বেআক্কেল আক্কেল দাঁত!
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়ই আক্কেল দাঁতের এক্স-রে ছবি ভাইরাল হতে দেখা যায়। সেসব ছবিতে দেখানো দাতের নাম আক্কেল বা বুদ্ধির দাঁত হলে কী হবে, ‘তিনি’ গজাচ্ছেন দিব্যি আড়াআড়ি কিংবা বাঁকা হয়ে—একেবারে বেআক্কেলের মতোই! অনেক সময় দেখা যায়, মাড়িতে হয়তো আক্কেল দাঁতের জন্য তিলধারণের জায়গা নেই, তবুও সে নাছোড়বান্দা; জোর করে যেভাবেই হোক মাথা চাড়া দিয়ে উঠবেই।
ছোটবেলায় শিশুদের চোয়াল খুব ছোট থাকে, তাই তখন সেখানে আক্কেল দাঁত ওঠার জায়গা হয় না। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চোয়ালও বড় হতে থাকে, ফলে একসময় আক্কেল দাঁত ওঠার মতো যথেষ্ট জায়গা তৈরি হয়। সমস্যা হলো, বিবর্তনের এই আধুনিক ধাপে এসে অনেক মানুষের চোয়ালই আর আগের মতো যথেষ্ট লম্বা বা প্রশস্ত হয়ে ওঠে না। ফলে আক্কেল দাঁত ওঠার সময় বাধে বিপত্তি। আর এ জন্যই আক্কেল দাঁত পুরোপুরি ওঠার আগেই সেটা তুলে ফেলার ব্যবস্থা করতে হয়। মূলত এসব কারণেই এখন আক্কেল দাঁত তোলা একটা সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
আক্কেল দাঁতের সঙ্গে আদিম সম্পর্ক
প্রাচীনকালে মানুষ শক্ত বাদাম, কাঁচা সবজি কিংবা শিকার করা শক্ত মাংসের মতো কঠিন সব খাবার খেত। ছোটবেলা থেকেই এমন শক্ত খাবার চিবিয়ে খাওয়ার ফলে তাদের চোয়াল বেশ বড় ও মজবুত হতো। অন্যদিকে আধুনিক এই শিল্পোন্নত সমাজে আমরা নরম খাবার বেশি খাই, ফলে আমাদের চোয়াল তার প্রাকৃতিক সম্ভাবনা অনুযায়ী আর ততটা বড় হওয়ার সুযোগ পায় না।
কানাডার ইউনিভার্সিটি অব সাসকাচুয়ানের নৃতত্ত্ববিদ জুলিয়া বউনার জানান, প্রাচীনকালে মানুষ কঠিন খাবার খেতে খেতে তাদের প্রথম বা দ্বিতীয় মোলার (চিবানোর দাঁত) ক্ষয় করে ফেলত, কখনো কখনো হারিয়েও ফেলত। সেই শূন্যস্থান পূরণ করতেই তখন ত্রাতা হিসেবে হাজির হতো আক্কেল দাঁত বা তৃতীয় সেটের মোলার।
যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের সিডারস সাইনাই হাসপাতালের ওরাল সার্জন স্টিভেন কাপফারম্যান বিষয়টি খুব চমৎকারভাবে বুঝিয়ে বলেছেন। তাঁর মতে, ‘আক্কেল দাঁত হলো একধরনের ব্যাকআপ দাঁত। যদি কোনো মোলার দাঁত নষ্ট হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে তার প্রক্সি দিতে বা বদলি হিসেবে এটি চলে আসে!’ অর্থাৎ ছোটবেলায় যদি আপনি মোলার দাঁত হারাতেন বা সেটা ক্ষয় হয়ে যেত, তবে সেই ফাঁকা জায়গায় দ্রুতই গজে উঠত আক্কেল দাঁত।
সাধারণত ২৭ বছর বয়সের পর খুব জরুরি না হলে আক্কেল দাঁত তোলা হয় না। কারণ, তখন দাঁত তুলতে গেলে স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
কোন দাঁত কখন ওঠে
মানুষের প্রথম মোলার দাঁত ওঠে প্রায় ৬ বছর বয়সে, ঠিক যখন শিশুরা দুধদাঁত হারাতে শুরু করে। এরপর দ্বিতীয় মোলার ওঠে প্রায় ১২ বছর বয়সে। উদ্দেশ্য, ৬ বছর বয়সে ওঠা মোলারটি নষ্ট হয়ে গেলে যেন সে তার জায়গা নিতে পারে। সবশেষে তৃতীয় মোলার বা আক্কেল দাঁত সাধারণত ১৭ থেকে ২১ বছর বয়সের মধ্যে উঁকি দেয়।
কেন আক্কেল দাঁত তোলা হয়
আজকাল অনেকের মুখগহ্বরে বা চোয়ালে জায়গা থাকে কম। ফলে আক্কেল দাঁত উঠতে গেলেই ব্যথা, ফোলা বা দাঁতজট তৈরি হয়। তাই দাঁতের ডাক্তাররা এগুলো তুলে ফেলার পরামর্শ দেন। অনেক সময় ব্যথা না থাকলেও ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সমস্যা, যেমন মাড়ির সংক্রমণ এড়াতে ডাক্তাররা আগেভাগেই আক্কেল দাঁত তুলে ফেলতে বলেন।
সাধারণত ২৭ বছর বয়সের পর খুব জরুরি না হলে আক্কেল দাঁত তোলা হয় না। কারণ, তখন দাঁত তুলতে গেলে স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তবে তীব্র ব্যথা বা মারাত্মক সংক্রমণ হলে যেকোনো বয়সেই আক্কেল দাঁত তোলার প্রয়োজন হতে পারে।
তবে আক্কেল দাঁত রেখে দিলে ভবিষ্যতে সমস্যা হতে পারে। কারণ, সব আক্কেল দাঁত পুরোপুরি মাড়ি ভেদ করে উঠতে পারে না।
সব মানুষের আক্কেল দাঁত থাকে না
বেশির ভাগ মানুষের ৩২টি দাঁত থাকে, যার মধ্যে ৪টি হলো আক্কেল দাঁত। তবে কিছু মানুষের আক্কেল দাঁত কম বা বেশিও থাকতে পারে। আবার কারও কারও একেবারেই আক্কেল দাঁত থাকে না, এমনটাও দেখা যায়।
কেউ কেউ আবার আক্কেল দাঁতের পেছনে চতুর্থ মোলার বা প্যারামোলার নিয়ে জন্মায়। আধুনিক মানুষের মুখে তার জায়গা কখনোই হয় না। তাই আক্কেল দাঁতের সঙ্গে সেটিকেও তুলে ফেলা হয়। তবে আক্কেল দাঁত না তুলেও অনেকে ভালো থাকেন। স্টিভেন কাপফারম্যান বলেন, ‘অনেক সময় ব্রেস লাগানোর জন্য কিছু দাঁত তোলা হয়। ফলে চোয়ালে জায়গা তৈরি হয়। তখন আক্কেল দাঁতও রেখে দেওয়া যায়।’ যদিও খুব অল্প ক্ষেত্রেই প্রাকৃতিকভাবে আক্কেল দাঁত নিজের জায়গা করে নিতে পারে।
তবে আক্কেল দাঁত রেখে দিলে ভবিষ্যতে সমস্যা হতে পারে। কারণ, সব আক্কেল দাঁত পুরোপুরি মাড়ি ভেদ করে উঠতে পারে না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাড়ি সরে গেলে আক্কেল দাঁত আংশিক বেরিয়ে পড়ে। তখন এগুলোতে খুব সহজেই ক্যাভিটি বা গর্ত হয়। আর সে ক্ষেত্রে দাঁতটি তোলা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না!
কিন্তু আক্কেল দাঁত যদি কোনো সমস্যা তৈরি না করে, তা হলে রেখে দিতে পারেন। আক্কেল দাঁত হলেই যে তুলে ফেলতে হবে, বিষয়টা এমন নয়। পর্যাপ্ত জায়গা নিয়ে আক্কেল দাঁত উঠলে সাধারণত সমস্যা হয় না!