মোর্স কোড বুঝতে পারে মৌমাছি, দাবি গবেষকদের

মৌমাছিরা স্পাই হিসেবে কাজ করতে পারেছবি: শাটারস্টোক ডটকম

গুপ্তচরবৃত্তির কথা ভাবলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে জেমস বন্ড, ইথান হান্ট কিংবা মাসুদ রানার মতো দুর্ধর্ষ সব স্পাইয়ের ছবি। কিন্তু যদি প্রাণীদের কথা বলি? তাহলে প্রথমেই আসবে পায়রার কথা। বিশ্বযুদ্ধের সময় গোপন চিঠি চালাচালি করতে এদের জুড়ি ছিল না। অনেকে হয়তো টিয়া পাখির কথা বলতে পারেন। কারণ, টিয়া পাখি আড়ি পেতে শুনে তা হুবহু বলে দিতে পারে।

কুকুরের বিশ্বস্ততা আর ঘ্রাণশক্তির কথাও আমরা জানি। ইঁদুররাও কিন্তু কম যায় না, ছোটখাটো জায়গায় ঢুকে খবর আনতে ওস্তাদ ওরা। কিন্তু বিজ্ঞান এবার এমন এক প্রার্থীর নাম প্রস্তাব করেছে, যা শুনলে আপনি হয়তো একটু অবাকই হবেন। এরা হলো আমাদের বাগানের অতি পরিচি মৌমাছি!

ভাবছেন, সারা দিন ভোঁ ভোঁ করা পোকাটা আবার স্পাই হবে কীভাবে? যুক্তরাজ্যের লন্ডনের কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক দাবি করছেন, মৌমাছিরা আলোর সংকেতের স্থায়িত্ব বুঝতে পারে। সহজ কথায়, ওরা একধরনের মোর্স কোড শিখতে সক্ষম!

মোর্স কোড ব্যাপারটা কী? অল্প শব্দ বা আলোর ঝলকানির সাহায্যে বার্তা পাঠানোই হলো মোর্স কোড। একটু বেশি সময় আলো আলো জ্বলা মানে ড্যাশ, আর কম সময় আলো জ্বলা মানে ডট। গবেষকেরা দেখতে চাইলেন, মৌমাছি কি এই দীর্ঘক্ষণ জ্বলা আলো আর দ্রুত জ্বলা আলোর পার্থক্য বুঝতে পারে? মানে মোর্স কোডের ড্যাশ ও ডট বুঝতে পারে কিনা।

আরও পড়ুন
অল্প শব্দ বা আলোর ঝলকানির সাহায্যে বার্তা পাঠানোই হলো মোর্স কোড। একটু বেশি সময় আলো আলো জ্বলা মানে ড্যাশ, আর কম সময় আলো জ্বলা মানে ডট।

যুক্তরাজ্যের লন্ডনের কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির পিএইচডি শিক্ষার্থী ও গবেষক অ্যালেক্স ডেভিডসন এবং তাঁর দল এই পরীক্ষার জন্য বেছে নিলেন এক সনাতন পদ্ধতি। মৌমাছিকে একটু ঘুষ দিলেন। মৌমাছির কাছে ঘুষ মানেই চিনি।

তাঁরা মৌমাছিদের একটি ছোট চেম্বারে ঢোকালেন। সেখানে দুটি লাইট বা আলোর বৃত্ত ছিল। একটা বৃত্তে আলো খুব দ্রুত জ্বলছে-নিভছে। অন্য বৃত্তে আলো জ্বলে থাকছে একটু বেশিক্ষণ।

মৌমাছিরা আলোর সংকেতের স্থায়িত্ব বুঝতে পারে
ছবি: শাটারস্টোক

মৌমাছিরা যখন দ্রুত জ্বলা আলোর কাছে যেত, তারা সেখানে পেত চিনির শরবত। আর যখন ধীরগতির আলোর কাছে যেত, সেখানে পেত কুইনাইন মেশানো তিতা পানি। এভাবে চলতে চলতে মৌমাছিরা একটা প্যাটার্ন বা সূত্র ধরে ফেলল। ওরা বুঝল, অল্প সময় জ্বলা আলো মানে চিনি, আর অনেকক্ষন জ্বলা আলো মানে তিতা। এটাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে অ্যাসোসিয়েটিভ লার্নিং বা কোনো কিছুর সঙ্গে ঘটনাকে মিলিয়ে শেখা।

ট্রেনিং তো হলো, এবার পরীক্ষার পালা। গবেষকেরা এবার চিনির শরবত আর তিতা পানি উভয়ই সরিয়ে নিলেন। শুধু সাধারণ পানি রাখলেন। কিন্তু লাইটের সেই ঝলকানি আগের মতোই রাখলেন।

গবেষকেরা দেখতে চেয়েছিলেন, এখন কি মৌমাছিরা ওই লাইটের সময়কাল দেখে সঠিক জায়গাটা চিনতে পারে কি না। নাকি খাবার নেই দেখে বিভ্রান্ত হয়ে যাবে?

আরও পড়ুন
মৌমাছিরা বুঝল, অল্প সময় জ্বলা আলো মানে চিনি, আর অনেকক্ষন জ্বলা আলো মানে তিতা। এটাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে অ্যাসোসিয়েটিভ লার্নিং বা কোনো কিছুর সঙ্গে ঘটনাকে মিলিয়ে শেখা।

ফলাফল দেখে বিজ্ঞানীরা অবাক! প্রায় ৮০ শতাংশ মৌমাছি নির্ভুলভাবে সেই ‘দ্রুত জ্বলা’ আলোর কাছেই গিয়ে বসল। অথচ সেখানে কোনো চিনির গন্ধ ছিল না। এর মানে হলো, তারা আলোর ঝলকানির স্থায়িত্ব মনে রাখতে পেরেছে এবং দুটোর মধ্যে পার্থক্য করতে পেরেছে।

এখন আপনি বলতে পারেন, এ আর এমন কী? আলো দেখে তো আমিও চিনতে পারি। কিন্তু আপনার সঙ্গে মৌমাছির তুলনা করা ঠিক হবে না। আমাদের মস্তিষ্কে প্রায় ৮৬ বিলিয়ন বা ৮ হাজার ৬০০ কোটি নিউরন আছে। আর একটা মৌমাছির মগজ হলো তিলের দানার সমান, যেখানে নিউরনের সংখ্যা ১০ লাখেরও কম।

এত ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক নিয়ে সময়ের হিসাব করাটা চাট্টিখানি কথা নয়। মেরুদণ্ডহীন প্রাণীদের মধ্যে এমন দক্ষতা আগে কখনোই দেখা যায়নি। গবেষক ডেভিডসন বলছেন, ‘প্রকৃতিতে মৌমাছিদের এমন আলোর ঝলকানি দেখার কোনো দরকার পড়ে না। তারপরও তারা যে এই কাজটা শিখতে পেরেছে, এটা সত্যিই বিস্ময়কর।’

মৌমাছিরা কেন এই ক্ষমতা পেল? ওরা কি একে অপরকে গোপনে মেসেজ পাঠায়? গবেষক এলিজাবেটা ভার্সেস মনে করেন, এটা হয়তো তাদের অন্য কোনো দক্ষতার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। মৌমাছিদের অনেক দূর উড়ে গিয়ে মধু সংগ্রহ করতে হয় এবং আবার পথ চিনে বাড়ি ফিরতে হয়। এই নেভিগেশন বা দিক চেনার জন্য হয়তো তাদের মস্তিষ্কে সময়ের হিসাব রাখার একটা ব্যবস্থা আগে থেকেই আছে।

আরও পড়ুন
গবেষক ডেভিডসন বলছেন, ‘প্রকৃতিতে মৌমাছিদের এমন আলোর ঝলকানি দেখার কোনো দরকার পড়ে না। তারপরও তারা যে এই কাজটা শিখতে পেরেছে, এটা সত্যিই বিস্ময়কর।’

অথবা হতে পারে, স্নায়ুতন্ত্র বা নার্ভাস সিস্টেমের এটা একটা মৌলিক ধর্ম। অর্থাৎ নিউরন থাকলেই হয়তো সে সময়ের দৈর্ঘ্য মাপতে পারে, তা সে যত ছোটই হোক না কেন।

এই গবেষণা শুধু জীববিজ্ঞানেই সীমাবদ্ধ নেই, এর প্রভাব পড়তে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের ওপর। বিজ্ঞানীরা ভাবছেন, যদি মাত্র ১০ লাখ নিউরন দিয়ে মৌমাছি এত জটিল কাজ করতে পারে, তবে আমরা কেন বিশাল বিশাল সুপারকম্পিউটার বানাচ্ছি?

একটা মৌমাছির মগজ হলো তিলের দানার সমান, যেখানে নিউরনের সংখ্যা ১০ লাখেরও কম!
ফাইল ছবি

মৌমাছির মস্তিষ্ক নকল করে হয়তো ভবিষ্যতে এমন ছোট ও সাশ্রয়ী এআই তৈরি করা সম্ভব হবে, যা কম শক্তিতেই বড় বড় সমস্যার সমাধান করবে। একে বলা হয় নিউরাল সাবস্ট্রেট বা কম রিসোর্স ব্যবহার করে জটিল কাজ করা।

সম্প্রতি এই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে বায়োলজি লেটার্স জার্নালে।

লেখক: সহকারী শিক্ষক, গণিত বিভাগ, পদ্মা ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, শরীয়তপুর

সূত্র: আইএফএল সায়েন্স

আরও পড়ুন