সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২০২৪ সালে প্রত্যাশার চেয়ে দ্রুত বাড়ল কেন

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২০২৪ সালে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি বেড়েছেছবি: রয়টার্স

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২০২৪ সালে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি বেড়েছে। বিজ্ঞানীদের অনুমানের তুলনায় উচ্চতা বৃদ্ধির হার এই বছরে বেশি ছিল। আগের বছরগুলোতে বরফ গলার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। ২০২৪ সালে ঘটনা বদলে গেছে। এ বছর পানির উচ্চতা বাড়ার জন্য শুধু বরফ গলা দায়ী নয়। এবার মূলত তাপীয় সম্প্রসারণের কারণে পানির উচ্চতা বেড়েছে। নাসার স্যাটেলাইট রেকর্ড থেকে দেখা গেছে, ১৯৯৩ সাল থেকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমাগত বাড়ছে। এই উচ্চতা বাড়ার পেছনে ভূমিকা রেখেছে বাতাসের গতি এবং এল নিনোর মতো মহাসাগরের স্রোতের ঘটনা।

২০২৪ সালে বৈশ্বিক সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রত্যাশার চেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। এর প্রধান কারণ উষ্ণ পানির সম্প্রসারণ। নাসার নেতৃত্বে পরিচালিত একটি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত বছর সমুদ্রের উচ্চতা ০.২৩ ইঞ্চি (০.৫৯ সেন্টিমিটার) বেড়েছে, যা বার্ষিক পূর্বাভাসের হারের চেয়ে ০.১৭ ইঞ্চি (০.৪৩ সেন্টিমিটার) বেশি।

নাসার জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরির সমুদ্রস্তর গবেষক জোশ উইলিস বলেছেন, ‘২০২৪ সালে আমরা যে পরিমাণ বৃদ্ধি দেখেছি, তা প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। প্রতি বছর পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। তবে এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, সমুদ্রের উচ্চতা ক্রমাগত বাড়ছে এবং এই বৃদ্ধির হার দ্রুততর হচ্ছে।’

আরও পড়ুন
এই দীর্ঘমেয়াদী পর্যবেক্ষণ সম্ভব হয়েছে ১৯৯২ সালে চালু হওয়া টিওপিইএক্স/পসাইডন (TOPEX/Poseidon) স্যাটেলাইটগুলোর কারণে। এগুলো সব সময় মহাসাগর পর্যবেক্ষণ করে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এসেছে গলে যাওয়া হিমবাহ এবং জমাট বরফ থেকে। আর এক-তৃতীয়াংশ উষ্ণ পানির সম্প্রসারণের কারণে। ২০২৪ সালে এই চিত্র উল্টে গেছে। এ বছর উষ্ণ পানির প্রসারণ সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির দুই-তৃতীয়াংশের জন্য দায়ী।

নাসার সদর দপ্তরের ভৌত সমুদ্রবিদ্যা কর্মসূচি এবং সংযুক্ত পৃথিবীব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ বিভাগের প্রধান নাদিয়া ভিনোগ্রাদোভা শিফার বলেছেন, ‘২০২৪ ছিল রেকর্ড করা ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণ বছর। উষ্ণ সমুদ্রপৃষ্ঠও এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে। এটি গত তিন দশকে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে।’

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দিন দিন বেড়েই চলেছে
ছবি: এএফপি

১৯৯৩ সালে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সমুদ্রের উচ্চতা পরিমাপ শুরুর পর থেকে বার্ষিক বৃদ্ধির হার দ্বিগুণ হয়েছে। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত বৈশ্বিক সমুদ্রস্তর ৪ ইঞ্চি (১০ সেন্টিমিটার) বেড়েছে।

এই দীর্ঘমেয়াদী পর্যবেক্ষণ সম্ভব হয়েছে ১৯৯২ সালে চালু হওয়া টিওপিইএক্স/পসাইডন (TOPEX/Poseidon) স্যাটেলাইটগুলোর কারণে। এগুলো সব সময় মহাসাগর পর্যবেক্ষণ করে। বর্তমানে এই ধারার স্যাটেলাইটগুলোর মধ্যে রয়েছে ২০২০ সালে উৎক্ষেপিত সেন্টিনেল-৬ মাইকেল ফ্রাইলিক (Sentinel-6 Michael Freilich)। এটি এই স্যাটেলাইটটির টুইন স্যাটেলাইট—অর্থাৎ একরকম এবং যুগ্মভাবে কাজ করবে, এমন স্যাটেলাইট—সেন্টিনেল-৬বি-এর (Sentinel-6B) সঙ্গে যুক্ত হবে, যা আগামী দশকেও ৯০ শতাংশ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা কয়েক সেন্টিমিটার পর্যন্ত নির্ভুলভাবে পরিমাপ করতে পারবে।

সমুদ্রের পানিতে বিভিন্ন উপায়ে তাপ প্রবেশ করে। পানিতে তাপ মেশার ফলে পানির তাপীয় সম্প্রসারণ হয়। অর্থাৎ তাপের কারণে পানির অণুগুলো পরস্পর থেকে দূরে সরে যায়। ফলে পানি ফুলে-ফেঁপে ওঠে। সাধারণত সমুদ্রের পানি তাপমাত্রা ও ঘনত্ব অনুযায়ী বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত থাকে। উষ্ণ পানি হালকা হওয়ায় ওপরের স্তরে থাকে আর ঠান্ডা পানি তুলনামূলক বেশি ঘন হওয়ায় নেমে যায় নিচে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পৃষ্ঠের তাপ খুব ধীরে ধীরে এই স্তরগুলো পেরিয়ে গভীর সমুদ্রে পৌঁছায়।

আরও পড়ুন
এল নিনোর প্রভাবেও প্রচুর পানির সঞ্চালন ঘটে। সাধারণত পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে থাকা উষ্ণ পানির বড় অংশ কেন্দ্রীয় ও পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে সরতে থাকে।
সমুদ্রের তাপমাত্রা যেমন বেড়েছে, তেমই বেড়েছে সুমদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা
ছবি: রয়টার্স

তবে সমুদ্রের কিছু অঞ্চলে প্রবল বাতাস প্রচণ্ড ঢেউ সৃষ্টি করে। এতে পানির স্তরগুলোর মিশ্রণ উল্লম্বভাবে হতে পারে। বিশাল সামুদ্রিক স্রোত পানির স্তর পরিবর্তন করতে পারে। অর্থাৎ এক স্তরের পানি অন্য স্তরের সঙ্গে মিশে যেতে পারে এবং এভাবে চক্রাকারে বিষয়টি চলতে থাকে। যেমন দক্ষিণ মহাসাগরে এমন বাতাস পাওয়া যায়। ফলে পৃষ্ঠের গরম পানি সহজেই গভীরে প্রবেশ করে।

এল নিনোর প্রভাবেও প্রচুর পানির সঞ্চালন ঘটে। সাধারণত পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে থাকা উষ্ণ পানির বড় অংশ কেন্দ্রীয় ও পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে সরতে থাকে। এই পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের ভেতরে তাপের উল্লম্ব সঞ্চালন আরও বৃদ্ধি পায়। তাপীয় সম্প্রসারণের এই প্রবণতা আগামী বছরগুলোতে কেমন হবে, তা-ই এখন ভাবনার বিষয়।

সূত্র: সাইটেক ডেইলি

লেখক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, কিশোর আলো

আরও পড়ুন