প্রাণিজগৎ
ধুলোচাটা পাখিদের জগতে
এ দেশে কত রকম, কত ধরনের পাখি। রং-বেরঙের এসব পাখি নিয়ে লিখেছেন পাখিবিশারদ ও প্রকৃতিবিদ শরীফ খান…
জ্যৈষ্ঠ মাসের ঝিমধরা দুপুরবেলায় চষাক্ষেতের ভেতর খেলায় মেতেছে ছটি পাখি। ধুলোয় মাখামাখি শরীর।
বড় বড় ঢিলের মাঝে ধুলোয় বসে ওরা ডানা ঝাপটে পরস্পরকে ধুলোস্নান করাচ্ছে। দুই পা দিয়ে ধুলো আঁচড়াচ্ছে। ধুলোয় বুক-পেট মিশিয়ে ডানা ঝাপটাচ্ছে। ধুলোয় আচ্ছন্ন পাখি ছটির শরীর। ‘কিচ কিচ’ চাপাস্বরে কর্তাবার্তাও চালাচ্ছে সমানে। রোদ্দুরের গরম ধুলোয় স্নান করছে, একটাই উদ্দেশ্য—চামড়ার অতিক্ষুদ্র পরজীবী কীট তাড়ানো। ধুলোকণা লেগে কীটগুলোর শ্বাসবন্ধ অবস্থা। ধুলোকণার ওপরে উঠলে পাখিটা দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড শরীর ঝাঁকুনি দিলে ধুলোকণার সঙ্গে কীটগুলোও ছিটকে পড়ে। বাংলাদেশের বহু পাখি, বিশেষত চড়ুইরা এভাবেই পরজীবী কীট তাড়ায় শরীর থেকে। এই ছটি পাখিও দেখতে যেমন চড়ুইয়ের মতো, আকারেও তেমনি।
আনুমানিক ৩০ মিটার দক্ষিণের শিমুলগাছ থেকে উড়ল একটি খোপা-ঈগল, আসছে এদিকেই। ওর ডানার ছায়া দেখে স্থির হয়ে গেল ধুলোয় বসা পাখি ছটি। নজরে পড়লে ছোঁ মেরে বসলে ঘটে যাবে মহাবিপদ। ঈগলটি অবশ্য ডানার ছায়া ঢেলে মাঠ পেরিয়ে চলে গেল সোজা উত্তরদিকে। একটু বাদেই শিমুলের ফাটা ফল থেকে লাফিয়ে বেরোল ৫টি তুলোবীজ। চমৎকার সাদা তুলোর বীজগুলো যেন বাতাসে সাঁতার কাটতে কাটতে নেমে আসছে মাঠের দিকে। কী যে হলো এ সময় পাখিদের! আনন্দের ডাক ছেড়ে উড়ল ঝট করে, এগিয়ে গিয়ে উড়ন্ত তুলোবীজ ঠোঁটে ধরতে চাইল। কিন্তু ওদের ডানার বাতাসে হোক বা এমনি বাতাসেই হোক, তুলো ফুলগুলো ছিটকে ছিটকে সরে যেতে লাগল। পাখিগুলো চেষ্টা তবু করেই যাচ্ছে। এ সময়ে এক ঝলক হাওয়া খেলে গেল শিমুলগাছটির মাথায়, আরও ৭/৮টি তুলোবীজ খসে পড়ে বাতাসে ঘুরপাক খেতে খেতে আসছে পাখিগুলোর দিকে। ওরা এবার মরিয়া হয়ে ধরতে চাইছে তুলোফুল, কিন্তু ধরতে পারছে না। উড়ন্ত তুলোবীজ নিয়ে যেন পাখিগুলো মেতেছে চোখজুড়ানো-মনভরানো এক আশ্চর্য খেলায়।
পুরুষ ধুলোচাটার চোখ-কানের নিচের অংশ সাদা রঙে ভরা, বুক-পেটের ওপরে ডানার নিচের অংশও সাদা। গলা-বুক-পেট ও লেজের তলার রং কুচকুচে কালো। চোখের পাশটা যেমন কালো, তেমনি চোখের ওপর দিয়ে কালো একটা টান নেমে চলে গেছে ঘাড়ের দিকে, আবার আংটির মতো পাক খেয়ে কালো একটা টান এসে মিশেছে গলার কালোর সঙ্গে
একটি ফুলও ধরতে পারল না শূন্যে। ধরল অনেকটা দূরে গিয়ে মাটিতে পড়ার পর। তিনটি মেয়ে-পাখি ঠোঁটে তুলোফুল নিয়ে উড়ে এল আবার আগের ধুলোস্নানের জায়গায়। এই চষাক্ষেতটির ভেতরেই কিছুটা দূরে দূরে বাসা করছে ওরা। বাসার উপকরণ হিসেবেই তুলোর দরকার ওদের। পুরুষরা বাসার উপকরণ আনে না, বাসাও বাঁধে না। তবু ওরা কেন যে মেয়েপাখিদের পাশে পাশে উড়ে তুলোবীজ ধরার কসরত করছিল!
মাঠের এই পাখির অনেকগুলো নাম ধুলোচাটা, বালুচাটা, ধুলোচড়ুই। বাগেরহাটে মেঠোচড়ুই। ইংরেজি নাম Ashy-Crowned Sparrow Lark। ইংরেজি নাম থেকেই বোঝা যায়, দেখতে এরা চড়ুই বা ভরত পাখির মতো। স্বভাবেও তাই। বৈজ্ঞানিক নাম Eremopterix grisea। শরীরের মাপ ১২ থেকে ১৪ সেন্টিমিটার। মেয়ে-পাখিটা আকারে একটু ছোট।
পুরুষ ধুলোচাটার চোখ-কানের নিচের অংশ সাদা রঙে ভরা, বুক-পেটের ওপরে ডানার নিচের অংশও সাদা। গলা-বুক-পেট ও লেজের তলার রং কুচকুচে কালো। চোখের পাশটা যেমন কালো, তেমনি চোখের ওপর দিয়ে কালো একটা টান নেমে চলে গেছে ঘাড়ের দিকে, আবার আংটির মতো পাক খেয়ে কালো একটা টান এসে মিশেছে গলার কালোর সঙ্গে। মাথার চাঁদি ও পিঠের রং বালু ও ছাইরঙের মিশ্রণ, তাতে বাদামির আভা। ডানার ওপরে ও প্রান্তে পাটকিলে বাদামি ছোপ ও টান আছে।
মেয়ে-পাখির চাঁদি, পিঠ ও ডানার রং পুরুষটির মতোই। গলা-বুক-পেট হালকা বাদামি। মেয়ে-পাখির শরীরে সাদা বা কালোর চিহ্নমাত্র নেই। চিবুক লালচে বাদামি। উভয়ের ঠোঁটের রং গোলাপি, তাতে অতি সামান্য নীলচের আভা। পা নীলচে-আভা মেশানো পাটকিলে বাদামি। চোখের রং উজ্জ্বল পিঙ্গল।
শরৎ-হেমন্তে যখন উইপোকা বা ডানাওয়ালা পিঁপড়েরা দলবেঁধে মাটি থেকে আকাশে উড়তে থাকে, তখন নানা ধরনের পোকাখেকো পাখির সঙ্গে সুযোগ পেলে ধুলোচাটারাও উইপোকা ধরে। আবার নাড়াবনে আগুন দিলে বা ধানক্ষেতে বা ধানের গোলায় আগুন লাগলে, ধান পুড়ে খই ছিটালে ছুটে আসে বহু পাখি খই খেতে। তাতে ধুলোচাটারাও বাদ পড়ে না। তবে ফিঙে, বুলবুল বা দোয়েলের মতো দক্ষ নয় ওরা। এ ছাড়াও ধুলোচাটার খাদ্যতালিকায় আছে কচি ঘাসের ডগা ও বীজ, ধান, ডাল, গম, কাউন, চিনাদানা, সর্ষে, কেঁচো ও ফড়িংসহ নানান রকম পোকামাকড়।
শীত ও বর্ষাকাল বাদে ধুলোচাটারা বছরের যেকোনো ঋতুতে বাসা বাঁধতে পারে। বাসা বাঁধে খোলা মাঠে, গর্তমতন জায়গা পছন্দ। মাঠের ঝোপঝাড়, উলুঘাসের বন বা অন্যান্য মেঠোউদ্ভিদ এড়িয়েই বাসা করে। আমি বহুবার এদের বাসা দেখেছি, ডিম-বাচ্চা দেখেছি। এরা যেমন ধুলো-মাটির সঙ্গে মিলেমিশে গা ঢাকা দিতে জানে, তেমনি এদের বাসা-ডিমও খোলা মাঠে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে গরু-ছাগল বা মানুষের পায়ের তলায় ডিম-বাচ্চা নষ্ট হয় অনেক সময়। সাপ, বেজি, গুইসাপ, বনবিড়াল, খেঁকশিয়াল বা শিকারি পাখিদের কবলেও পড়ে কখনো কখনো। বাসা বাঁধার সময় বালুচাটারা মাঠের পাখি নীলকণ্ঠ ও হট্টিটির সাহায্য যাতে পাওয়া যায়, সেদিকে খেয়াল রাখে। উল্লিখিত পাখি দুটি চেঁচামেচিতে যেমন পক্ষীকুলের ভেতর সেরা, তেমনি সাহস আর বুদ্ধিতেও বেশ। দুটি পাখিই শত্রুকে ডাইভ মেরে ভড়কে দিতে পারে।
বাসা বাঁধার আগে পুরুষ বালুচাটা আনন্দে উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে সুন্দর গান গায়! ভরতের মতো গান গাইতে গাইতে খাড়া উঠতে থাকে শূন্যে, ১০০-১৫০ ফুট পর্যন্ত ঝিরঝির করে ডানা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে, তারপর নেমে আসে সোজা। বড় চমৎকার দৃশ্য! দুজনে মিলে বাসা বাঁধার জায়গা নির্বাচনে লাগায় ২-৪ দিন। বাসা শেষ করতে সময় নেয় ৩-৫ দিন। বাসার মূল উপকরণ হচ্ছে গরুর লেজের চুল, মেঠো মাকড়সার জাল, সুতোর মতো সরু ঘাস, পাটের আঁশ, অন্য পাখির ফুল-পালক, নরম উদ্ভিদের অংশ। ঠোঁট দিয়ে ঠেলে বা টেনে আনে শোলার টুকরো, মরা শামুকের খোল, গাছের শুকনো ডাল বা ঢিলের টুকরো। এগুলো বাসার পাশে রাখে দেয়ালের মতো—বাসাটি আড়াল করার জন্য।
প্রায় সময়ে ডিম পাড়ে ২টি, কখনো ৩টি। ডিমের রং সবুজ, তাতে হলদেটে আভা থাকে, সেই সঙ্গে সাদার মিশেল। ডিমে মেটে-ধূসর অসংখ্য ছিটছোপ থাকে। চড়ুইয়ের ডিমের আকারেরই ডিম, তবে গোল ভাবটা বেশি। আমি বেশ কবার চড়ুই ও ভরতের ডিমের সঙ্গে এদের ডিম বদলে দিয়েছি। তা দিয়েছে সবাই, কিন্তু বাচ্চা ফোটেনি।
বালুচাটারা পালা করে ডিমে তা দেয়। বাচ্চা ফোটে ১১-১৩ দিনে। উড়তে শেখে ওই ১১-১৩ দিনেই। তবে তার আগেই বাচ্চারা মা-বাবার পেছনে পেছনে হেঁটে বেড়ায়, বাবা-মার মুখ থেকে খাবার খায়। উড়তে শেখার মাসখানেক পরেই বাচ্চারা স্বাবলম্বী হয়ে যায়। বাচ্চারা ভীষণ দুষ্টু, কিন্তু মা-বাবা বা অন্য কারো হুঁশিয়ারি পেলেই সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে বুক-পেট ঠেকিয়ে অনড় হয়ে যায়। হট্টিটিরা যেমন উড়ে উড়ে মাটিতে থাকা ছানাদের নানান রকম নির্দেশনা দেয়, তেমনি ধুলোচাটারাও বাচ্চার আশপাশে শত্রু দেখলে উড়ে উড়ে নির্দেশনা দেয়, চালিত করে। এ এক রহস্যময় ব্যাপার। বাবা-মা বলছে, চুপচাপ থাক, পশ্চিম দিকে বা উত্তর দিকে, যা ওড়ার ভঙ্গিতেও থাকে নির্দেশনা।
বালুচাটা বাংলাদেশের সব এলাকাতেই আছে। ধুলোময় খোলামাঠ আর বালুময় নদীর ঘাট বা চর এদের প্রিয় জায়গা। ভালোই আছে। খাদ্যাভাব নেই, নেই বাসা বাঁধার জায়গার অভাব। মাঠের পাখি ভরত, পিপিট, হট্টিটি, রিং-প্লোভার, মেঠো-ছাতারে, নীলকণ্ঠ ও ধানটুনির সঙ্গে আছে চমৎকার সমঝোতা। তবে কোয়েলকে (কোকিল নয়) তেমন পছন্দ করে না। মাঠে আসা চড়ুইদের পছন্দ করে খুব। বাবুইদের আবার একেবারেই সহ্য করতে পারে না। হুপোপাখি মাঠে নামলে ধুলোচাটারা পিছু নেয়। হুপোর ঠোঁটের খোঁচায় পোকামাকড় উড়লেই ধরে খায়। হুপোরা অবশ্য তাতে কিছু মনে করে না। অকালবর্ষণে বাসা নষ্ট হলে বড় কষ্ট পায়। শিলা পড়লে বাসায় বসে ডিম-বাচ্চা আগলে রাখে। বৃষ্টিতে ভেজার পরে বৃষ্টি কমলে এরা উড়ে উড়ে ডানা শুকায়, আবার রংধনু উঠলে মনের আনন্দে গলা ছেড়ে গান গায়। ‘টিরি টিরি...রি...রি... ঝিঝি... ছিটি ছিটি...।’ বৃষ্টিস্নানও করে। কখনো কখনো মাটিতে পড়া শিলাও খায়। শীতের প্রচণ্ড কুয়াশার দিনে এরা চুপচাপ বসে থেকে দুঃখের গান গায়।
বালুচাটা বা ধুলোচাটাদের খুব কাছাকাছি যাওয়া যায় বটে, কিন্তু ঝাঁকিজাল দিয়ে এদের ধরা যায় না। জাল মাটিতে পড়ার আগেই ফুডুৎ। শীতে এদের রৌদ্রস্নানের দৃশ্য বড়ই চোখজুড়ানো।