আমরা এক্স-রে বা গামা-রে দেখতে পাই না কেন

উনিশ শতকের মাঝামাঝি স্কটিশ বিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল প্রথম প্রমাণ পান যে আলো একধরনের বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গ। এই বর্ণালির ব্যাপ্তি রেডিও তরঙ্গ থেকে শুরু করে গামা রশ্মি পর্যন্ত। বিদ্যুৎচুম্বকীয় বর্ণালির বেশিরভাগ ‘রং’ আমাদের চোখে অদৃশ্য। আমাদের চোখ শুধু গোটা বিদ্যুৎচুম্বকীয় বর্ণালির অতি ক্ষুদ্র একটা অংশ দেখতে পায়।

বর্ণালির যে অংশটুকু আমরা দেখতে পাই, তাকে বলা হয় দৃশ্যমান আলো। এর মধ্যে রয়েছে বেনীআসহকলা বা রংধনুর রংগুলো। অর্থাৎ বেগুনি, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল। এসব আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পরিসর ৩৮০ থেকে ৭৮০ ন্যানোমিটার।

দৃশ্যমান আলো
ছবি: রেড স্পেকট্রাম

দৃশ্যমান আলোর বাইরেও রয়েছে আরও আলো। সেগুলো আমাদের চোখে অদৃশ্য। ‌এদের প্রত্যেকেরই তরঙ্গদৈর্ঘ্য আলাদা আলাদা। যেমন দৃশ্যমান আলোর চেয়ে ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর মধ্যে রয়েছে অতিবেগুনি রশ্মি, এক্স-রে, গামা-রে। গামারশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য ০.১ থেকে ০.০০০০০১ ন্যানোমিটার। বলা যায়, একটা পরমাণুর আকারের দশ ভাগের এক ভাগের সমান! আর এক্স-রের তরঙ্গদৈর্ঘ্য গামারশ্মির চেয়ে কিছুটা বেশি। এর পরিসর ০.০১ থেকে ১০ ন্যানোমিটার। আল্ট্রাভায়োলেট বা অতিবেগুনি বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রায় ১০০ থেকে ৪০০ ন্যানোমিটার। বোঝাই যাচ্ছে, রংধনুর রংগুলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য আলট্রাভায়োলেট বা অতিবেগুনি রশ্মি এবং এক্স-রের চেয়ে বড় বা লম্বা।

আরও পড়ুন
একইভাবে আমরা যেসব রং চোখে দেখতে চাই, তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য অবশ্যই চোখের রেটিনার কোষের আকারের সমান বা কাছাকাছি হতে হবে।

অন্যদিকে দৃশ্যমান আলোর চেয়ে বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর মধ্যে রয়েছে অবলোহিত ও রেডিও তরঙ্গ। ইনফ্রারেড বা অবলোহিত বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৭৮০ ন্যানোমিটার থেকে ১ মিলিমিটার। অবলোহিত বিকিরণের পর রয়েছে বেতার তরঙ্গের বিস্তৃত ব্যান্ড। এই বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রায় ১ মিলিমিটার থেকে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। তার মানে, রেডিও ও টিভির তরঙ্গদৈর্ঘ্য দৃশ্যমান আলোর চেয়ে লম্বা।

প্রশ্ন হলো, বিদ্যুৎচুম্বকীয় বর্ণালির সবটুকু আমরা দেখতে পাই না কেন? শুধু অতি ক্ষুদ্র অংশ দেখি কেন? এর জন্য দায়ী আমাদের চোখের রেটিনার কোষগুলো। আসলে কোনো ইএম ওয়েভ বা বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গ যে অ্যান্টেনায় উৎপন্ন হয়, ওই তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রায় ওই অ্যান্টেনার সমান হয়। আবার যে অ্যান্টেনা ওই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সমান, শুধু তাতেও ওই তরঙ্গ ধরা পড়ে। তাই মোবাইল বা সেলফোনের আকার মাত্র কয়েক ইঞ্চি হওয়ার কারণ হলো, ওটাই এর অ্যান্টেনার আকার। এই যন্ত্রে যে বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গ সম্প্রচারিত হয় বা ধরা পড়ে, তার তরঙ্গদৈর্ঘ্যও প্রায় একই আকৃতির।

একইভাবে আমরা যেসব রং চোখে দেখতে চাই, তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য অবশ্যই চোখের রেটিনার কোষের আকারের সমান বা কাছাকাছি হতে হবে। তাই আমরা শুধু সেসব রংই দেখি, যেগুলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আকার আমাদের রেটিনা কোষের সমান। বিদ্যুৎচুম্বকীয় বর্ণালির অন্য রংগুলো আমাদের চোখে অদৃশ্য হওয়ার কারণ হলো, সেগুলো হয় আমাদের রেটিনা কোষগুলো শনাক্ত করার জন্য খুব বেশি বড় অথবা খুব ছোট। আসলে রড ও কোন কোষগুলো অতিবেগুনি, এক্স-রে, গামা-রের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চেয়ে বড়। অন্যদিকে অবলোহিত, মাইক্রোওয়েভ ও বেতার তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য রড ও কোন কোষগুলোর চেয়ে ছোট।

আরও পড়ুন

তাহলে প্রশ্ন জাগতে পারে, চোখের রেটিনার কোষগুলোর আকার যদি একটা বাড়ির সমান হতো, তাহলে কী হতো? সেক্ষেত্রে আমরা হয়তো রেডিও আর মাইক্রোওয়েভ বিকিরণও চারপাশে পাক খেতে দেখতাম। আবার আমাদের চোখের কোষগুলোর আকার যদি পরমাণুর সমান হতো, তাহলে হয়তো এক্স-রেও দেখা যেত।

অবশ্য তাতে খুব বেশি ভালো কিছু হতো না। কারণ, সূর্য থেকে দৃশ্যমান আলো ছাড়াও এক্স-রে, গামা-রে ও অতিবেগুনি রশ্মি নিঃসৃত হয় সত্যি। কিন্তু এদের বেশির ভাগই শোষিত হয়ে যায় আমাদের বায়ুমণ্ডলের ওপরের ওজোন স্তরে। তাই এক্স-রে বা গামা-রে ভূপৃষ্ঠে প্রায় পৌঁছাতে পারে না বললেই চলে। কাজেই আমাদের রেটিনার কোষগুলোর আকার যদি এক্স-রে বা গামা-রে দেখার উপযোগী হতো, তাহলে আমরা আসলে ‘চোখ থাকিতেও অন্ধ হতাম’। কারণ, আমরা তখন চারপাশের কিছুই দেখতে পেতাম না।

সূত্র:

দ্য গড ইকুয়েশন/ মিচিও কাকু

দ্য সান’স হার্টবিট/ বব বারম্যান

আফটার দ্য ফার্স্ট থ্রি মিনিটস/ ভানু পদ্মানাভান

উইকিপিডিয়া

আরও পড়ুন