আইনস্টাইনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল যে ৫ বই
১১২ মার্সার স্ট্রিট, প্রিন্সটন, নিউজার্সি, যুক্তরাষ্ট্র। ঠিকানাটা আলবার্ট আইনস্টাইনের। জীবনের অনেকটা সময় তিনি এ বাড়িতেই কাটিয়েছেন। কথিত আছে, আইনস্টাইন তাঁর পড়াশোনা, চিন্তাভাবনা ও গবেষণা নিয়ে এতই ডুবে থাকতেন যে, মাঝে মাঝে নিজের বাড়ির ঠিকানা বা ফোন নম্বরও বেমালুম ভুলে যেতেন। একবার ট্যাক্সিতে উঠে বাড়ির ঠিকানা ভুলে গিয়ে ট্যাক্সিওয়ালাকে নাকি বলেছিলেন, ‘আমাকে আইনস্টাইনের বাড়ির সামনে নামিয়ে দাও।’ ট্যাক্সিওয়ালাও তাঁকে ঠিক জায়গায় নামিয়ে দিয়েছিলেন।
আইনস্টাইনের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, কেন তিনি নিজের নম্বর বা ঠিকানা মনে রাখেন না? তিনি বলেছিলেন, ‘যে তথ্য বই বা ডায়েরিতে পাওয়া যায়, তা মস্তিষ্কে জমিয়ে রাখার কী দরকার?’ তবে তিনি এটাও বলতেন, ‘তোমার যেটুকু না জানলেই নয়, তা হলো লাইব্রেরিটা কোথায়।’
আইনস্টাইন যে জন্মগতভাবে প্রতিভাবান ছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে সেই প্রতিভা অনেক বেশি শানিত করেছে তাঁর বই পড়ার অভ্যাস। আইনস্টাইনের বিশাল এক লাইব্রেরি ছিল। সেখান থেকে বই তুলে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডুবে থাকতেন। মার্কিন সাংবাদিক ও লেখক ওয়াল্টার আইজ্যাকসনের লেখা আইনস্টাইন: হিজ লাইফ অ্যান্ড ইউনিভার্স বইয়ে জানিয়েছেন, মেধাবী এই বিজ্ঞানী দর্শন ও বিজ্ঞানবিষয়ক বই পড়তে ভালোবাসতেন। আর সেগুলো তাঁর চিন্তাধারায় গভীর প্রভাব ফেলেছিল। চলুন, আইনস্টাইনের প্রিয় সেই ৫টি বই সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
১. এথিকস: বারুচ স্পিনোজা
ডাচ দার্শনিক বারুচ স্পিনোজার মৃত্যুর পর ১৬৭৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত বই এথিকস। এই বইয়ে স্পিনোজা সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা বা বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তিনি সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী হলেও তাঁর বিশ্বাস ছিল একটু ভিন্ন।
এথিকস বইটি সংযম ও যুক্তিবোধের মাধ্যমে আত্মরক্ষার গুরুত্ব শেখায়। স্পিনোজা রাগ, ঈর্ষা, দুঃখ এবং ঘৃণাকে মানুষের প্রকৃত শত্রু হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘ভয় পেও না—ভালোবাসা, শান্তি এবং দয়ার মাধ্যমে এই পৃথিবীর সব মন্দকে জয় করা সম্ভব।’ বইটি শেখায়, প্রকৃত শক্তি আসে বোঝাপড়া থেকে; বিশেষ করে মহাবিশ্ব বা ঈশ্বরের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়ার মধ্যেই সর্বোচ্চ তৃপ্তি নিহিত।
২. এলিমেন্টস: ইউক্লিড
৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন গ্রিক গণিতবিদ ইউক্লিড এলিমেন্টস রচনা করেন। ১৩ খণ্ডের এই জ্যামিতির বইটি গত প্রায় দুই হাজার বছর ধরে গণিতের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী বইগুলোর একটি। আধুনিক জ্যামিতি, পাটিগণিত এবং সংখ্যাতত্ত্বের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে এই বইয়ের ওপর ভর করেই। বইটিতে ইউক্লিড তাঁর স্বতঃসিদ্ধ যুক্তির মাধ্যমে জ্যামিতিক প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন।
আইনস্টাইন ছোটবেলায় যখন এই বইয়ের সঙ্গে পরিচিত হন, তিনি একে ‘পবিত্র জ্যামিতির বই’ বলে ডাকতেন। আইজ্যাক নিউটন, রেনে দেকার্ত থেকে শুরু করে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন—সবাই এই বই পড়ে প্রভাবিত হয়েছেন।
৩. অ্যানালাইসিস অব সেনসেশনস: আর্নস্ট মাখ
শক ওয়েভ ও শব্দের গতির গবেষণার জন্য বিজ্ঞানের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন অস্ট্রিয়ান-চেক পদার্থবিদ ও দার্শনিক আর্নস্ট মাখ। মাখের চিন্তাভাবনা, বিশেষ করে দৃষ্টবাদ বা পজিটিভিজম আইনস্টাইনকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল। এমনকি আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের বিকাশেও পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছিল মাখের দর্শন।
মাখ বিশ্বাস করতেন, ইন্দ্রিয়-অনুভূতিই সব ভৌত ও মানসিক বিজ্ঞানের মূল তথ্য। তাঁর অ্যানালাইসিস অব সেনসেশনস বইটি ইন্দ্রিয় অনুভূতি এবং ভৌত ও মানসিক জগতের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে। লেখক দেখিয়েছেন, শারীরিক ও মানসিক বিষয়গুলো একে অপরের থেকে আলাদা কিছু নয়, বরং দুটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা একই সংবেদনশীল উপাদান।
৪. নাম্বার: দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ অব সায়েন্স: টোবিয়াস ড্যান্টজিগ
সংখ্যার জাদুকরী দুনিয়ায় প্রবেশ করতে হলে রুশ-মার্কিন গণিতবিদ টোবিয়াস ড্যান্টজিগের নাম্বার: দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ অব সায়েন্স বইটির কোনো তুলনা নেই। ১৯৩০ সালে প্রকাশিত এই বইটি আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। আইনস্টাইন স্বয়ং এই বইটির প্রশংসা করেছিলেন।
বইটির বিশেষত্ব হলো, এটি গল্প বলার ঢঙে লেখা। এখানে কঠিন গণিতের ভাষা নেই, বরং এমনভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যেন সাধারণ মানুষও সহজে বুঝতে পারে। বইটি বিজ্ঞানের ভাষা হিসেবে গণিতের গুরুত্ব তুলে ধরে এবং বিজ্ঞান, গণিত ও দর্শনের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে।
৫. ডন কিহোতে: মিগেল দে সার্ভান্তেস
গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, দর্শন বা মনস্তত্ত্বের বাইরে আইনস্টাইন কাল্পনিক উপন্যাস পড়তেও পছন্দ করতেন। স্প্যানিশ লেখক মিগেল দে সার্ভান্তেসের কালজয়ী উপন্যাস ডন কিহোতে ছিল তাঁর অন্যতম প্রিয়। কাজের ফাঁকে বিশ্রামের সময় তিনি এই বইটি পড়তেন।
সপ্তদশ শতাব্দীতে লেখা এই বইটিকে প্রথম আধুনিক উপন্যাস এবং স্প্যানিশ ভাষায় রচিত সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম হিসেবে গণ্য করা হয়। উপন্যাসটির কাহিনি আবর্তিত হয়েছে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক আলোনসো কুইজানোকে ঘিরে, যিনি বীরত্বপূর্ণ অভিযানের বই পড়তে পড়তে নিজের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তিনি নিজেকে একজন যাযাবর নাইট হিসেবে কল্পনা করতে শুরু করেন এবং বিশ্ব থেকে অন্যায় দূর করতে বেরিয়ে পড়েন। বইটির মূল বার্তা হলো, কল্পনা আর বাস্তবের মিশেলেই জীবন। আইনস্টাইন নিজেও বিশ্বাস করতেন, ‘জ্ঞানের চেয়ে কল্পনা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’