রক্তের রং লাল হলেও শিরা কেন নীল দেখায়
আপনার হাত বা কব্জির শিরাগুলো দেখতে কোন রঙের? সবুজ নাকি নীল? যে রঙেরই হোক, চিন্তার কিছু নেই। রক্তের রং যে লাল, তা হয়তো সবার জানা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, রক্ত যে শিরা দিয়ে প্রবাহিত হয়, সেই শিরাগুলো কেন নীল বা সবুজ দেখায়?
সাধারণত বলা হয়, অক্সিজেনসমৃদ্ধ রক্ত লাল হয়। অক্সিজেন ঘাটতি দেখা দিলে রক্ত নীল দেখায়। কিন্তু এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। রক্ত কখনোই নীল হয় না। রক্তের রঙয়ের মূল কারণ হলো লোহিত কণিকায় থাকা হিমোগ্লোবিন নামে একটি প্রোটিন। এই প্রোটিনে লোহা বা আয়রন থাকে।
হিমোগ্লোবিনই মূলত দেহের ফুসফুস ও প্রতিটি কোষের মধ্যে অক্সিজেন বা কার্বন ডাই-অক্সাইড আদান-প্রদান করে। রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে লাল রং পরিবর্তিত হয়। যখন হিমোগ্লোবিন ফুসফুস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে, তখন রক্ত উজ্জ্বল লাল রঙের হয়। এই উজ্জ্বল রক্ত ধমনী দিয়ে শরীরের বিভিন্ন টিস্যুতে প্রবাহিত হয়।
আমাদের ত্বকের নিচের শিরাগুলো নীল বা সবুজ দেখায় মূলত দৃষ্টিবিভ্রমের কারণে। আমরা যে রং দেখি তা নির্ভর করে আলোকরশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ওপর। আমাদের ত্বক লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য শোষণ করে।
শরীরের বিভিন্ন কোষে অক্সিজেন পৌঁছে দেওয়ার পর হিমোগ্লোবিন অক্সিজেন ত্যাগ করে। তখন রক্তের লাল রং কিছুটা গাঢ় বা কালচে দেখায়। এই গাঢ় লাল রক্তই শিরা দিয়ে আবার হৃৎপিণ্ডের দিকে ফিরে আসে। সুতরাং, রক্তের লাল রং অক্সিজেনের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে উজ্জ্বল বা গাঢ় হয়, কিন্তু কখনোই নীল হয় না।
যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটেলের ওয়াশিংটন স্কুল অব মেডিসিনের হেমাটোলজির সহকারী অধ্যাপক ক্লেবার ফার্ট্রিন জানান, ‘শরীরের টিস্যুতে অক্সিজেন সরবরাহ করার পরে শিরা দিয়ে প্রবাহিত রক্তের রং গাঢ় লাল থাকে।’
আপনি যদি কখনো কাউকে রক্ত দিয়ে থাকেন, তাহলে হয়তো ব্যাপারটি খেয়াল করেছেন। যখন সূঁচটি আপনার নীল বা সবুজ শিরায় প্রবেশ করে, তখন টিউবে যে রক্ত জমা হয়, তা দেখতে গাঢ় লাল রঙের হয়। কারণ, এই রক্তে অক্সিজেনের ঘাটতি রয়েছে।
আমাদের ত্বকের নিচের শিরাগুলো নীল বা সবুজ দেখায় মূলত দৃষ্টিবিভ্রমের কারণে। আমরা যে রং দেখি তা নির্ভর করে আলোকরশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ওপর। আমাদের ত্বক লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য শোষণ করে। কিন্তু নীল বা সবুজ আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যকে প্রতিফলিত করে। যেহেতু শিরাগুলো ত্বকের নিচে থাকে, তাই নীল এবং সবুজ আলোকরশ্মি প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে ধরা দেয়। ফলে শিরার ভেতরের গাঢ় লাল রক্ত থাকার পরও আমাদের কাছে সেগুলোকে নীল বা সবুজ দেখায়। তবে যাদের ত্বক মোটা, তাদের শিরা দেখায় সবুজ। আবার হালকা ত্বকের শিরা দেখায় নীলচে বা বেগুনি।
যেসব রক্তনালী ত্বকের অনেক গভীরে থাকে, শুধু সেগুলোই নীল বা সবুজ দেখায়। ত্বকের ঠিক নিচে থাকা কৈশিক নালি অর্থাৎ ছোট রক্তনালীগুলোতে এই দৃষ্টিভ্রম হয় না। এটা হয় কারণ ধমনী এবং ছোট রক্তনালী ত্বকের অনেক কাছাকাছি থাকে। শিরাগুলো ত্বকের গভীরে থাকায় সেগুলোকে নীল দেখালেও ত্বকের কাছে থাকা ধমনী থেকে প্রবাহিত উজ্জ্বল লাল রক্ত সহজেই চোখে পড়ে। এ কারণেই আঙুলের মাথায় গোলাপি আভা দেখা যায়।
মানুষের রক্ত নীল না হলেও প্রকৃতিতে নীল রক্তের দেখা মেলে। কাঁকড়া, গলদা চিংড়ি, অক্টোপাস এবং মাকড়সার মতো কিছু প্রাণীর রক্ত নীল রঙের হয়।
আবার আঘাতের কারণে যখন ত্বকের নিচে রক্ত জমে যায়, তখন ক্ষতের সৃষ্টি হয়। যদি আঘাতটি ত্বকের কাছাকাছি হয়, তাহলে ক্ষতটি লাল বা বেগুনি দেখায়। কিন্তু যদি এটি আরও গভীর হয়, তাহলে এটি বেগুনি-নীল দেখাবে। যেমনটা দেখা যায় গুরুতর কোনো আঘাতে। কারণ, রক্তের রং নিজ থেকে পরিবর্তিত হয় না। এটি কেবল নির্ভর করে আমরা কীভাবে ত্বকের ভেতর দিয়ে রক্তকে দেখছি তার ওপর।
মানুষের রক্ত নীল না হলেও প্রকৃতিতে নীল রক্তের দেখা মেলে। কাঁকড়া, গলদা চিংড়ি, অক্টোপাস এবং মাকড়সার মতো কিছু প্রাণীর রক্ত নীল রঙের হয়। আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির মতে, এই প্রাণীদের রক্তে মানুষের রক্তের মতো আয়রনের বদলে তামা থাকে। মানুষের রক্তে থাকা হিমোগ্লোবিন প্রোটিনে আয়রন থাকে বলে তা লাল হয়। কিন্তু এই প্রাণীগুলোর রক্তে থাকা হেমোসায়ানিন প্রোটিনে থাকে তামা। এই তামার উপস্থিতির কারণেই ওসব প্রাণীর রক্ত নীল দেখায়।