প্রাণীজগৎ
আমার দেশের পাখি
এ দেশে কতরকম, কত ধরনের পাখি। রং-বেরঙের এসব পাখি নিয়ে লিখেছেন পাখিবিশারদ ও প্রকৃতিবিদ শরীফ খান…
সুন্দরবন। কটকা নদীর মোহনার ওপরে চক্কর দিচ্ছে এক জোড়া সাদাবুক সাগর ঈগল। দুটি বনমোরগ আর সাতটি বন মুরগি চরছে কেওড়াবনের ভেতরে। সঙ্গে ওদের এক ডজন তুলতুলে ছানা। ওদের আশপাশ থেকেই উড়ন্ত পোকা-মাকড় ধরে খাচ্ছে একটি দুধসাদা দুধরাজ পাখি। গরানের ডালে বসে একটি ভীমরাজ পাখি ডাকছে। দুলে দুলে উড়ে কটকা নদী পাড়ি দিচ্ছে একটি কেশরাজ পাখি। একজোড়া কালো মাথা মাছরাঙ্গা বসে আছে নদীর পাড়ের একটা নিচু গাছে। কটকা সী-বীচে আছড়ে পড়ছে ঢেউ। দুটি গাঙচিল হোভারিং করছে ওখানে।
কটকা নদীতে এখন পূর্ণ ভাটা। জেগে গেছে নদীর পাড়ের চর। ওই চরের কিনারা জুড়ে সারি সারি কেওড়া গাছ। একটা কেওড়া গাছের মাথায় বসে আছে ১৭টি শামুকভাঙা পাখি। তার এ পাশে নদীর চর ধরে হেঁটে চলেছে ৩টি মদনটাক পাখি। আশপাশে গোটা কয়েক ছোট গুলিন্দা পাখি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে চরছে। একটু দূরে-খালের মুখের কেয়া-ঝোপের পাশে বসে পালক প্রসাধন করছে ৩টি সুন্দরী হাঁস (মান্ড ফিন ফুট) পাখি। বহুদূরে জঙ্গলের মাথার ওপরে ঘুরপাক খাচ্ছে একঝাঁক আলতাপরী পাখি।
গারোপাহাড়। একটি পাহাড়ের পাদদেশে বিশ্রাম নিচ্ছে একদল বুনোহাতি। ওদের চারপাশে ঘুরছে একটি গো-বক। একটি হাতির পিঠের ওপরে ঘুরে পোকা খুঁজছে ৪টি ভাত শালিক। ৭টি শঙ্খ শালিক খাবার খুঁজছে পাহাড়ের মাথার বিশাল একটা গাছের ডাল-পালায়। ওপাশের পাহাড়ের মাথা থেকে ভেসে আসছে ময়না পাখির বুক হিম করা শিস। হাতিগুলোর একটু ওপাশে, মাটিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে মোট ৭টি মোহনচূড়া পাখি। ওর ভেতরে ৫টি-ই বাচ্চা। উড়তে শিখেছে কেবল। গারো পাহাড়ের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া টলটলে জলের পাহাড়ি নদী সোমেশ্বরীর বুকে ভাসছে ৩টি বালিহাঁস। সোমেশ্বরী পাড়ি দিয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের দিকে উড়ে চলেছে একঝাঁক বড় সাদা বক।
প্রায় ৭০০ রকম পাখি আছে আমার দেশে। তার ভেতর প্রায় অর্ধেক পাখি এ দেশে আসে বছরের বিশেষ বিশেষ সময়ে। আবার চলে যায়।
এই যে দুটি জায়গার কথা বললাম আমি, বললাম কিছু পাখির কথা—আরও অনেক পাখি আছে ওই দুটি এলাকায়। উত্তরে গারো পাহাড়, দক্ষিণে সুন্দরবন, এটুকুর ভেতরেই তো আমার দেশ, সোনার বাংলাদেশ। এটুকুর ভেতরেই আছে কত বন-বনানী, নদী-খাল, হাওর-বিল আর জলাভূমি। আছে নানান রকম পাখি। আমার দেশটা যেমন গানের দেশ, তেমনি ফুল-পাখি-প্রজাপতিরও দেশ। আমার এই দেশটা যেমন সুন্দর, তেমনি সুন্দর আমার দেশের পাখিগুলোও। প্রায় ৭০০ রকম পাখি আছে আমার দেশে। তার ভেতর প্রায় অর্ধেক পাখি এ দেশে আসে বছরের বিশেষ বিশেষ সময়ে। আবার চলে যায়। ওরা তাই আমার দেশের স্থায়ী পাখি নয়। আমার দেশের স্থায়ী পাখিদের শহর-নগর-বন্দরসহ প্রায় সব জায়গাতেই দেখা যায়।
গারোপাহাড় ছাড়াও আমার দেশে আছে পাহাড়িবন শালবন ও টিলাময় বন। পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি বনে ঘুরলে, সিলেটের টিলাময় বনে ঘুরলে এমন কিছু পাখি দেখা যাবে যা সুন্দরবন তো বটেই, দেশের অন্য কোথাও নেই। যেমন, ধনেশ পাখি। আবার সুন্দরবনের সুন্দরী হাঁসকে পার্বত্য বনে পাওয়া যাবে না। কিন্তু বনমোরগ আর ভীমরাজ পাখি সুন্দরবনে যেমন আছে, তেমনি আছে সিলেট-চট্টগ্রামে।
আমার দেশটা তো পাখিরই দেশ। কত সুন্দর সুন্দর নামের পাখি যে আছে! ফুলঝুরি, চশমা পাখি, ভরত, নীলকণ্ঠ, বসন্তবৌরি, ফুটফুটি, লেজনাচুনে, কমলাবউ, হলদে বউ, সহেলি, মুনিয়া, খঞ্জন, দোয়েল, শ্যামা, নীলপরি, হালতি, বড় হালতি, পাপিয়া, ডুবুরি, রঙিলা বক, মথুরা, হট্টিটিসহ আরও কত নাম! বিদঘুটে নামের পাখিও আছে আমার দেশে। যেমন কসাই, হাঁড়িচাচা, গোবরে শালিক, জলডাকাত ইত্যাদি।
কিছু পাখি আছে যারা রাতের বেলায় চরে। এরা হচ্ছে নিশাচর পাখি। এ দলে পড়ে ভুতুম পেঁচার দল, নিশিবক ও দিনেকানা। ভুতুম পেঁচারা ফসলের ক্ষেতের ইঁদুর খেয়ে বড় উপকার করে।
আমার দেশের গানের পাখিরা কী সুন্দর গান গায়! কী চমৎকার শিস যে বাজায়। এ দলের কয়েকটি পাখি হচ্ছে—আমার দেশের জাতীয় পাখি দোয়েল, শ্যামা, ফটিকজল, ভ্যাদাটুনি বা বাংলাদেশের নাইটিঙ্গেল, ভরত, ময়না ও মৌটুসি। পাশাপাশি হাঁড়িচাচার কণ্ঠ কর্কশ। ভুতুমের ডাক যেন চারপাশে ভয় ছড়ায়। আবার চেঁচামেচিতে ওস্তাদ পাখিও আছে আমার দেশে। যেমন নীলকণ্ঠ ও হট্টিটি।
কিছু পাখি আছে যারা রাতের বেলায় চরে। এরা হচ্ছে নিশাচর পাখি। এ দলে পড়ে ভুতুম পেঁচার দল, নিশিবক ও দিনেকানা। ভুতুম পেঁচারা ফসলের ক্ষেতের ইঁদুর খেয়ে বড় উপকার করে। শুধু পেঁচারাই নয়, সব পাখিই কোনো না কোনোভাবে মানুষ তথা অন্যান্য প্রাণীর উপকার করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় রাখে অপরিসীম ভূমিকা।
আমার দেশের সবচেয়ে ছোট পাখি হচ্ছে ফুলঝুরি। টিকে থাকা সবচেয়ে বড় পাখি হচ্ছে মদনটাক। ওজনের দিক দিয়ে শকুনই চ্যাম্পিয়ন। মদনটাক আর শকুন কমে গেছে। তবে ঢাকার আকাশেও মাঝেমধ্যে শকুন দেখা যায়। সুন্দরবনে গেলে মদনটাক দেখা যেতে পারে। পাখি দেখার, পাখির বাসা খোঁজার বা পাখির ডিম-বাচ্চা দেখার নেশা যাদের আছে, আছে পাখির গান বা ডাক শোনার নেশা, তারা অভিজ্ঞদের সঙ্গে বিশেষ বিশেষ ঋতুতে আমার দেশের গ্রামীণ বন, সুন্দরবন, গারোপাহাড় এলাকা, সিলেটের টিলাময় বন ও বান্দরবান-খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটির পাহাড়ি বনসহ বিল-ঝিল, হাওর-বাঁওড়ে যেতে পারে। ঢাকা শহরে যারা থাকে, তারা রাজধানীবাসী পাখিদের দেখে সাধ মেটাতে পারে। মানুষের মতো বহু রকম পাখি রাজধানী ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা।
একটি পাখিকে দেখার মধ্যে যে আনন্দ আছে, তার চেয়ে বেশি আনন্দ ও উত্তেজনা আছে একটি পাখির মৌলিক আচার-আচরণগুলো দেখার মধ্যে। একটি পাখি কী পদ্ধতিতে বাসা বাঁধার জায়গা নির্বাচন করছে, কী কৌশলে নির্মাণ করছে বাসা, ডিম দিচ্ছে কয়টা, সে ডিম ফুটছে কতদিনে, কতদিন পরে বাচ্চারা উড়তে শিখছে—এ সব যদি স্বচক্ষে দেখা যায়, হিসাব-নিকাশ রাখা যায়, তাহলে একটা আবিষ্কারের আনন্দ অনুভব করা যায়। এই ঢাকা শহরে থেকেও দুই পাঁচটি পাখি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা কঠিন কোনো কাজ নয়। দরকার শুধু কিছুটা সময় আর অসীম ধৈর্য।
আমার দেশটা পাখির দেশ। সাজগোজ করে পাখি দেখতে না বেরুলেও ১০-২০ রকমের পাখি এমনিতেই নজরে পড়ে। এ রকম দেশে জন্মগ্রহণ করায় গর্বিত আমি। আমি ‘পাখির গানে ঘুম ভাঙ্গানো সকাল চাই, পাখির ডানার সূর্য ডোবা সন্ধ্যা চাই’।