১৯৯৮ সালে গুগল তার যাত্রা শুরু করেছিল একটি সাধারণ ‘প্রোডাক্ট’—সার্চ ইঞ্জিন নিয়ে। অচিরেই গুগলের সার্চ ইঞ্জিনের অ্যালগরিদম খুব চমৎকারভাবে কাজ করল। ইন্টারনেটের জগতে ঘটে গেল এক বিরাট বিপ্লব। গুগলের যাত্রা সেখানে থেমে থাকেনি। তারা একের পর এক চমৎকার নতুন নতুন পণ্য নিয়ে আসতে থাকে। জিমেইল, গুগল ডক, ইউটিউব, অ্যান্ড্রয়েডসহ আরও কত কী! অবশ্য সবকটিই যে তারা নিজেরাই উদ্ভাবন করেছে বা শুরু করেছে, তা নয়। ইউটিউবের মতো বেশ কিছু পণ্য তারা স্টার্টআপগুলোকে কিনে নেওয়ার মাধ্যমে নিজেদের ইকোসিস্টেমের ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলে।
গুগলের প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেইজ এবং সের্গেই ব্রিন প্রথম থেকেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিকে অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন। গত এক দশকে আমরা দেখেছি, পৃথিবীর সব বাঘা বাঘা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দক্ষ গবেষকদের তাঁরা খুঁজে খুঁজে নিজেদের প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিয়েছেন। এই খোঁজার কাজে তাঁরা নিয়োগ দিয়েছিলেন এজেন্টদের। তাদের কাজই ছিল বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ইভেন্ট ও কনফারেন্সগুলো খুঁজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় দক্ষ মানুষদের বের করা। গুগলের কাছে যাদেরকেই প্রতিভাবান বলে মনে হয়েছে, তাঁদেরকেই গুগল যেকোনো মূল্যে সংশ্লিষ্ট করেছে।
কার্জওয়েল আলোচনায় আসেন তাঁর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সিঙ্গুলারিটি (AI Singularity) ধারণার জন্য। এই তত্ত্ব অনুসারে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে ছাড়িয়ে যাবে এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছাবে, যা আমাদের বর্তমান বোঝার ক্ষমতার বাইরে।
উদাহরণ হিসাবে চলুন, রে কার্জওয়েলের গল্পটা বলি। কার্জওয়েলের পরিবার ইউরোপ থেকে অভিবাসী হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রে আসে। ১৯৬৫ সালে, মাত্র ১৭ বছর বয়সে, তিনি এমন এক সফটওয়্যার বানান, যা বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের স্টাইল নকল করে নতুন শিল্পকর্ম তৈরি করতে পারত। এই সফটওয়্যারটি ছিল একধরনের প্যাটার্ন শনাক্তকারী প্রোগ্রাম; বলা যায়, আজকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পূর্বসূরী। সেই কাজ তাঁকে জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কার এনে দেয়। প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসনের কাছ থেকে সম্মাননা পান হোয়াইট হাউজে।
১৯৭০ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটিতে পড়াশোনা শেষ করে বেশ কিছু চমৎকার আবিষ্কার করেন। তিনি অন্ধদের জন্য প্রথম বই পড়ার প্রযুক্তি (ফ্ল্যাটবেড স্ক্যানার ও অপটিক্যাল ক্যারেক্টার রিকগনিশন) যন্ত্রের উদ্ভাবক। ১৯৯৯ সালে তিনি একটি বই লেখেন, দ্য এজ অব স্পিরিচুয়াল মেশিনস। এ বইতে তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মেশিন ইন্টেলিজেন্স কীভাবে মানুষের ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারে, তা ব্যাখ্যা করেন।
ল্যারি পেইজ ২০১২ সালে কার্জওয়েলের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁকে আমন্ত্রণ জানান গুগলে যোগ দিতে। কার্জওয়েল তখন বলেছিলেন, ‘আমার গবেষণা বাস্তব অ্যাপ্লিকেশনে রূপ নিতে পারে, এরকম কোথাও গবেষণা করতে চাই আমি।’ ল্যারি তাঁর কথায় সায় দেন। ফলে কার্জওয়েল গুগলে ‘ডিরেক্টর অব ইঞ্জিনিয়ারিং’ হিসাবে কাজ শুরু করেন, মূলত মেশিন লার্নিং (যন্ত্রের শিক্ষণ পদ্ধতি) এবং ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ (প্রাকৃতিক ভাষাবিজ্ঞান) নিয়ে।
কার্জওয়েল আলোচনায় আসেন তাঁর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সিঙ্গুলারিটি (AI Singularity) ধারণার জন্য। এই তত্ত্ব অনুসারে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে ছাড়িয়ে যাবে এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছাবে, যা আমাদের বর্তমান বোঝার ক্ষমতার বাইরে। ১৯৫০-এর দিকে গণিতবিদ জন ভন নিউম্যান প্রথম এই ধারণা দেন। কার্জওয়েল সিঙ্গুলারিটির ধারণাকে আরও জনপ্রিয় করেন তাঁর ২০০৫ সালের বই দ্য সিঙ্গুলারিটি ইজ নিয়ার-এ। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন, প্রথমত, ২০২৯ সালের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানব-সমতুল্য বুদ্ধিমত্তা অর্জন করবে; এবং দ্বিতীয়ত, ২০৪৫ সালের মধ্যে সিঙ্গুলারিটি ঘটবে। সেই সময়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে অনেক গুণ ছাড়িয়ে যাবে এবং মানব ও যন্ত্রের মধ্যে একীভবন ঘটবে।
সিঙ্গুলারিটির মূল বৈশিষ্ট্যগুলো হলো: প্রথমত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজেকে উন্নত করে আরও শক্তিশালী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি করতে পারবে। দ্বিতীয়ত, মানুষের মস্তিষ্ক ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একত্রিত হয়ে নতুন ধরনের বুদ্ধিমত্তা তৈরি করবে। তৃতীয়ত, এই পরিবর্তনগুলো মানব সমাজে মৌলিক ও অপ্রত্যাশিত প্রভাব ফেলবে।
কার্জওয়েল বিশ্বাস করেন, প্রযুক্তির অগ্রগতি একটি ‘সূচকীয় বৃদ্ধি-হার’ অনুসরণ করে, অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। তিনি বলছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিগুলো এমনভাবে বাড়বে যে খুব দ্রুত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বুদ্ধি মানুষকে ছাড়িয়ে যাবে।
সিঙ্গুলারিটি ধারণা নিয়ে বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। একদিকে অনেক বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদেরা এই ধারণাকে সমর্থন করেন, আবার অপরদিকে স্টিফেন হকিং ও ইলন মাস্কের মতো ব্যক্তিত্বরা এর সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়ে সতর্ক করেছেন। এই ফাঁকে বলে নিই, কার্জওয়েলের প্রথম বই প্রকাশিত হওয়ার পরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির এত উন্নতি হয়েছে যে তিনি গত বছর, অর্থাৎ ২০২৪ সালে আরেকটি বই লিখেছেন, দ্য সিঙ্গুলারিটি ইজ নিয়ারার। নতুন এই বইতে মূলত তাঁর আগের ভবিষ্যদ্বাণীর নতুন প্রমাণ ও বাস্তব অগ্রগতি উপস্থাপন করেছেন তিনি। অর্থাৎ তিনি যে সিঙ্গুলারিটির ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তা সঠিকভাবেই এগোচ্ছে এবং সম্ভবত তা বাস্তবে রূপ নেবে।
কার্জওয়েলের ‘সিঙ্গুলারিটি’ ধারণাটি সবার মাঝে যেমন আগ্রহ ও কৌতূহল জাগিয়েছে, তেমনি এটি বহু বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ ও দার্শনিকের মধ্যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কেন এত বিতর্ক? চলুন, বিস্তারিত জানা যাক।
অতিরিক্ত আশাবাদ
কার্জওয়েল বিশ্বাস করেন, প্রযুক্তির অগ্রগতি একটি ‘সূচকীয় বৃদ্ধি-হার’ অনুসরণ করে, অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। তিনি বলছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিগুলো এমনভাবে বাড়বে যে খুব দ্রুত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বুদ্ধি মানুষকে ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু কার্জওয়েলের সমালোচকেরা বলেন, সব প্রযুক্তির অগ্রগতি ঠিক যেভাবে কার্জওয়েল বলছেন, সেভাবে বাড়ে না; বরং অনেক ক্ষেত্রেই এর অগ্রগতি ধীর, সীমাবদ্ধ কিংবা নৈতিক-সামাজিক বাধায় আটকে যায়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই ক্যান্সারের নিরাময়, ব্রেন-কম্পিউটার ইন্টারফেস ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা চলমান থাকা সত্ত্বেও বাস্তবে তার প্রয়োগ সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে।
মানবমস্তিষ্কের জটিলতা
কার্জওয়েল এবং তাঁর সমমনা বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মানুষের মস্তিষ্কের কার্যপ্রণালি পুরোপুরি অনুকরণ করে মেশিন তৈরি করা সম্ভব। এ কথা সত্যি যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি তার যাত্রা শুরু করেছিল মানবমস্তিষ্ক যেভাবে কাজ করে, সেই প্রক্রিয়াকে অনুসরণ করে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলেন, মানব মস্তিষ্কের সংবেদন, আবেগ, চেতনাবোধ, নৈতিকতা এবং অভিজ্ঞতা—এসব কেবল নিউরনের মডেল নয়, বরং বহু জটিলতায় গঠিত, যা এখনো পুরোপুরি বোঝা যায়নি এবং সম্ভবত পুরোটা আবিষ্কার করা কখনো সম্ভব হবে না। বিজ্ঞানীদের এ কথা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না, কেননা মস্তিষ্ক অনেক জটিল। উল্লেখ করার মতো বলা যায় মিচিও কাকুর কথা। এই মার্কিন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ মানবমস্তিষ্ককে ‘সৌরজগতের সবচেয়ে জটিল বস্তু’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমরা মানব মস্তিষ্কের প্রকৃত কার্যপ্রণালীর ৫%-এরও কম জানি।’
নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণের ঝুঁকি
সিঙ্গুলারিটির ধারণা অনুসারে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তখন এত শক্তিশালী হয়ে উঠবে যে তা মানুষের নির্দেশ ছাড়াই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। সেটি যদি সম্ভব হয়, তখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। স্টিফেন হকিং, ইলন মাস্ক, বিল গেটসসহ অনেকে সতর্ক করে বলেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যদি একসময় নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারে, তাহলে তা মানবজাতির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে বা অসতর্কভাবে ক্ষতি করতে পারে। কার্জওয়েল যদিও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে সহায়ক হিসেবে দেখেন, সমালোচকেরা একে অস্তিত্ব বিলুপ্তির হুমকি হিসেবে দেখছেন।
মানব মস্তিষ্কের সংবেদন, আবেগ, চেতনাবোধ, নৈতিকতা এবং অভিজ্ঞতা—এসব কেবল নিউরনের মডেল নয়, বরং বহু জটিলতায় গঠিত, যা এখনো পুরোপুরি বোঝা যায়নি এবং সম্ভবত পুরোটা আবিষ্কার করা কখনো সম্ভব হবে না।
নৈতিকতা ও সামাজিক অসাম্য
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি যদি শুধু ধনী মানুষের নাগালে থাকে, তাহলে সমাজে নতুন রকমের বৈষম্য তৈরি হতে পারে। এ ছাড়া মানব-যন্ত্র একীভবনের ফলে ‘মানবতা’ বলতে আসলে কী বোঝাবে—এই প্রশ্ন নতুন করে উঠে আসে। মানব-যন্ত্র বলতে বোঝায়, মানুষ তার শরীরে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র সংযুক্ত করে তার সক্ষমতা আরও বাড়াবে। আমরা ইতিমধ্যেই দেখতে পাচ্ছি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিতে আধিপত্য বিস্তারের জন্য পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে চীনের এক অদৃশ্য সংঘাত বেঁধে গেছে। ধনী দেশগুলো এই প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ করে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে কাজে লাগাতে চাচ্ছে।
সিঙ্গুলারিটি ধারণাটি প্রযুক্তির সম্ভাবনার দিক থেকে অত্যন্ত প্রেরণাদায়ক হলেও এর বাস্তবায়ন নিয়ে রয়েছে বৈজ্ঞানিক, নৈতিক ও দার্শনিকভাবে বহু প্রশ্ন ও দ্বিধা। কিছু মানুষ একে স্বপ্ন হিসেবে দেখেন, আবার অনেকে সতর্কবার্তা হিসেবেও গ্রহণ করেছেন। কার্জওয়েল অবশ্য বিষয়টি অন্যভাবে দেখেন। তিনি মনে করেন, এআই হবে মানবজাতির সহযোগী, যে আমাদের ক্ষমতা বাড়াবে এবং জীবনের মান উন্নত করবে। তবে তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি অনেকের কাছে অতিরিক্ত আশাবাদী বলে মনে হয়।