সাক্ষাৎকার
‘আমাদের ডজনখানেক সদস্যকে পোষা পশুর সঙ্গে একটি ছোট্ট ঘরে থাকতে হতো’—রসায়নে নোবেলজয়ী ওমর ইয়াঘি
জর্ডানিয়ান-মার্কিন রসায়নবিদ ওমর ইয়াঘি চলতি বছর রসায়নে নোবেল পেয়েছেন। তাঁর সঙ্গে যৌথভাবে এই পুরস্কার পেয়েছেন জাপানের সুসুমু কিতাগাওয়া ও অস্ট্রেলিয়ার রিচার্ড রবসন। মেটাল-অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্ক নামে নতুন একধরনের আণবিক কাঠামো আবিষ্কারের জন্য তাঁদের এ পুরস্কার দেওয়া হয়।
রসায়নবিদ ওমর ইয়াঘি তখন এয়ারপোর্টে। তিনি একটি ফ্লাইট বদল করছিলেন। ঠিক এমন সময়েই জানতে পারলেন, তিনি এবারের রসায়নের নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতির সময়টুকুতেই তিনি নোবেল প্রাইজ অর্গানাইজেশনের অ্যাডাম স্মিথকে এই সাক্ষাৎকারটি দেন। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য সেই সাক্ষাৎকার অনুবাদ করেছেন শতাব্দী রায়।
ওমর ইয়াঘি: হ্যালো।
অ্যাডাম স্মিথ: হ্যালো, প্রফেসর ইয়াঘি! আমি নোবেল প্রাইজ অর্গানাইজেশনের পক্ষ থেকে অ্যাডাম স্মিথ বলছি।
ওমর ইয়াঘি: হাই!
অ্যাডাম স্মিথ: নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় আপনাকে অনেক অভিনন্দন!
ওমর ইয়াঘি: ধন্যবাদ...অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
অ্যাডাম স্মিথ: আমাদের ওয়েবসাইটের জন্য কি আপনার একটা ছোট্ট সাক্ষাৎকার পেতে পারি?
ওমর ইয়াঘি: নিশ্চয়ই! আমি আসলে এখন একটি ফ্লাইটে আছি। যেকোনো সময়ে ফোনের সংযোগটি হারিয়ে যেতে পারে। তবে তার আগ পর্যন্ত আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারলে আমার বেশ ভালোই লাগবে।
অ্যাডাম স্মিথ: ধন্যবাদ! সত্যিই, কী অদ্ভুত এক পরিস্থিতিতে আমরা কথা বলছি!
ওমর ইয়াঘি: তা বটে! আমি আগের ফ্লাইট থেকে নামার সময়েই খবরটি পেয়েছি।
অ্যাডাম স্মিথ: এমন চমৎকার খবর কখন আসে, তা কেউই বলতে পারে না!
ওমর ইয়াঘি: একদম।
অ্যাডাম স্মিথ: খবরটি শোনার পর আপনার প্রথম প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
ওমর ইয়াঘি: আমি বিস্মিত, আনন্দিত এবং অভিভূত!
অ্যাডাম স্মিথ: নিঃসন্দেহে অসাধারণ একটি মুহূর্ত! আপনি তো ধাতব-জৈব কাঠামো গবেষণার জনক হিসেবে পরিচিত।
ওমর ইয়াঘি: হ্যাঁ।
অ্যাডাম স্মিথ: আর আমার যতদূর মনে হয়, আপনি জর্ডানের প্রথম নোবেলজয়ী। আমি কি ঠিক বলছি?
ওমর ইয়াঘি: হতে পারে...খুব সম্ভবত তা-ই।
অ্যাডাম স্মিথ: আপনার জীবন এবং রসায়নে আপনার যাত্রা, উভয়ই ভীষণ চমকপ্রদ!
ওমর ইয়াঘি: তা ঠিক। আমি এমন এক পরিবেশে বেড়ে উঠেছি, যেখানে আমাদের প্রায় ডজনখানেক সদস্যকে পোষা পশুর সঙ্গে একটি ছোট্ট ঘরে থাকতে হতো। আমার জন্ম এক শরণার্থী পরিবারে। আমার মা-বাবার তেমন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। আমার বাবা ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন, আর মা ছিলেন নিরক্ষর। তাই আমার এই পথচলা বেশ অন্যরকম। আর বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই কেবল এটা সম্ভব। আমি বলতে চাই, বিজ্ঞানই এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমতা সৃষ্টিকারী শক্তি।
অ্যাডাম স্মিথ: নিশ্চিতভাবে! এটা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে প্রতিভা সবখানেই ছড়িয়ে আছে। এর বিকাশের জন্য কেবল একটু সুযোগ প্রয়োজন।
ওমর ইয়াঘি: আমি সম্পূর্ণ একমত। বুদ্ধিমান ও প্রতিভাবান ব্যক্তিরা পৃথিবীর সবখানেই ছড়িয়ে আছেন। এ জন্য আমাদের সব ক্ষেত্রে সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। তবেই তাঁদের প্রতিভার বিকাশ সম্ভব হবে।
অ্যাডাম স্মিথ: অবশ্যই...আমি দুঃখিত যে পুরস্কার ঘোষণার এই সময়টায় আপনাকে এভাবে ব্যস্ত রাখতে হচ্ছে।
ওমর ইয়াঘি: না না, কোনো সমস্যা নেই।
অ্যাডাম স্মিথ: রসায়নের এই ক্ষেত্রটিকে একদম শুরু থেকে আজকের এই অবস্থায় পৌঁছতে দেখার অভিজ্ঞতাটি নিশ্চয়ই অসাধারণ। আপনি এখানে ৩০ বছর ধরে কাজ করছেন…
ওমর ইয়াঘি: হ্যাঁ, আসলেই। আমার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন আমার স্বপ্ন ছিল অন্তত এমন একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করা, যার ১০০টি সাইটেশন থাকবে। এখন আমার ছাত্ররা বলে, আমাদের সাইটেশনের সংখ্যা নাকি আড়াই লাখ ছাড়িয়ে গেছে! আমি সত্যিই এটা আশা করিনি। তবে রসায়নের সৌন্দর্য এখানেই। আপনি যদি পদার্থের ধর্মকে আণবিক স্তরে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখেন, তবেই অপার সম্ভাবনার দরজা খুলে যাবে। আমার মতে, এর সবচেয়ে সুন্দর দিক হলো, এখানে বিজ্ঞানীরা নিজেদের সৃজনশীল চিন্তাকে বাস্তব রূপ দিতে পারেন।
অ্যাডাম স্মিথ: আপনাদের গবেষণা একইসঙ্গে দুটি ভূমিকা পালন করছে। এটি যেমন মানুষের কৌতূহল মেটাচ্ছে, তেমনি পানি দূষণের মতো বড় সমস্যার সমাধানও করছে।
ওমর ইয়াঘি: হ্যাঁ। আমরা যদি পদার্থকে আণবিক স্তরে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তবে তা বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে কাজে লাগানো যায়। পানি, কার্বন ডাই-অক্সাইড বা চিকিৎসাবিজ্ঞান—কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। কারণ আমরা জানি, কীভাবে এই অণু-পরমাণুগুলোকে একটি নির্দিষ্ট ছকে সাজাতে হয়। বিল্ডিং ব্লক দিয়ে বাড়ি বানানোর মতো করে রাসায়নিক গঠন তৈরি করতে পারাটা রসায়নবিদদের কাছে স্বপ্নের মতো। আমরা সেই রেসিপিটা আবিষ্কার করতে পেরেছি।
অ্যাডাম স্মিথ: এটা সত্যিই দারুণ যে, কেবল রসায়নের মৌলিক সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়েই আপনারা এত সম্ভাবনা আবিষ্কার করেছেন।
ওমর ইয়াঘি: ধন্যবাদ এই ব্যাপারটি উল্লেখ করার জন্য! একদম শুরুতে আমি মূলত রাসায়নিক পদার্থের এই সৌন্দর্যের প্রতিই আকৃষ্ট হয়েছিলাম। আমার বয়স তখন মাত্র ১০ বছর। আমি একটি লাইব্রেরিতে গিয়ে রাসায়নিক গঠনের কিছু ডায়াগ্রাম দেখি। এখন আমি জানি, ওগুলো ছিল ‘বল অ্যান্ড স্টিক’ ডায়াগ্রাম। কিন্তু তখন আমি কিছুই জানতাম না। তবুও সেগুলো আমাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করেছিল। আমি কেবল সুন্দর সুন্দর রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করতে চেয়েছিলাম। তখন বিশ্বের কার্বন নিঃসরণ বা পানি দূষণ, এসব কিছুই আমার মাথায় ছিল না।
অ্যাডাম স্মিথ: কী চমৎকার! এর জন্য লাইব্রেরিগুলোও একটি ধন্যবাদ প্রাপ্য।
ওমর ইয়াঘি: একদম! আমি যখন তরুণ শিক্ষার্থীদের কাছে বক্তব্য দিই, ওরা জানতে চায়, আমি কীভাবে রসায়নের প্রতি আগ্রহী হলাম? আমি তখন তাদের বলি, তোমার আশপাশের যেকোনো একটা জিনিস হাতে তুলে নাও। আর ভাবতে থাকো এটা কী দিয়ে তৈরি। যত গভীরভাবে তুমি ভাববে, তত তুমি এর সৌন্দর্যের প্রেমে পড়বে।
অ্যাডাম স্মিথ: এটা সত্যিই অনেক অনুপ্রেরণাদায়ী! আমাদের ফোনের সংযোগ যেকোনো সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।
ওমর ইয়াঘি: হ্যাঁ, হ্যাঁ।
অ্যাডাম স্মিথ: আমার ধারণা, ফ্লাইটে যখন খবরটি ছড়িয়ে পড়বে, তখন হয়তো আনন্দ উদযাপনও শুরু হতে পারে! যাহোক, আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে পেরে কৃতজ্ঞ। অসংখ্য ধন্যবাদ এবং আবারও অভিনন্দন।
ওমর ইয়াঘি: ধন্যবাদ আপনাকেও। বিদায়।
অ্যাডাম স্মিথ: বিদায়।