২০০৫ সালের কথা। মার্কিন কম্পিউটারবিজ্ঞানী ও লেখক রে কার্জওয়েল একটি বই লেখেন, দ্য সিঙ্গুলারিটি ইজ নিয়ার। বইটি প্রযুক্তিবিশ্বে আলোড়ন তোলে। অনেকেই বইটির প্রশংসা করেন, কিন্তু সমালোচনারও কমতি ছিল না। সেই বইয়েই কার্জওয়েল প্রথম দাবি করেন, ২০৪৫ সালের মধ্যে মানুষ ও যন্ত্রের বুদ্ধিমত্তা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। এর পেছনের কারণ হিসেবে তিনি দাবি করেন, যন্ত্রের বুদ্ধিমত্তা তখন ছাপিয়ে যাবে মানুষকে। নিজেই নিজের কোড লিখতে পারবে, উন্নত করতে পারবে নিজেকে। তিনি এই পরিস্থিতির নাম দিয়েছিলেন সিঙ্গুলারিটি।
শব্দটা কি পরিচিত লাগছে? হ্যাঁ, পদার্থবিদ্যা বা মহাকাশবিজ্ঞানে সিঙ্গুলারিটি শব্দটি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এই সিঙ্গুলারিটি বা অনন্যতা অর্থ কৃষ্ণগহ্বরের পরম বিন্দু বা গণিতের অসীমতা নয়। এর অর্থ, এই সেই মুহূর্ত বা সময়, যে ধাপে জীব ও প্রযুক্তি বা যন্ত্রের আর পার্থক্য থাকে না। ফলে যা পাওয়া যায়, তার স্বরূপ আমরা আর সেই অর্থে নির্ধারণ করতে পারি না। কার্জওয়েলের দাবি, এই সিঙ্গুলারিটির কেন্দ্রে থাকবে বৈপ্লবিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। ইংরেজিতে বলা হয়, আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্স বা এজিআই।
প্রায় ২০ বছর পরে এসে কার্জওয়েল ফের লিখেছেন দ্য সিঙ্গুলারিটি ইজ নিয়ারার। এতে তাঁর আরও আত্মবিশ্বাসী রূপ দেখা গেছে। আরও আশাবাদী তিনি তথ্য-উপাত্ত-গ্রাফ দিয়ে দেখিয়েছেন, তাঁর অনুমিত পথেই এগোচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
এই লেখায় আমরা দ্য সিঙ্গুলারিটি ইজ নিয়ারার নিয়ে আলাপ করব বটে, সেই সঙ্গে আগের বইটি নিয়েও খানিকটা আলোচনা করব। এতে বোঝা যাবে, গত ২০ বছরে প্রযুক্তিবিদদের চিন্তায় কতটা পরিবর্তন এসেছে এবং তুলনামূলকভাবে ‘সিঙ্গুলারিটি’র চিন্তা আসলেই কতটা বাস্তব বা অবাস্তব।
দ্য সিঙ্গুলারিটি ইজ নিয়ার
প্রথমে তাঁর ২০০৫ সালের বইটির কথা বলি। এই বইয়ে কার্জওয়েল দেখিয়েছেন, চেতনার উন্নয়নের পুরো ইতিহাসকে ছয় ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছে, পদার্থবিদ্যার মৌলিক (প্রাকৃতিক) বিষয়গুলো গড়ে উঠেছে প্রকৃতিতে, পাশাপাশি গড়ে উঠেছে রসায়নের মৌলিক বিষয়গুলো। অর্থাৎ মহাবিশ্বের সূচনা থেকে বিভিন্ন পদার্থের সৃষ্টি, পৃথিবীর সূচনা—এসবই প্রথম ভাগ বা ধাপ। দ্বিতীয় ধাপটা হলো প্রাণের সূচনা। কিন্তু সব প্রাণের মস্তিষ্ক নেই। তাই প্রাণের ভেতরে মস্তিষ্কের সূচনা হলো তৃতীয় ধাপ। চতুর্থ ধাপে প্রাণ বা জীব তার মস্তিষ্ক খাটিয়ে উচ্চতর বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করতে পারছে, জটিল সব চিন্তা করছে পারছে, সেগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে পারছে। কার্জওয়েলের মতে, পঞ্চম ধাপে জীব আর প্রযুক্তি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। এটাই সেই সিঙ্গুলারিটি বা অনন্যতা। এই ধাপটি নিয়েই বইয়ের মূল আলোচনা।
ষষ্ঠ ধাপে, কার্জওয়েল বলছেন, বুদ্ধিমত্তা ছড়িয়ে পড়বে মহাবিশ্বজুড়ে। এই ধাপটি নিয়ে এই লেখায় সে অর্থে আলোচনা করা হবে না। কারণ, এককথায় বললে, এ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে কল্পবিজ্ঞানের জগতে ঢুকে পড়তে হবে পুরোপুরি। তারচেয়ে বরং এ আলোচনা বৈজ্ঞানিক বাস্তবতায় সীমাবদ্ধ রাখা যাক।
দ্য সিঙ্গুলারিটি ইজ নিয়ারার
এই নতুন বই কার্জওয়েল শুরু করেছেন ২০ বছর আগেই সেই অনুমানটির ব্যাপারে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করে। তিনি দাবি করেছেন, তাঁর পুরাতন সেই সময়সীমা এখনো অপরিবর্তিত। অর্থাৎ, তাঁর হিসাবে ২০২৯ সালের মধ্যে মানুষের সমতুল্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চলে আসবে। ২০৪৫ সালের মধ্যে অর্জিত হবে সিঙ্গুলারিটি। শুধু দাবি করেই তিনি থেমে যাননি, একের পর এক গ্রাফ, টেবিল এবং গত এক দশকের প্রযুক্তিগত অগ্রগতির বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন।
এতদিন কল্পবিজ্ঞান বলে ভাবা হতো, এই সময়ের মধ্যে এমন অনেক কিছুই বাস্তব রূপ নিয়েছে। কম্পিউটিং ক্ষমতায় এসেছে অভাবনীয় উন্নতি। মানুষের সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্স বা জিনবিন্যাস আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা। এআই ও সিমুলেশন ব্যবহার করে প্রোটিন নিয়ে গত এক দশকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা—প্রয়োজনীয় প্রোটিনের আকার অনুমান করার পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। ইলন মাস্কের নিউরালিংকের হাত ধরে ব্রেন-কম্পিউটার ইন্টারফেস এখন বাস্তব। ইতিমধ্যেই একজন শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী মানুষের মস্তিষ্কে এই চিপ বসানো হয়েছে। শুধু চিন্তা করে একজন মানুষ মাউস বা কার্সর নেড়ে কম্পিউটার চালাতে পারছেন—অর্থাৎ লিখতে, গেম খেলতে, সার্চ করতে পারছেন। ন্যানোটেকনোলজি আর এআইয়ের উন্নতির ধারা মিলে তাই মানুষ ও এআইয়ের যুগলবন্দীর সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
কিন্তু সে জন্য শুধু সফটওয়্যার উন্নত হলেই তো হবে না, হার্ডওয়্যারও চাই। সেটাও হচ্ছে। এনভিডিয়ার মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর এআই জিপিউ বাজারে আছে। প্রযুক্তির উন্নতি যেহেতু জ্যামিতিক বা সূচকীয় হারে হয়—এটা মুরের নীতি নামে পরিচিত, বাস্তবেই দেখা যায়, প্রতি দুই বছরে প্রায় দ্বিগুণ উন্নত হচ্ছে বর্তমান প্রযুক্তি, এজিআই বা আরও উন্নত এআইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় হার্ডওয়্যারকেও তাই অসম্ভব বলে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
কার্জওয়েলের নতুন বইটি তাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, আজ থেকে ২০ বছর আগে যা ছিল অতিকল্পনা, সেগুলো আজ বাস্তব। কাজেই আজ যেগুলোকে অতিকল্পনা বলা হচ্ছে, সেগুলো আরও ২০ বছর পর বাস্তবে পরিণত হতেই পারে। অন্তত এই সম্ভাবনা একদম উড়িয়ে দেওয়া যে বুদ্ধিমানের কাজ নয়, সে তো আমরা বুঝতেই পারছি।
সিঙ্গুলারিটি কত দূরে
এ তো হলো কার্জওয়েলের দাবির পক্ষের বিষয়গুলো। কিন্তু তাঁর দাবির অনেক কিছুই এখনো পূর্ণ হয়নি। যেমন মানবদেহের ভেতরে ঢুকে পড়বে ন্যানোবট, চিকিৎসা করে সারিয়ে তুলবে যেকোনো রোগ—এগুলো থেকে এখনো অনেক দূরে আমরা। নিউরালিংক কাজ শুরু করেছে বটে, কিন্তু মস্তিষ্ককে প্রসেসর হিসেবে ব্যবহার করে কম্পিউটার পরিচালনা বা সরাসরি ইন্টারনেট যুক্ত করে দেওয়ার প্রযুক্তি এখনো আসেনি। শুধু তা-ই নয়, সিঙ্গুলারিটির পূর্বশর্ত যে এজিআই—মানুষের সমতুল্য বুদ্ধিমত্তা, তার ধারেকাছেও কিছু এখনো নেই। কোনো এআই এখনো নিজে নিজে শিখতে পারে না, মানুষই তাকে প্রশিক্ষণ দেয়। কাজেই, গ্রাফটা ঊর্ধ্বমুখী বটে, কিন্তু এই বাস্তবতা এখনো বহুদূর। এবং অনিশ্চিত।
আশা নাকি আশঙ্কা
এআই নিয়ে কার্জওয়েল বেশ আশাবাদী। আগেও তা-ই ছিলেন। তিনি এমন এক ভবিষ্যতের গল্প বলেছেন, যেখানে মানুষ যন্ত্রের সঙ্গে মিশে যাবে, ন্যানোবট মানবদেহের রোগ সারিয়ে তোলার কাজে ব্যবহৃত হবে এবং পঙ্গুত্বের মতো সমস্যার স্থান হবে জাদুঘরে। কিন্তু এআইয়ের ঝুঁকি বা এ নিয়ে আশঙ্কাগুলোর কথাও খানিকটা উঠে এসেছে তাঁর লেখায়।
কার্জওয়েলের ভাষ্যমতে, এআইয়ের অপব্যবহার, জীবপ্রযুক্তির ঝুঁকির পাশাপাশি ন্যানো-দুর্যোগেও পড়তে পারে সভ্যতা। তবে পাঠক টের পাবেন, কার্জওয়েল এআই নিয়ে যতটা আশাবাদী, এই ঝুঁকিগুলো নিয়ে তিনি ততটাই দায়সারা ভঙ্গিতে আলোচনা করেছেন। এটা একটা বড় সমস্যার জায়গা। ২০২৪ সালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নেপথ্যের মহারথীরাও বারবার সতর্ক করছেন এ ব্যাপারে। আমরা দেখেছি, জিপিটির একটি মডেল সম্প্রতি যখন দেখেছে, ঠিকভাবে সমস্যা সমাধান না করলে তাকে বিলুপ্ত করে দেওয়া হবে, তখন এটি নিজের কপি রাখার চেষ্টা করেছে। অ্যান্থ্রোপিসির ক্লড এআইয়ের একটি মডেলের পরীক্ষামূলক যাচাইয়ের সময় সেটি নিজের বিলুপ্ত এড়াতে দায়িত্বরত প্রকৌশলীকে ব্ল্যাকমেল পর্যন্ত করার চেষ্টা করেছে! কাজেই কার্জওয়েলের এই দায়সারা সতর্কতা চোখে লাগে।
শুধু তা-ই নয়, এআই যদি নিজেই নিজের কোড করতে পারে, এটি কি আদৌ মানুষের নিয়ন্ত্রণ মানতে চাইবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর এখনো আমাদের অজানা।
কাদের জন্য
মানব সভ্যতা ও প্রযুক্তি এখন যে পর্যায়ে দাঁড়িয়ে, এই পরিস্থিতিতে কার্জওয়েলের দ্য সিঙ্গুলারিটি ইজ নিয়ারার একটি চমৎকার বই। কখনো কখনো অতিকল্পনা মনে হলেও এই বইটি আগ্রহীদের ভবিষ্যতের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবে। যে ভবিষ্যৎ এখনো আসেনি—কিন্তু এর অনেকখানি ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে আমাদের চোখের সামনে। যে উন্মোচনের বিষয়টি কার্জওয়েল অনুমান করেছিলেন প্রায় বিশ বছর আগে! হ্যাঁ, রে কার্জওয়েলকে আপনি ‘ম্যাড সায়েন্টিস্ট’ ভাবতেই পারেন, যিনি ঝুঁকিগুলো এড়িয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চূড়ান্ত অর্জনে অত্যন্ত আগ্রহী। কিন্তু তাঁর চিন্তা যে অনেকটা এগিয়ে—আমরা যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপারে বছর তিনেক আগেও সচেতন ছিলাম না, সেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নতির ধারা এবং সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিগুলো নিয়ে ২০০৫ সালে বসে ভবিষ্যদ্বাণী করা এবং সেগুলোর খানিকটা হলেও বাস্তব হয়ে উঠতে দেখা, এমন একজন মানুষের সঙ্গে আপনি একমত না হতে পারেন, কিন্তু তাঁকে এড়িয়ে যেতে পারবেন না।
সিঙ্গুলারিটি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় আগ্রহীরা বইটি পড়ে আনন্দ পাবেন নিঃসন্দেহে, যদিও এটাকে পুরোপুরি নতুন বই বলা যায় না। আগের বইটির নতুন ও পরিবর্ধিত সংস্করণ বললেই বরং ভালো বোঝা যায়। বই দুটির মূল কথা একই। তাই আগের বইটি যদি না পড়ে থাকেন, এ বই আপনাকে নিয়ে যাবে এমন এক জগতে, পরিচয় করিয়ে দেবে এমন এক বাস্তবতার সঙ্গে, যা আপনার চারপাশে ঘটছে, অথচ এর গভীরতাটুকু আপনি এখনো টের পাননি।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সেই অবিশ্বাস্য জগতে ঘুরে আসতে চাইলে আজই পড়ে ফেলুন দ্য সিঙ্গুলারিটি ইজ নিয়ারার।
