গাণিতিক সূত্র উপস্থাপনে আইনস্টাইন কি অন্যদের সহযোগিতা নিয়েছিলেন
হ্যাঁ, আইনস্টাইন কয়েকজন গণিতবিদের সহায়তা নিয়েছিলেন। মহাকর্ষ বলের ব্যাখ্যা আবিষ্কার করতে আইনস্টাইন প্রায় তিন বছর ধরে কাজ করেন। ১৯১২ সাল থেকেই তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন হন। এর উত্তরের একটি ধারণাগত সূত্রও উদ্ভাবন করেন তিনি। মহাকর্ষ বলের প্রভাবে চারপাশের শূন্যস্থান বক্রাকার ধারণ করার বিষয়টি তাঁর মাথায় আসে। এ কারণেই যে মহাশূন্যে বস্তুগুলো একে অপরকে আকর্ষণ সূত্রে আবদ্ধ করে, এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত হন।
এটা ছিল মহাকর্ষ সম্পর্কিত চিন্তার জগতে এক বিরাট উল্লম্ফন। আইনস্টাইনের ব্যতিক্রমী চিন্তা এখানেই যে তিনি পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করলেন যেহেতু সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যে শূন্যস্থান ছাড়া আর কিছু নেই, তাহলে আকর্ষণ বল নিশ্চয়ই এই শূন্য (স্পেস) দ্বারাই কার্যকর হচ্ছে। তার মানে, মহাশূন্যে প্রতিটি বস্তু চারপাশের স্পেসকে প্রভাবিত করছে এমনভাবে যে তা একে অপরকে আকর্ষণ করে।
উপরন্তু তিনি আরও বড় কিছু করলেন। আইনস্টাইন উপলব্ধি করলেন যে একই কারণে সময়ও প্রভাবিত হতে পারে। সাধারণত আমরা ধরে নিই, একটি ঘড়ি যেখানেই থাকুক, তার কাঁটা সমান গতিতেই ঘুরবে। কিন্তু আইনস্টাইন প্রস্তাব করলেন, ঘড়ি কোনো বিশাল বস্তুর যত কাছাকাছি থাকবে, তার কাঁটা তত ধীরগতিতে চলবে বা সময় ধীরগতিতে চলবে (টাইম ডায়ালেশন)।
আইনস্টাইনের ব্যতিক্রমী চিন্তা এখানেই যে তিনি পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করলেন যেহেতু সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যে শূন্যস্থান ছাড়া আর কিছু নেই, তাহলে আকর্ষণ বল নিশ্চয়ই এই শূন্য দ্বারাই কার্যকর হচ্ছে।
স্পেস-টাইম সম্পর্কিত মৌলিক আবিষ্কারের পরও আইনস্টাইনের আবিষ্কারে একটি সমস্যা থেকে গেল। তাঁর মৌলিক কাঠামোগত আবিষ্কারটি যে যুগান্তকারী, সেটা দাবি করার জন্য একে গাণিতিক কাঠামোতে প্রমাণ করতে হবে। অর্থাৎ, একটি সমীকরণের সাহায্যে স্পেস-টাইম ও ম্যাটারের সমন্বিত অবস্থান প্রকাশ করে জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির সুনিশ্চিত প্রমাণ উপস্থিত করার প্রয়োজন দেখা দিল। তাঁর এক গণিতবিদ সহকর্মী মার্সেল গ্রসম্যানের সঙ্গে কাজ করার সময় তিনি তাঁর সমস্যার সমাধানের কাছাকাছি পৌঁছে যান। বছর খানেকের মধ্যে তিনি মহাকর্ষকে জ্যামিতিক কাঠামোয় এনে স্পেস-টাইমের পুনসূত্রায়ণ করেন।
কিন্তু এরপর তাঁর আবিষ্কৃত নতুন সমীকরণগুলো পরীক্ষা করতে গিয়ে সমস্যায় পড়লেন। একটি টেকনিক্যাল ত্রুটির জন্য তাঁর মনে হলো সব ভুল। তিনি ভাবলেন, গতির সাধারণ সূত্র সঠিকভাবে বর্ণনা করতে তিনি ব্যর্থ। কিন্তু হাল ছাড়লেন না। বারবার তাঁর সূত্র পরীক্ষার কাজ অব্যাহত রাখলেন।
বছর দুয়েকের মধ্যে তিনি আশার আলো দেখেন। আগের ভুল সংশোধন করেন এবং জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি আবিষ্কারের সমাপনী অধ্যায়ে পৌঁছান।
কিন্তু শেষ মুহূর্তের গাণিতিক সূক্ষ্ম হিসাবনিকাশের সময় ঘটনাবলি হঠাৎ যেন এক বিভ্রান্তিকর অবস্থায় পড়ে যায়। সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছার কয়েক মাস আগে প্রখ্যাত জার্মান গণিতবিদ ডেভিড হিলবার্টের সঙ্গে আইনস্টাইনের পরিচয় হয়। তাঁর সঙ্গে আইনস্টাইন তাঁর নতুন মহাকর্ষ তত্ত্ব সম্পর্কিত সব চিন্তাভাবনা বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেন। কিন্তু পরে আইনস্টাইন জানতে পারেন যে তাঁর আলোচনায় হিলবার্ট দারুণ উদ্যোগে নিজেই আইনস্টাইনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন। আইনস্টাইন হতাশ হন।
একটি টেকনিক্যাল ত্রুটির জন্য আইনস্টাইনের মনে হলো সব ভুল। তিনি ভাবলেন, গতির সাধারণ সূত্র সঠিকভাবে বর্ণনা করতে তিনি ব্যর্থ। কিন্তু হাল ছাড়লেন না।
এরপর জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি নিয়ে দুজনের মধ্যে যেসব চিঠি ও পোস্টকার্ড চালাচালি হয়। তাতে বোঝা যায় তাঁদের মধ্যে আন্তরিকতা সত্ত্বেও তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। হিলবার্ট ভাবছিলেন, একটি অসম্পূর্ণ মহাকর্ষ তত্ত্বকে চূড়ান্ত পর্যায়ে সাফল্যের দিকে নিয়ে যেতে তিনি একটি সুস্থ প্রতিযোগিতা করছেন। আর আইনস্টাইন একে তাঁর একক সাফল্যের চূড়ান্ত পর্বে হিলবার্টের একটি খারাপ ধরনের কাজ বলে ধরে নিয়েছিলেন।
আইনস্টাইনের এই দুর্ভাবনা একেবারে ভিত্তিহীন ছিল না। ১৯১৫ সালের ১৩ নভেম্বর হিলবার্ট একটি চিঠিতে আইনস্টাইনকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেন, তিনি আইনস্টাইনের ‘বিরাট সমস্যার সমাধান’ বের করেছেন। এ সম্পর্কে জানার জন্য হিলবার্ট আইনস্টাইনকে গোটিনজেনে আমন্ত্রণ জানান। আইনস্টাইন এতে আপত্তি তোলেন এবং গোটিনজেনে যেতে অস্বীকৃতি জানান।
এর কয়েক দিন পরেই হিলবার্ট তাঁর গাণিতিক সূত্র লিখে পাঠান। আইনস্টাইন তাঁর বিরক্তি ঢেকে রেখে উত্তর দেন, ‘তোমার সমাধান, যা দেখছি, ঠিক আমার সঙ্গে মিলে গেছে, যেটা কয়েক সপ্তাহ আগে আমি বের করেছি এবং অ্যাকাডেমিতে জমা দিয়েছি (সূত্র: স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন, ১ অক্টোবর, ২০১৫)।’
এর এক সপ্তাহ পর ২৫ নভেম্বর প্রুশিয়ান অ্যাকাডেমিতে হল ভরা শ্রোতাদের সামনে আইনস্টাইন তাঁর জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির চূড়ান্ত সমীকরণ উপস্থাপন করেন।
কেউ জানে না শেষ এক সপ্তাহে কী ঘটেছে। আইনস্টাইন কি নিজেই তাঁর সমীকরণ চূড়ান্ত করেছিলেন? হিলবার্টের সমীকরণ কি ঠিক ছিল? নাকি তিনি আইনস্টাইনের কিছু তথ্য সংযোজন করেছিলেন? মজার ব্যাপার হলো, হিলবার্টের লেখার কিছু গুরুত্বপূর্ণ পাতা পরে উধাও হয়ে যায়।
যা-ই হোক, পরে হিলবার্ট বলেন, জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির ক্রেডিট আইনস্টাইনেরই। এবং কার্যত সেটাই হয়েছে। আইনস্টাইনই জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির জনক।
তবে হিলবার্টও তাঁর প্রাপ্য সম্মান পেয়েছেন। জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির সমীকরণ প্রকাশের প্রায়োগিক কৌশলগত দিক দিয়ে উপযুক্তভাবে প্রকাশের ক্ষেত্রে দুজনের নামই উল্লেখিত হয়েছে। হিলবার্টের অবদান অস্বীকার করা হয়নি।
