যাপ্টা মুখওয়ালা কুকুর তখন ছিল না। প্রাচীন কুকুরের মধ্যে এমন বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়নি। এগুলো আধুনিক যুগে তৈরি। তবে আবার এমন আকৃতির খুলিও পাওয়া গেছে, যা এখনকার কুকুরের মধ্যে নেই। বিজ্ঞানীরা জানার চেষ্টা করেছেন, কেন এগুলো হারিয়ে গেল? সম্ভবত এসব বৈশিষ্ট্যের গুরুত্ব মানুষের কাছে থাকেনি বলে এমন বৈশিষ্ট্য হারিয়ে গেছে।

গবেষণায় আরও জানা গেছে, নিশ্চিতভাবে সময় নির্ধারণ করা সবচেয়ে পুরোনো কুকুরের খুলির বয়স প্রায় ১১ হাজার বছর। এর আগের যে খুলিগুলোকে অনেকে কুকুর ভেবেছিলেন, সেগুলোতে নেকড়ের বৈশিষ্ট্যই বেশি। অস্ট্রেলিয়ার আর্কিওলজিস্ট মেলানি ফিলিওস বলেছেন, ‘এই গবেষণা দেখিয়েছে, ১৫ হাজার বছর আগের বিতর্কিত ক্যানিড নমুনাগুলো কুকুর নয়, নেকড়ের কাছাকাছি বৈশিষ্ট্যের প্রাণী।’

আরও পড়ুন
অস্ট্রেলিয়ার আর্কিওলজিস্ট মেলানি ফিলিওস বলেছেন, ‘এই গবেষণা দেখিয়েছে, ১৫ হাজার বছর আগের বিতর্কিত ক্যানিড নমুনাগুলো কুকুর নয়, নেকড়ের কাছাকাছি বৈশিষ্ট্যের প্রাণী।’

তাহলে কুকুর এত বৈচিত্র্যময় হলো কীভাবে?

এর অনেক ব্যাখ্যা আছে। প্রাচীন নেকড়েগুলোই ছিল বৈচিত্র্যময়। মানুষ সঙ্গে বাস করায় অনেক কুকুর বেঁচে থেকেছে। যেমন খুব ছোট আকারের কুকুরের জাতগুলো এখন বনে বাঁচতে পারবে না। চিহুয়াহুয়া প্রজাতির কুকুরের পক্ষে বনে নেকড়ের মতো বাঁচা সম্ভব নয়। মূলত ঘরে লালনপালন করার কারণে ভিন্ন ভিন্ন আকৃতির কুকুরগুলো টিকে থেকেছে।

মানুষের সহায়তার পাশাপাশি পরিবেশ বদলানো, আলাদা খাদ্যাভ্যাস গড়ে ওঠা, মানুষের নতুন অঞ্চলে চলে যাওয়া, এসবের সঙ্গে কুকুরও বদলে গেছে। কুকুরের শরীরে নতুন বৈচিত্র্য এসেছে। এই বৈচিত্র্য অনেক বেড়ে গেছে ঠিক তখন, যখন পৃথিবীজুড়ে মানুষ ছড়িয়ে পড়েছে।

বিগল প্রজাতির কুকুর পোষা প্রাণী এবং শিকারী উভয় ক্ষেত্রেই জনপ্রিয়।
ছবি: ব্রিটানিকা

নতুন আরেক গবেষণায় জানা গেছে, মানুষ যখন মহাদেশজুড়ে ঘুরছে, তখন কুকুরও তাদের সঙ্গে ঘুরেছে। কখনো কখনো এক সমাজ অন্য সমাজে কুকুর বাণিজ্য করেছে। চীনের কুনমিং ইনস্টিটিউট অব জুওলজির গবেষক গুয়ো-ডং ওয়াং জানান, শিকারি-সংগ্রাহক, কৃষিজীবী, যাযাবর, সব সমাজই নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন জাতের কুকুর পালন করত।

তাই এখনকার কুকুরের রং, আকার, আকৃতি, মুখ, লেজসহ সবকিছুর বৈচিত্র্য শুধু আধুনিক মানুষের হাতে তৈরি হয়নি। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ আর কুকুর পাশাপাশি থেকেছে। ফলে কুকুর বদলে গেছে। দীর্ঘকাল ধরে মানুষের সাহায্যকারী হিসেবে কুকুর হয়ে উঠেছে পৃথিবীর সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় প্রাণীর একটি।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক

সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস

*ব্রিডের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে এই লেখায় 'প্রজাতি' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু এর সঠিক প্রতিশব্দ হবে 'জাত'। পাঠকদের বিভ্রান্তি এড়াতে সেভাবে বদলে দেওয়া হয়েছে—সম্পাদক।

আরও পড়ুন