প্রাচীন মিশর থেকে আধুনিক বিজ্ঞানে চুল গজানোর রহস্য
চুল আমাদের শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। আমরা সবাই চাই আমাদের মাথা ঘন, কালো ও সুস্থ চুলে ভরা থাকুক। এই ইচ্ছাটি একেবারেই ব্যক্তিগত নয়, বরং এটি সার্বজনীন ও চিরন্তন।
খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে লেখা মিশরের সবচেয়ে পুরোনো চিকিৎসা পুঁথি ‘Ebers Papyrus’-এ এর প্রমাণ মেলে। সেখানে চুল পড়ার চিকিৎসায় কুমিরের চর্বি বা সিংহের রক্ত মাথায় লাগানোর কথা বলা আছে। আবার আমাদের মায়েরা ভাবেন, চুল কেটে ফেললেই বুঝি আরও ঘন চুল গজায়!
কিন্তু আসলেই কি তেমন কিছু সম্ভব? উত্তর, না। আমাদের পুরো শরীরে প্রায় ৫০ লাখ হেয়ার ফলিকল থাকে। এর মধ্যে শুধু মাথার ত্বকেই রয়েছে প্রায় এক থেকে দেড় লাখ হেয়ার ফলিকল। আর মাতৃগর্ভে থাকতেই আমাদের শরীরে ফলিকলের এই সংখ্যা নির্ধারিত হয়ে যায়। জন্মের পর নতুন কোনো ফলিকল আর তৈরি হয় না।
তাই জন্মের সময় যাদের মাথায় চুল বেশি থাকে, তারা ভাগ্যবান। এখন প্রশ্ন হলো, নতুন চুল যদি না-ই গজায়, তাহলে যা আছে সেগুলো ঝরে যায় কেন? এর উত্তর জানতে হলে আগে বুঝতে হবে, ফলিকল কী?
হেয়ার ফলিকল: চুলের প্রাণকেন্দ্র
হেয়ার ফলিকল ত্বকের ভেতরে থাকা একটি ক্ষুদ্র অঙ্গ। এটি দেখতে অনেকটা নলের মতো। এখান থেকেই চুলের কাণ্ড জন্মায়। এককথায়, হেয়ার ফলিকলই হলো চুলের প্রাণ।
ফলিকল আবিষ্কারের ইতিহাস
বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে হেয়ার ফলিকল নিয়ে গবেষণা করছেন। অনানুষ্ঠানিক এই গবেষণা শুরু লিওনার্দো দা ভিঞ্চির হাত ধরে। ভিঞ্চি নিজের নোটবুকে চুলের গঠন আঁকার চেষ্টা করেন। সেখানে তিনি ফলিকল শব্দ ব্যবহার না করলেও চুলের শিকড় যে ত্বকের ভেতরে থাকে, তা বুঝতে পেরেছিলেন। ১৬৬০ সালে ইতালীয় অণুবীক্ষণবিদ মার্সেলো মালপিজি প্রথমবার মাইক্রোস্কোপে ত্বকের ভেতরে ক্ষুদ্র থলির মতো গঠন দেখতে পান। তিনি বুঝতে পারেন, এখান থেকেই চুল জন্মায়। যদিও তিনি একে ‘গ্ল্যান্ডুলা’ বা গ্রন্থি ভেবেছিলেন।
এর কিছুদিন পর মাইক্রোস্কোপের জনক অ্যান্টনি ভন লিউয়েনহুক নিজের তৈরি শক্তিশালী লেন্স দিয়ে চুলের গঠন দেখেছিলেন। তিনি চুলের ভেতরের স্তর মেডুলা ও বাইরের স্তর কিউটিকলের বর্ণনা দেন। ১৭৮৬ সালে জার্মান অ্যানাটমিস্ট জি. সি. লিখটেনবার্গ প্রথমবার বৈজ্ঞানিকভাবে ‘হেয়ার ফলিকল’ শব্দটি ব্যবহার করেন। আর ১৯ শতকে জ্যাকব হেনলে ও রুডলফ ভার্চো ফলিকলের ভেতরের কোষের স্তরগুলো প্রথম আলাদাভাবে চিহ্নিত করেন।
চুলের জীবনচক্রের রহস্য উন্মোচন
১৯২০-এর দশকে চুলের জীবনচক্রের রহস্য উন্মোচিত হয়। সুইস অ্যানাটমিস্ট হারমান পিনকাস এবং জার্মান বিজ্ঞানী অ্যাডলফ বুটেনান্ডের গবেষণা এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁরাই আবিষ্কার করেন যে চুল মূলত বৃদ্ধি, সংকোচন ও বিশ্রাম নামে তিনটি ধাপের একটি চক্র অনুসরণ করে। এই আবিষ্কার ছিল যুগান্তকারী। এর মাধ্যমেই প্রথম বোঝা যায়, কেন নির্দিষ্ট সময় পর চুল ঝরে পড়ে এবং কেন আবার নতুন চুল গজায়।
হেয়ার ফলিকল: এক ক্ষুদ্র কারখানা
আমাদের মাথার ত্বককে একটি কৃষিক্ষেত্রের সঙ্গে তুলনা করা যায়। এই ক্ষেতের মাটির নিচে রয়েছে অসংখ্য ক্ষুদ্র ‘কুয়া’ বা ‘টানেল’। এই টানেলগুলোই হলো হেয়ার ফলিকল। প্রতিটি ফলিকল যেন চুল তৈরির একেকটি জীবন্ত ছোট কারখানা। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে দেখা যায়, একটি ফলিকল আসলে অনেকগুলো স্তর ও কোষ নিয়ে গঠিত। এর প্রধান অংশগুলো হলো:
হেয়ার শ্যাফট: এটি চুলের দৃশ্যমান অংশ। আমরা এই অংশেই চিরুনি চালাই, রং করি বা কাটি। এটি মূলত মৃত কেরাটিন প্রোটিন দিয়ে তৈরি।
রুট: এটি চুলের মূল। রুট ত্বকের ভেতরে লুকানো থাকে।
হেয়ার বাল্ব: এটি ফলিকলের নিচের দিকের গম্বুজের মতো অংশ। এখানেই ম্যাট্রিক্স কোষ বিভাজিত হয়ে নতুন চুল তৈরি করে।
ডার্মাল প্যাপিলা: এটিকে ফলিকলের ‘কমান্ড সেন্টার’ বলা যায়। এতে থাকা রক্তনালী চুলের কোষকে অক্সিজেন, পুষ্টি ও হরমোন সরবরাহ করে।
ইনার ও আউটার রুট শিথ: এগুলো চুলের চারপাশে প্যাকেজিংয়ের মতো কাজ করে এবং চুলকে ওপরের দিকে ঠেলে দেয়। বাইরের স্তরে থাকা ‘বাল্জ’ নামে অংশটি স্টেম সেলে পূর্ণ থাকে। চুল পুনরায় জন্মানোর প্রধান কেন্দ্র এই বাল্জ।
সেবাসিয়াস গ্ল্যান্ড: এটি ফলিকলের সঙ্গে যুক্ত থেকে সেবাম নামে তেল নিঃসরণ করে। এই তেল চুলকে নরম ও আর্দ্র রাখে।
অ্যারেক্টর পিলি পেশি: ভয় পেলে বা ঠান্ডা লাগলে এই ক্ষুদ্র পেশি সংকুচিত হয়। এর ফলেই আমাদের লোম খাড়া হয়ে যায়।
চুলের জীবনচক্র
চুলের গঠন একটি নির্দিষ্ট চক্র অনুসরণ করে। একেই বলে হেয়ার ফলিকলের জীবনচক্র। সেগুলো হলো:
অ্যানাজেন বা বৃদ্ধি ধাপ: এটি সবচেয়ে দীর্ঘ ধাপ। এটি ২-৭ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এই ধাপে মাথার প্রায় ৮৫–৯০ শতাংশ চুল থাকে।
ক্যাটাজেন বা সংকোচন ধাপ: এটি কয়েক সপ্তাহ স্থায়ী হয়। এই পর্যায়ে চুল তৈরি বন্ধ হয়ে যায় এবং ফলিকল ছোট হতে শুরু করে।
টেলোজেন বা বিশ্রাম ধাপ: এটি প্রায় ৩ মাস স্থায়ী হয়। এই ধাপে পুরোনো চুল ঝরে পড়ার জন্য প্রস্তুত হয়। মাথার প্রায় ১০–১৫ শতাংশ চুল থাকে এই ধাপে।
এক্সোজেন বা ঝরে পড়ার ধাপ: এই ধাপে পুরোনো চুল পুরোপুরি ঝরে পড়ে এবং নতুন চুল ওঠার জন্য জায়গা তৈরি হয়। এরপর আবার অ্যানাজেন ধাপ শুরু হয়। একেকটি ফলিকল প্রায় ২০–৩০ বার নতুন চুল গজাতে সক্ষম। একজন সুস্থ মানুষের জন্যও প্রতিদিন গড়ে ৫০–১০০টি চুল পড়া স্বাভাবিক।
এই চক্র বুঝতে পারার পরই বিজ্ঞানীরা জানতে পারলেন, কেন কারো চুল লম্বা হয়, কারো আবার ছোট থাকে। যেমন, মাথার চুলে অ্যানাজেন দীর্ঘ বলে চুল বড় হয়। কিন্তু ভ্রু বা পাপড়িতে তা ছোট বলে এগুলো ছোট থাকে।
পিআরপি (PRP) একটি আধুনিক চিকিৎসা। এখানে রোগীর নিজের রক্ত থেকে প্লাজমা আলাদা করা হয়। এরপর সেই প্লাজমা মাথার ত্বকে ইনজেকশন হিসেবে দেওয়া হয়।
চুল পড়ার কারণ ও প্রতিকার
হেয়ার ফলিকল একটি ক্ষুদ্র কারখানার মতো। এই কারখানাকে সচল রাখতে পুষ্টি, হরমোন ও অক্সিজেন লাগে। এর কোনো একটির ঘাটতি হলেই চুল পড়তে শুরু করে।
চুল কেরাটিন নামে প্রোটিন দিয়ে তৈরি। প্রোটিনের ঘাটতি হলে চুল ভঙ্গুর হয়ে যায়। আয়রন ফলিকলের কোষে অক্সিজেন পৌঁছে দেয়। জিঙ্ক চুল তৈরির কোষ বিভাজনে সাহায্য করে। এই খনিজ উপাদানগুলোর অভাবে পুরো মাথার চুল পাতলা হয়ে যেতে পারে।
ঘুম কম হলে রক্তে কর্টিসল নামে স্ট্রেস হরমোন বাড়ে। এটি ফলিকলের ক্ষতি করে। দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপও ফলিকলকে বিশ্রাম ধাপে (Telogen) পাঠিয়ে দেয়। ফলে হঠাৎ অনেক চুল একসঙ্গে ঝরে পড়ে। এই অবস্থাকে বলে টেলোজেন এফ্লুভিয়াম। এমনকি ‘ক্রাশ ডায়েট’ করলে প্রথমেই চুলের ক্ষতি হয়।
চুল পড়ার আধুনিক চিকিৎসা
চুল রক্ষার জন্য এত এত গবেষণা হলেও চুলের জন্য প্রথম ওষুধ আবিষ্কার হয়েছিল অপ্রত্যাশিতভাবে। ১৯৭০-এর দশকে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ হিসেবে মিনোক্সিডিল ব্যবহৃত হতো। কিন্তু পরে দেখা গেল, ওষুধ খাওয়ার পর শরীরে অতিরিক্ত চুল গজাচ্ছে! অর্থাৎ, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে রোগীদের শরীরে অতিরিক্ত চুল গজাচ্ছে। এই ধারণা থেকেই চুল গজানোর জন্য মিনোক্সিডিল লোশন তৈরি হয়।
মিনোক্সিডিল মাথার ত্বকের রক্তপ্রবাহ বাড়ায়। এটি ফলিকলকে আবার বৃদ্ধি ধাপে ফিরিয়ে আনে। তবে ওষুধ ব্যবহার বন্ধ করলে চুল আবার ঝরে পড়তে পারে।
পুরুষদের টাক পড়ার মূল কারণ ডাইহাইড্রোটেস্টোস্টেরন (DHT) নামে হরমোন। এটি ফলিকলকে সংকুচিত করে ফেলে। ফিনাস্টেরাইড নামে ওষুধ এই DHT হরমোনকে বাধা দেয়। এটি টাক পড়া কমাতে সাহায্য করে। তবে এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও রয়েছে।
পিআরপি (PRP) একটি আধুনিক চিকিৎসা। এখানে রোগীর নিজের রক্ত থেকে প্লাজমা আলাদা করা হয়। এরপর সেই প্লাজমা মাথার ত্বকে ইনজেকশন হিসেবে দেওয়া হয়। প্লাজমায় থাকা গ্রোথ ফ্যাক্টর ফলিকলকে পুনরায় সক্রিয় করে।
তবে চুলের স্থায়ী সমাধান হিসেবে হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট এখন জনপ্রিয়। এর আধুনিক রূপটির ধারণা দেন ১৯৫২ সালে নিউইয়র্কের ডার্মাটোলজিস্ট নর্মান ওরেনট্রিচ। যদিও এর ভিত্তি ছিল ১৯৩০-এর দশকের জাপানি চিকিৎসকরা।
আর হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট পদ্ধতির মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে প্রচলিত FUE (ফলিকুলার ইউনিট এক্সট্রাকশন) আর FUT (ফলিকুলার ইউনিট ট্রান্সপ্লান্টেশন)। এই পদ্ধতিতে মাথার পেছনের দিক থেকে ফলিকল নিয়ে টাক অংশে বসানো হয়। তাই এটি বেশ স্থায়ী সমাধান, তবে ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ।
চুল নিয়ে গবেষণার ভবিষ্যৎ
তবে চুল নিয়ে গবেষণা এখানেই থেমে নেই। ১৯৯০-এর দশকে যুক্ররাষ্ট্রের জর্জ কোটসারেটিস ফলিকলের ‘বাল্জ’ অংশে স্টেম সেল আবিষ্কার করেন। এখন বিজ্ঞানীরা সেই স্টেম সেল পরীক্ষাগারে বানিয়ে মাথায় প্রতিস্থাপনের চেষ্টা করছেন। কৃত্রিম ফলিকল তৈরির চেষ্টাও চলছে। স্টেম সেল থেরাপি ও হেয়ার ক্লোনিং সফল হলে হয়তো ভবিষ্যতে টাক পড়া বন্ধ হয়ে যাবে।