বাদুড়ের দেহে কি কুকুর বা বিড়ালের চেয়ে বেশি রোগজীবাণু আছে
কোভিড অতিমারির কথা এখন আর কেউ মনে করতে চায় না। তবে হঠাৎ যদি কোনো মহামারী বা অজানা ভাইরাসের কথা ওঠে, সবার মনে ভেসে ওঠে ২০১৯ সালের সেই আতঙ্কের কথা। বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার পর একে একে প্রায় পুরো বিশ্ব লকডাউনে চলে গিয়েছিল। তখন দোষারোপ করা হয়েছিল চীনের বন্যপ্রাণী বিক্রি করা এক মার্কেটের বিশেষ একটি প্রাণীকে, যার নাম বাদুড়। যেন সব ভাইরাস ছড়ানোর জন্য শুধু ওরাই দায়ী।
অন্ধকারের রহস্যময় এই প্রাণীর কপালে এমন অপবাদ নতুন নয়। বাদুড় নিয়ে আছে বেশ কিছু কুসংস্কার। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে লোককথা, ভৌতিক গল্প আর নেতিবাচক প্রচারে বাদুড়কে মানুষ দেখেছে অশুভ শক্তির প্রতীক হিসেবে। তাদের নাম জড়িয়ে আছে রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার এবং আরও অনেক কাল্পনিক চরিত্রের সঙ্গে। আর মহামারীর কারণে তাদের প্রতি ঘৃণা যেন আরও বেড়েছে।
কিন্তু বিশ্বে সবাই বাদুড়কে ঘৃণা করে না। মেক্সিকোর একজন মানুষ তার জীবন উৎসর্গ করেছেন এই ভুল ধারণা ভাঙতে। প্রকৃতিবিজ্ঞানী রদ্রিগো মেডেলিন মেক্সিকান ব্যাট ম্যান নামে পরিচিত। তাঁর মতে, বাদুড় হলো পৃথিবীর সবচেয়ে অন্যায়ভাবে নিগৃহীত প্রাণী।
বাদুড় খুব ধীরে বংশবৃদ্ধি করে। এক বছরে একটি মাত্র বাচ্চা জন্ম দেয়। তাই কোনো এলাকায় একবার তাদের সংখ্যা কমে গেলে তা বাড়ানো খুব কঠিন। মেডেলিন বলেছেন, ‘বাদুড়ের দেহে কুকুর বা বিড়ালের চেয়ে বেশি রোগজীবাণু নেই।
বাদুড়ের প্রতি মেডেলিনের মুগ্ধতা শুরু হয়েছিল মাত্র ১৩ বছর বয়সে, যখন তিনি প্রথমবারের মতো নিজের হাতে একটি বাদুড় ধরেছিলেন। সেই মুহূর্তেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, এই রহস্যময় প্রাণীর সুরক্ষা ও গবেষণায় নিজের জীবন উৎসর্গ করবেন। এরপর থেকে বাদুড়ের গুহাগুলো হয়ে ওঠে তার প্রিয় জায়গা। এই গবেষক বাদুড় নিয়ে কাজ করে একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন এবং এখন তিনি এই প্রাণীগুলোর প্রতি তার ভালো লাগা অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে চান।
পশ্চিমের সংস্কৃতিতে বাদুড়কে প্রায়ই অশুভ শক্তি ও শয়তানের প্রতীক হিসেবে দেখা হলেও, চীনা সংস্কৃতির মতো পূর্বের সংস্কৃতিগুলোতে বাদুড়কে সৌভাগ্য ও সুখের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। বিশ্বে প্রায় ১ হাজার ৪০০ প্রজাতির বাদুড় আছে, যা পৃথিবীর মোট স্তন্যপায়ী প্রাণীর প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। উড়তে সক্ষম একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী এই বাদুড়। বিশ্বজুড়ে এরা বাস করে। রাতে চলাফেরা করতে এরা দক্ষ এবং শিকার খুঁজতে অত্যাধুনিক ইকোলোকেশন পদ্ধতি ব্যবহার করে। মজার ব্যাপার হলো, কিছু প্রজাতির বাদুড় মানুষের চুলের মতো সূক্ষ্ম বস্তুও শনাক্ত করতে পারে।
সাধারণত, বাদুড় খুব ধীরে বংশবৃদ্ধি করে। এক বছরে একটি মাত্র বাচ্চা জন্ম দেয়। তাই কোনো এলাকায় একবার তাদের সংখ্যা কমে গেলে তা বাড়ানো খুব কঠিন। মেডেলিন বলেছেন, ‘বাদুড়ের দেহে কুকুর বা বিড়ালের চেয়ে বেশি রোগজীবাণু নেই। রোগজীবাণুর এই ধারণাটি ব্যাপকভাবে অতিরঞ্জিত করা হয়েছে।’
মানুষের কার্যকলাপে এই উপকারী প্রাণী এখন হুমকির মুখে। বাসস্থান ধ্বংস, কীটনাশকের ব্যবহার এবং সম্প্রতি হোয়াইট নোজ সিন্ড্রোম নামে এক ছত্রাকজনিত রোগ বাদুড়ের সংখ্যা মারাত্মকভাবে কমিয়ে দিয়েছে।
বাদুড়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হলো কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করা। মেক্সিকোর উত্তরাঞ্চলের মাত্র একটি প্রজাতির প্রায় তিন কোটি বাদুড় প্রতি রাতে সবাই মিলে প্রায় ৩০০ টন কীটপতঙ্গ সাবাড় করে। শুধু কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ নয়, বাদুড় আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। ফলভোজী বাদুড় খাবারের খোঁজে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার সময় বীজ ছড়িয়ে দেয়। এই বীজগুলো মাতৃগাছ থেকে অনেক দূরে গিয়ে পড়ে, যা বনজ পরিবেশ ধরে রাখতে এবং উদ্ভিদের বৈচিত্র্য রক্ষায় সাহায্য করে। অনেক উদ্ভিদের মূল পরাগায়নকারী হিসেবে কাজ করে বাদুড়।
মানুষের কার্যকলাপে এই উপকারী প্রাণী এখন হুমকির মুখে। বাসস্থান ধ্বংস, কীটনাশকের ব্যবহার এবং সম্প্রতি হোয়াইট নোজ সিন্ড্রোম নামে এক ছত্রাকজনিত রোগ বাদুড়ের সংখ্যা মারাত্মকভাবে কমিয়ে দিয়েছে। ফলে বাদুড়ের অনেক প্রজাতিকে এখন বিপন্ন বা হুমকির মুখে থাকা প্রাণীর তালিকায় রাখা হয়েছে। গবেষক মেডেলিন প্রশ্ন করেন, ‘যদি এক রাতে আমরা সব বাদুড় হারিয়ে ফেলি, তাহলে কী হবে? বাদুড় হারিয়ে গেলে আমাদের ফসল ক্ষুধার্ত কীটপতঙ্গ দিয়ে আক্রান্ত হবে। মশার সংখ্যা বহুগুণে বেড়ে যাবে। আমাদের জীবনযাত্রার আমূল পরিবর্তন হবে।’
বাদুড় আমাদের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়লে বাদুড়ের প্রতি ভয় কমে যাবে। বাদুড় রক্ষায় আমাদের উদ্যোগী হতে হবে।