বাটির মতো ছোট্ট বাসা
কিছু পাখি খুব পরিপাটি ও সুন্দর বাসা বানায়। অনেক ছোট পাখিও আছে এই দলে। ফিঙে, হলদে পাখি, মুনিয়া, বাংলা, সিপাহী ও শাহ বুলবুল পাখিদের বাসা গোলগাল, ছোট্ট বাটির মতো।
বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর পাখিদের মধ্যে একটা শাহ বুলবুল। পুরুষ শাহ বুলবুলের লেজ অনেক বড়। ছোট্ট চড়ুইয়ের সমান পাখিটা। কিন্তু লেজে দৈর্ঘ্য প্রায় দেড় ফুটের মতো। এই পাখি দুই রঙের হয়। একটা পাটকিলে লাল, আরেকটা সাদা। পাটকিলে লাল রঙের পাখিটা কয়েক বছর পর সম্পূর্ণ সাদা রঙের হয়ে যায়। এই পাখিরা গাছের একেবারে নিচের দিকের ডালে বাসা বানায়। এদের পছন্দের গাছ হলো বাঁশ। এছাড়া আম ও কাঁঠাল গাছের নিচু ডালেও বাসা বাঁধে এরা। বাঁশের পাতা, তুলা ও শুকনা আম-কাঁঠালের পাতা দিয়ে বানায় বাসা। নিজেদের লালা ও মাকড়সার জাল ব্যবহার করে বাসা বুনতে।
মাকড়সার জাল অত্যন্ত শক্ত ও আঠালো। তাই অনেক পাখিই বাসা তৈরিতে মাকড়সা জাল ব্যবহার করে। শাহ বুলবুলের মতো ফিঙে আর হলদে পাখির বাসাও দেখতে একই রকম। পাখি ছোট বলেই যে শুধু এমন বাসা বানায়, তা নয়। ছোট বাসায় তা দিতেও সুবিধা হয়। ছানারা খুব ছোট বলে দিব্যি বাটির মতো বাসা তৈরি করে বাস করতে পারে।
অন্যদিকে বাংলা ও সিপাহী বুলবুলের বাসাও বাটির মতো। তবে এরা তুলা বা পাতা ব্যবহার করে না। শুকনো খড় পেঁচিয়ে বাটির মতো করে নেয়। গৃহস্তবাড়ির আশপাশেই এরা বাসা বাঁধে। ডালিম, কুল, পাতাবাহার বা গোলাপ গাছ এদের বাসা বাঁধার জন্য বেশ পছন্দের। এমনকি বারান্দার টবের ভেতরও বাসা বাঁধে এসব পাখি।
বড় গোল বাসা
বড় কুবো বা কানাকুয়া পাখি বেশ বড়সড় বাসা বানায়। এদের বাসাটা দেখতে অনেকটা ফুটবলের মতো। বাসার ওপর দিকটা খোলা। ফুটবলে কোনো অংশ থেকে যদি সামান্য একটু কেটে নেওয়া হয়, সেটা যেমন দেখাবে, কানাকুয়ার বাসাটা তেমন। সেটা শুধু ভেতরের দিকেই। বাইরে থেকে দেখলে অতটা গোছালো মনে হয় না। মনে হয়, একরাশ বাঁশ বা তালের শুকনো পাতা কেটে গাছের মাথায় জড়ো করে রেখেছে কেউ। কিন্তু ভেতরটা বেশ গোলগাল ও মসৃণ। দেখতে অনেকটা ছোট ধামার মতো। বড় ফুটবলের মতো আরও বাসা বানায় পাকড়া ও গাং শালিক। তবে এদের বাসাও অত গোছালো নয়।
কোটরে বাসা
সব পাখি খোলামেলা বাসায় বানায় না। কিছু পাখি ডিম পাড়ার জন্য বেছে নেয় গাছের কোটর। খুঁড়লে প্যাঁচা, টিয়া, বসন্তুবৌরি, ধনেশ, নীলকণ্ঠ, কাঠঠোকরা, দোয়েল—এরা গাছের কোটরে বাসা বানায়। শালিকের বেশিরভাগ প্রজাতিই কোটরে বানায় বাসা। প্রশ্ন হতে পারে, গাছে গভীর সব কোটর তৈরি হয় কীভাবে? বেশিরভাগ পাখিরই ঠোঁটে অত জোর নেই যে গাছে গভীর গর্ত করবে। কিন্তু কাঠঠোকরাদের আছে। গাছের বাকলের ভেতর এমনকি কাঠের ভেতরও অনেক পোকা বাস করে। সেসব পোকা খাওয়ার লোভে কাঠঠোকরার দল গাছের বাকল ও কাঠ ঠুকরে গর্ত করে ফেলে। এসব গর্তেই পরে অন্যপাখিরা বাসা বাঁধে।
কাঠঠোকরা নিজেরাও গাছের কোটরে বাসা তৈরি করে। সে জন্য কাঠ ঠুকরে ঠুকরে অনেক গভীর কোটর বানায়। সেসব কোটরে নিজেরা বাসা বাঁধে। ছানাপোনা বড় হয়ে যাওয়ার পর কাঠঠোকরা সেই বাসা ছেড়ে দেয়। সেসব বাসায় তখন পাখিরা এসে বাসা বাঁধে।
বট, অশ্বত্থ কিংবা বড় কড়ই গাছের পুরোনো বাকল পচে যায়। সেসব বাকলের ভেতর বাসা বাঁধে বিশাল সব ঘুনপোকা। বিটল বা গুবরে পোকাদের এই প্রজাতি কাঠ খেতে বড় ভালোবাসে। এদের লার্ভারা কুরে কুরে কাঠ খায়। ফলে গাছের ভেতর বড় সুড়ঙ্গ তৈরি হয়। সেসব সুড়ঙ্গ দখল করে পাখিরা বাসা বাঁধে।
মাটির গর্তে বাসা
পুকুর বা জলাশয়ের ধারে কয়েক ধরনের মাছরাঙা দেখা যায়। সব ধরনের মাছরাঙা মাটি খুড়ে গর্তে বাস করে। তবে সমতল মাটিতে এরা বাসা করে না। পুকুর, খাল কিংবা নদীর খাড়া পাড়ে বিশাল ঠোঁট আর পা দিয়ে গর্ত করে এরা বাসা বানায়। গর্তও হয় খুব গভীর। সাধারণত কোনো কিশোর ছেলে সম্পূর্ণ হাত ঢুকিয়েও বাসার নাগাল পায় না। খাড়া পাড় বেয়ে সাপ উঠতে পারে না। তাই নিরাপত্তার স্বার্থেই এরা এমন বাসা বানায়।
মাটির গর্তে বাস করে সুঁইচোরা বা বাঁশপাতি পাখিরাও। মাছরাঙাদের মতো অত শক্ত ও বড় ঠোঁট না থাকলে পা আর ঠোঁটের যৌথ ব্যবহারে এরা বাসা বানাতে পারে। তাছাড়া এরা বেলেমাটির গর্তের বাসা বানায় বলে কাজটা সহজ হয়। বেলে মাটি ঝুরঝুরে, তাই সহজেই বাসা বানাতে পারে।
মাটিতে বাসা
অনেক পাখি মাটিতেই বাসা বাঁধে। বাংলাদেশের যে সব দেশি মুরগি আছে, এদের খুব নিকট আত্মীয় বনমোরগ। বনমুরগি মাটিতে বাসা করে একটু ঝোপের আড়ালে। লতাপাতা গুছিয়ে তার ওপর ডিম পাড়ে। কিন্তু তিতির নামে মুরগির একটা জাত ভাই আছে। এরা বাসা বানানোর জন্য আলাদা করে তেমন কিছুই করে না। ইচ্ছামতো কোনো জায়গায় বাসা বাঁধে। মানুষ বা অন্য প্রাণীদের পায়ের তলায় পড়ে এদের ডিম সহজেই নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু সেসবের তোয়াক্কা এরা করে বলে মনে হয় না।
বটের ও ভারুই জাতীয় পাখিরাও বাসা বাঁধে মাটিতে, ঘাস-লতাপাতার ভেতরে। রাতচরা পাখিরাও মাটিতে বাসা বাঁধে। কিছু জলজ পাখিও জলার ধারে মাটিতে বাসা বানায়।
পানিতে বাসা
জলচর পাখিদের বেশিরভাগই পানিতে বাসা করে। ডাহুক এদেশের খুব পরিচিত জলচর পাখি। এই পাখি বাসা বানায় একেবারে জলার ধারে। ঘন ঝোপ ও লতাপাতার ভেতরে। কিছু খড়কুটো জোগাড় করে বাসা করে ফেলে। এদের বাসা বেশ সাজানো গোছানো এবং তরকারি বাটির মতো ছড়ানো।
পানকৌড়ি পাখিদের পানির আশপাশ ছাড়া অন্য জায়গায় পাওয়া মুশকিল। পুকুর বা জলাশয়ে অর্ধেক ডুবে থাকা খুঁটিতে বসে এদের রোদ পোহাতে দেখা যায় মাঝেমধ্যে। বাকিটা সময় পানিতে ডুবসাঁতার দিয়ে মাছ ধরে। এদের বাসাও তাই পানির ওপরেই হয়। পানির ওপরে ভেসে থাকা কচুরিপানা, শাপলা বা পদ্মপাতার ওপর এরা বাসা বাঁধে। জলজ লতাপাতা এদের বাসার প্রধান উপকরণ। নিতান্তই যদি পানিতে বাসা বাধার মতো পরিস্থিতি না থাকে, তাহলে পানির কাছে গাছে বাসা বাঁধে।
জলপিপিরা বাসা বাঁধে পদ্ম বা শাপলাপতার ঘন জঞ্জালে, গোলা, কলমি বা কচুরিপানার ফাঁকফোকরে। মাঝেমধ্যে পদ্মফুলের ভেতরেও এদের বাসা করে ডিম পাড়তে দেখা যায়।
চালে বাসা
খড়ের ঘরের চালে কিংবা খড়ের গাদায় বাসা বাঁধতে দেখা যায় কিছু পাখিকে। এ কাজে ওস্তাদ হলো তিলা মুনিয়া। এরা চালের ভেতরে মাথা গুঁজে দিয়ে ভেতরটা বেশ খোড়লের মতো করে নেয়। বাড়ির আশেপাশে ঢিবি করে রাখা খড়ের গাঁদার ভেতরও তিলা মুনিয়াদের বাসা করতে দেখা যায়। চালের বাতা কিংবা খড়ের ভেতর বাসা করে চড়ুই পাখিরা। এমনকি পাকা ঘরের ভেন্টিলেটরের ভেতরও দিব্যি বাসা করে চড়ুইয়ের দল।